ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব আশি
পহেলগাঁও পৌঁছে আরণ্যক গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে একটা লজে ঢুকলেন । লজের ম্যানেজারকে বললেন - ভুল পথ ধরে এখানে এসে পৌছেছি। রাত কাপানোর মত একটা রুম যদি পাই খুব ভালো হয়।
ম্যানেজার আইডেন্টিটি কার্ডের ফটোকপি নিয়ে তাকে একটা রুম দিল ।
পহেলগাঁওয়ে পৌঁছে আরণ্যকের মনে হয়েছিল এ জায়গা তাঁর পক্ষে উপযুক্ত নয় । তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন । তিনি চেয়েছিলেন পাহাড়ী নির্জন এলাকা । আর এই জায়গা তো পর্য্যটন কেন্দ্র । নানা রকম মানুষের ভীড় । চেনাজানা কারও সামনে পড়ে যেতে পারেন ।
সেইজন্য ঠিক করলেন উত্তরাখণ্ডের কোন প্রত্যন্ত পাহাড়ি স্থানে তাঁকে যেতে হবে । ভোর বেলায় বেরিয়ে পড়লেন । বিমান যাত্রায় ঝক্কি আছে । সুতরাং বিমানের আশা ছেড়ে দিয়ে বাসে উঠে পড়লেন । বিকেল নাগাদ জম্মুতে এসে রেলস্টেশনে গিয়ে দেখেন হিমগিরি এক্সপ্রেস দশ মিনেটের মধ্যে ছাড়বে ।
তিনি বুকিং কাউন্টারে কারেন্ট রিজার্ভেশন করে বারাণসী এসে পৌঁছালেন। তারপর সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে দেরাদুন এবং দেরাদুন থেকে উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চম্বা নামক স্থানে এলেন । পাহাড়ি এলাকা আর বন জঙ্গলে ঢাকা এই স্থানে এক গোপন গুহার ভেতরে আশ্রয় নিলেন । সেখানে এক তান্ত্রিকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল ।
তান্ত্রিক তাঁকে শিষ্যত্ব দিলেন । ফলে তাঁর পরিধেয় বসনে পরিবর্তন এল । লাল কাপড়, সিঁদুর চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে তান্ত্রিক তাঁকে দীক্ষা দিলেন ; চুল দাড়ি গোঁফ কামাতে নিষেধ করলেন ।
তান্ত্রিক মহাকালীর ভক্ত । নরবলি দিলেই নাকি তাঁর তপস্যায় সিদ্ধিলাভ হবে । আর মেঘ না চাইতেই জল - এমন কপাল তাঁর । তক্কে তক্কে রইলেন অমাবস্যা তিথির আগমন পর্য্যন্ত ।
আরণ্যক নি:সন্দেহে ধুরন্ধর । তান্ত্রিকের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু পরিচয় পেয়েছেন তাতে করেই জেনে গেছেন তান্ত্রিকের নির্দেশ মত তাঁকে একটি কচি শিশু জোগাড় করে দিতে হবে ।
আরণ্যক বুদ্ধিমানের মত উত্তর দিলেন - এটা কোন ব্যাপারই নয় । মহারাজ যখন তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন তখন জেনে রাখুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোন শিশুকে তাঁর সামনে হাজির করে দেবেন । কিন্তু তার জন্য তো তাঁকে লোকালয়ে যেতে হবে ।
তান্ত্রিক খুশি হলেন । বললেন - আজ হি চলা যা বেটা; কাম তামাম করকে ওয়াপস আ জা ।
আরণ্যক পোষাক পাল্টে বেরোতে যাবেন তান্ত্রিক সামনে এসে দাঁড়ালেন। আরণ্যক সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানিয়ে বললেন - আমার সব জিনিসপত্র রেখে গেলাম । ওই দেখূ মুড়ে রেখেছি । আপনি তান্ত্রিক - সব কামনা বাসনার উর্দ্ধে । তাই ভরসা করে রেখে যাচ্ছি ।
- কহাঁ জাওগে বেটা ? আজ হি অমানিশা হ্যায় । আজ নেহি কল যাও। আজ মেরা পূজা দেখোগে ।
আরণ্যক বুঝে গেলেন আজ নরবলি হবে । আর সেই বলির পাঁঠা তিনি নিজে ।
বললেন - সাম তক লোটেঙ্গে জরুর । আপকা পূজা তো রাত কো বারহ বজে শুরু হোগা ! তব তক কোই বচ্চাকো লেকে আউঙ্গা ।
তান্ত্রিক হুংকার ছাড়লেন । বলি কে বচ্চা মিল চুকা হ্যায় । তুম দেখকে যাও ।
বলে ভেতর থেকে খড়্গ বের করে দু'হাতে তুলে ধরলেন ।
আরণ্যক সমূহ বিপদের কথা ভেবেও ভয় পেলেন না। পকেটস্থ রিভলভার বের করে সটান তান্ত্রিকের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করলেন । জয় তারা বলে তান্ত্রিক মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ।
আরণ্যক আর দেরী না করে হাঁটতে শুরু করলেন । একবার পিছনে দেখেন আবার চলেন। আবার পিছন ফিরে তাকান। কিছু দেখতে না পেয়ে এবার দৌড় লাগান । কিছুদূরে একটা এক্কাগাড়ি পেয়ে উঠে পড়েন।
- কহাঁ যানা হ্যায় সাব ?
- চম্বা ।
বলে তিনি ঘোড়ার গাড়ি চেপে চললেন চম্বা । যেতে যেতে তিনি চিন্তা করছেন কোথায় যাবেন ! হঠাৎ মনে পড়ল কুমায়ূন । অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গা ।
কুমায়ূনে এসে একটা লজ ভাড়া নিয়ে আপাতত থেকে গেলেন।
প্রদ্যুম্ন ঘোষালের কেস নিয়ে নয়ডা থানায় হৈ চৈ পড়ে গেল । চুরির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে চোরের বুদ্ধিমত্তার তারিফ করলেন আধিকারিকরা। তাঁদের সন্দেহ গিয়ে পড়ল বাংলা ভাষী দুষ্কৃতিদের উপর । সজ্জন সিং এর টাকা চুরি, ঘোষাল সাহেবের বাড়িতে চুরি, এবং সজ্জন সিং এর বিয়ে - তিনটে ভিন্ন ঘটনাকে একত্রিত করলে দাঁড়ায় একজন কমন আদমী যে এই তিন ঘটনার জন্য দায়ী । পুছতাছ করলেন সজ্জন সিংকে । সব বিবরণ শুনে পুলিশের দল এল ললন্তিকাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ।
- আপকি নাম ?
ললন্তিকা কিছু গোপন করল না । এমনকি তাকে আরণ্যক বসুরায় যে ছলনা করে এখানে বিক্রি করে দিয়েছে তাও বলল। আর সজ্জনের প্রশংসা করে বলল - এমন স্বামী যেন প্রতিটি মেয়ের কপালে জোটে ।
পুলিশ কনফার্মড হয়ে গেল এ সব ঘটনার পিছনে আরণ্যক বসুরায়ের হাত আছে। তাকে ধরার ছক কষতে শুরু করে দিল পুলিশ ।
ললন্তিকা এবার ধরল সজ্জনকে। এখানে থাকলে আরও ভয়ানক বিপদ হতে পারে ।
সজ্জন বললেন - কোথায় যাবে ঠিক করেছ?
- তোমার দেশের বাড়ি পাতিয়ালায় ।
- গণ্ডগ্রামে তুমি একলা থাকতে পারবে না । আমি তো অফিস বন্ধ রাখতে পারি না ।
ললন্তিকা বলল - দাঁড়াও। একটা ফোন করে দেখে নিই।
বলে অরবিন্দকে ফোন করল ।
- ললন্তিকা বল । কি বলবে বলছিলে !
- তোমার ওখানে যাওয়া যাবে ?
কোন গোপন না রেখে বলল ললন্তিকা ।
- আমার এখানে ? ললন্তিকা তুমি আর ঠাট্টা কর না । বেশ সুখী গৃহিণী হয়ে রয়েছ তো !
ললন্তিকা বলল - কিছু দিনের জন্য । এখানে আরণ্যক নানা বেশ ধরে যা শুরু করেছে তাতে আমাদের ভয় হচ্ছে।
- ললন্তিকা ! তুমি জানো আমিই এখন পরের বাড়িতে আছি। আমার পেছনে পুলিশও আছে । এখন দুম করে তুমি যদি বল আসব ; আমি কি বলব বল তো !
- তুমি তোমার স্যারের সাথে কথা বলে আমাকে জানাও। আমি পনের মিনিট পর আবার ফোন করব ।
অভয়ঙ্করবাবু পাশের রুমেই ছিলেন । অরবিন্দ এসে বলল - আসব স্যার !
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - কি ব্যাপার প্রশান্ত তোমাকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন ?
- স্যার ললন্তিকার বিষয়ে তো আপনাদের সব জানিয়েছি। ও তো এখন একজন পাঞ্জাবীকে বিয়ে করে সুখেই আছে । কিন্তু আরণ্যক --
অভয়ঙ্করবাবু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন । বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন। বললেন - আরণ্যক ! আরণ্যক কি ললন্তিকার ওখানে উঠেছে না কি ?
- না স্যার । তবে ওখানে মাঝে মাঝে গিয়ে যা কাণ্ড করছে !
- কি করছে ?
- স্যার, ছলনায় ভুলিয়ে ললন্তিকাকে তো পাঁচ লাখ টাকায় সজ্জন সিং এর হাতে তুলে দিয়েছে। সজ্জন সিং ভালো লোক, তাই ললন্তিকাকে বিয়ে করেছে। সুখেই ছিল । একদিন সজ্জনের অফিস থেকে দশ লাখা টাকা চুরি করে পালায় । তার কিছুদিনের মাথায় প্রদ্যুম্ন ঘোষাল নামে সজ্জনের প্রতিবেশীর বাড়িতেও অদ্ভুত কায়দায় চুরি করে আবার পালিয়েছে । ললন্তিকা খুব ভয় পেয়েছে । আবার যদি কোন ক্ষতি করে ! তাই ললন্তিকা বলছিল আমার কাছে কিছুদিনের জন্য থাকবে । আমি ওকে কত বোঝালাম - নিজেরই ঠিকানা নেই , আবার ওকে নিয়ে কি ফ্যাসাদে পড়ব !
অভয়ঙ্করবাবু মন দিয়ে কথাগুলো শুনলেন । তারপর ফোন করলেন মিঃ গুপ্তকে । বুঝিয়ে বললেন - জাল গোটানো শুরু করুন। রুই, মৃগেল ঢুকছে, কাতলাও ঢুকবে।
মিঃ গুপ্ত বললেন - আরে মশাই, হেঁয়ালি রাখুন তো; খোলসা করে বলুন ।
- ললন্তিকা সেনকে মনে পড়ে ? ওই যে বলছিলাম না আরণ্যক বসুরায় যে মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছিল !
- হাঁ হাঁ মনে পড়েছে। বলুন তারপর -
- ওই ললন্তিকা অরবিন্দের কাছে আসতে চায় । কিছুদিনের জন্য। কি করবেন ?
- আমি কি বলি বলুন তো ? দাঁড়ান উপরমহলে জানাই । ওঁরা কি বলেন দেখি । আপনি ফোন ধরে রাখুন । মিনিট খানেক পর মিঃ গুপ্ত অভয়ঙ্করবাবুকে বললেন - আসতে দিন । তবে আপনার খরচ তো বেড়ে গেল । এতগুলো উটকো লোককে খাওয়ানো, ঘরে রাখা , চাট্টিখানি কথা !
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - সে চিন্তা আমার । আমি পুলিশকে গোপন তো করতে পারি না । তাই বললাম। ঠিক আছে । আপনার কথাই রইল। আমি তবে আসতে বলে দি ?
- বলুন ।
এরপর অভয়ঙ্করবাবু অরবিন্দকে বললেন - আরণ্যক বসুরায়ের জন্য সব করতে পারি । তুমি ললন্তিকাকে বলে দাও আসতে ।
বিস্ময়ের পর বিস্ময় । অরবিন্দ ভেবে পেল না, তাদের মত দুষ্টু লোকের সঙ্গে স্যারের মত মহান লোকও আছেন এই দুনিয়ায়।
ললন্তিকাকে ফোন করতে হল না । অরবিন্দই জানিয়ে দিল ' চলে এস ' ।
( ক্রমশ )
