ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
একচল্লিশ পর্ব
আতাউর কামালের মূল লক্ষ্য মিঃ আরণ্যক বসুরায় । একমাত্র উদ্দেশ্য আরণ্যক বসুরায়ের ঘনিষ্ঠ হওয়া। আর তাঁকে চিনিয়ে দিতে পারে আপা।
অরবিন্দও পারত । তখন তো আর তেমনভাবে ভাবেনি। নইলে সহজেই লক্ষ্যভেদ করা যেত । আর এখন তো ওর সাথে দেখা হবার কোন সুযোগই নেই । বিচারাধীন বন্দী। তথাপি একবার চেষ্টাও করেছিল ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ।
সন্ধান পায়নি । শুনেছে পুলিশ এনকাউন্টারে মারা গেছে। খালি হাতে ফিরতে হয়েছে কামালকে । এখন একমাত্র ভরসা ললন্তিকা ।
কামাল সেখান থেকে ফিরে ললন্তিকাকে সংবাদ দিল - অরবিন্দের মা গত হয়েছেন । তাঁর শ্রাদ্ধশান্তি করতে কোর্ট দশদিনের জামিন দেয় । অরবিন্দ সেখান থেকে পালাতে গেলে পুলিশ গুলি করে ওকে মেরে দেয় ।
ললন্তিকা মন দিয়ে সব শুনল; কিন্তু তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া দিল না । মন খারাপ হয়েছিল ঠিক ; কিন্তু কোন মন্তব্য বা দুঃখ প্রকাশ করল না ।
কামাল অন্যরকম ভেবেছিল । খবর শুনে ললন্তিকা নিশ্চয় কান্নাকাটি করবে । তখন সুযোগ বুঝে অরবিন্দকে কেন মারা হল ; এর পিছনে চক্রান্ত কার - সব বলে দেবে ।
ললন্তিকা তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করল না বলে মনোক্ষুণ্ণ হলেও হাবে ভাবে তা' প্রকাশ করল না ।
বলল - আচ্ছা আপা! এমনটাও তো হতে পারে পুলিশ মারে নি । মেরেছে অন্য কেউ !
ললন্তিকা এরও কোন প্রতিক্রিয়া দিল না । সে যতটা অরবিন্দকে জানে, বোঝে; তা'তে অরবিন্দ এমন কাঁচা কাজ করতেই পারে না । তার ধারণা দৃঢ় হল অরবিন্দ পালাতে সক্ষম হয়েছে। আর পালিয়ে গেছে বলেই পুলিশ অন্য কাউকে মেরে অরবিন্দ বলে চালিয়ে দিয়েছে।
বিরক্ত হয়ে কামাল বলে - আপা! আপনার কোন মানসিক পরিবর্তন দেখছি না । অরবিন্দের জন্য আপনার কি দুঃখ হচ্ছে না ?
- একদমই না ।
বিস্মিত কামাল বলল - বলেন কি আপা ? এত বড় দু:সংবাদ ; আপনি বিচলিত না হয়ে বলছেন মোটেও দুঃখ হচ্ছে না ?
- কারণ অরবিন্দ মরেনি। অরবিন্দ মরতে পারে না । আমি সিওর সে কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে।
- তাহলে ওখানে গিয়ে শুনলাম অরবিন্দ পুলিশ এনকাউন্টারে মারা গেছে !
- সেটাই তো রাজনীতি ! সেটাই তো এক বিরাট ষড়যন্ত্র ।
কামাল যেন থতমত খেল ।
- বলেন কি আপা ?
ললন্তিকা ঠাণ্ডা মাথায় বলল - অরবিন্দকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি । ও আমার প্রেমিক ; আমার স্বামী । যদিও সম্পর্কটা বেশ গোলমেলে । ও আমার আপন মামাতো ভাই । তাই হয়তো বিয়েটা সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি । আমাদের এখানে সেখানে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে ।
- ও তাই আপনি ওপার বাংলায় চলে গিয়েছিলেন ওকে ছেড়ে দিয়ে ?
- না কামাল ভাই । আমি গেছিলাম কিছুদিনের জন্য নিজেকে সেফ-সাইডে রাখতে । সেজন্য তোমাকে অবশ্যই একটা ধন্যবাদ দিতেই হয় ।
- না না, এ কি বলেন আপা ? আপনাকে আমার বন্ধুর স্ত্রী রূপেই দেখি, মান্যিগণ্যি করি । কোনদিন আপনার অবাধ্য হয়েছি ?
- সেটাই তো দেখছি। আর সেইজন্যই তোমার উপর আমার আস্থা অনেক বেড়ে গেছে। আমি ভাবছি অন্য কথা ।
- কি কথা আপা ?
ললন্তিকা বলবে কি বলবে না ভাবছে। বলে দিলে যদি তার সম্পর্কে অন্য ধারণা জন্মায় ! কিম্বা যদি অবিশ্বাস করে !
ললন্তিকাকে চুপ হয়ে যেতে দেখে কামাল বলল - আপত্তি থাকলে বলেন না । আমি কিছু মনে করব না ।
ললন্তিকা বলল - দূর ! তাই কি হয় ?
- তা'লে বলে দ্যান কি কথা; যদি কিছু সাহায্য করতে পারি ধন্য হব ।
কামালের এই বদান্যতার জন্যই ললন্তিকা তাকে ভরসা করে । নইলে আরণ্যক সেন যে দুর্ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে ; অরবিন্দকে পুলিশে দিয়ে যে অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছে তার জীবনে ; কামাল না থাকলে বা হেল্প না করলে সেও হয়তো আজ অন্ধকার ঘরেই বন্ধ হয়ে থাকত ।
কামাল পুনরায় বলল - বলেন না আপা , শুনি।
ললন্তিকা খানিকক্ষণ ভেবে নিল তারপর বলল - আরণ্যক বসুরায়কে চেনো ?
কামাল বলল - নামটা শুনেছি । আম্মি বলছিলেন এই নামের কেউ বড়কত্তাকে ফোন করে আপনাকে নিয়ে অনেক গল্প বানিয়ে বলেছিল । যার জন্য কত্তা আপনার উপর রেগে গিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
- ঠিক তাই । সেই জন্যই তোমাকে বলেছিলাম আবার ফিরিয়ে আনতে । যাক জেনে গেছ যখন একটা কাজ করবে ?
- বলেন বলেন কি করতে হবে ?
- আরণ্যক বসুরায়ের খবর এনে দিতে হবে । শুনেছি এখন ও সুস্থ হয়ে গেছে । কলেজ স্ট্রীটে ওর প্রকাশন সংস্থায় যেয়ে ওকে খুঁজে বের করতে হবে । ওখানে ওকে না পেলে সোজা কৃষ্ণপুরে গোপালকৃষ্ণ চাকলাদারের ফ্ল্যাটে খবর নিতে হবে ওর গতিবিধি সম্বন্ধে । পারবে ?
- এ আর কি এমন কাজ ? যাব আর আসব।
ললন্তিকা বলল - চল আমিও তোমার সাথে যাব ।
তারপরই বলল - না থাক। আমার যাওয়া ঠিক হবে না । আমাকে দেখলেই চিনে ফেলবে । তুমি একলাই যাও।
- ঠিক আছে আপা । আপনি সাবধানে থাকবেন। এনায়েত এনামুল রইল , ওদের বলে দিচ্ছি কোন অসুবিধা হতে দেবে না ।
কামাল বেরিয়ে গেল কলেজ স্ট্রীটের উদ্দেশ্যে । একটা ভাড়া করা মোটর বাইকে । কলেজ স্ট্রীটের অলিগলি তার চেনা । কিন্তু ওই থানার ওসি পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য খুব ধুরন্ধর । আবার অরবিন্দ ওর সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ওসিকে বলে দিয়েছে। চেহারার মোটামুটি বিবরণ তো দিয়েছেই । এখন স্কেচ আঁকিয়ে রেখেছে যদি ! ধরা পড়লে তো চলবে না ।
পরচুলা পরে নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করে উপস্থিত হল কলেজ স্ট্রীটে কনকলতা প্রকাশনীতে ।
- কি চাই স্যার !
- আরণ্যক বসুরায়ের কোন বই, আত্মজীবনী যাই হোক একটা দিন ।
একটা ক্যাটালগ বের করে কর্মীটি কামালের হাতে দিয়ে বলল - এই দেখুন স্যার । এ গুলো সবই স্যারের লেখা। কোনটা দেব বলুন !
কামাল ' কেউটের ছোবল ' বইটা আড়াইশ' টাকা দিয়ে কিনে নিল ।
কর্মীকে প্রশ্ন করল - স্যার আছেন নাকি অফিসে ?
লোকটি কামালের মুখের দিকে চাইল । বেশ সুবিন্যস্ত পোষাক । ব্যাকব্রাশ করা চুল । চোখে সানগ্লাস । সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের কেউ হবেন হয়তো ।
বলল - স্যার কয়েকদিন ছুটিতে আছেন। কোন আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন ।
- থ্যাঙ্ক ইউ। চলি ! বলে কামাল বেরিয়ে গেল ।
তারপর মোটরবাইকে চেপে গাড়ির গতি কমিয়ে চলে গেল । পথে যেতে যেতে মনে করল একবার কৃষ্ণপুরের বাড়িটা দেখে যাই।
কৃষ্ণপুরের এড্রেসে পৌঁছে গোপালকৃষ্ণ চাকলাদারের নাম বলতেই লোকজন দেখিয়ে দিল ফ্ল্যাটটা । ওই ফ্ল্যাটের তিনতলায় থাকেন গোপালবাবু ।
দরজায় পৌঁছে কলিং বেল বাজাতেই কল্যাণী আই হোল দিয়ে দেখে নিল কোন অপরিচিত লোক বেল বাজিয়েছে।
দরজা না খুলে ভেতর থেকে বলল - কাকে চান?
- এটা কি গোপালকৃষ্ণ চাকলাদার মহাশয়ের বাড়ি ।
- হ্যাঁ, তবে উনি এখন নেই ।
- আচ্ছা ম্যাডাম বিখ্যাত সাহিত্যিক আরণ্যক বসুরায় কি আছেন ? ওনার একটা ইন্টারভিউ নেবার ছিল । আমি আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে আসছি ।
কল্যাণী তবু দরজা খুলল না । ভেতর থেকে জবাব দিল মেসোমশাই এখন আউট অফ স্টেশন ।
- কোথায় গেছেন বলতে পারেন ?
- উনি গতকাল রাণীগঞ্জে গেছেন নেমন্তন্ন রক্ষা করতে।
- কবে আসবেন ?
তা জানি না ।
- ধন্যবাদ ম্যাডাম । চলি ।
( ক্রমশ )
