ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব ছাপ্পান্ন
ললন্তিকা শুনে যাচ্ছে অরবিন্দ আর তার মামার কাহিনী। অরবিন্দ বলতে লাগল ওর হাতে বইটা ( অর্থাৎ পাণ্ডুলিপিটা ) নেই দেখে বাবা তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল ; আমার যে কি ভয় করছিল সে আমি ছাড়া কেউ বুঝবে না ।
একে তো কপালে বাবার পিটুনি তায় আবার ওই দিনই মাঝরাতে এসে আরণ্যকের হামলা ; ভয়ে তখন কাঠ হয়ে গেছি। আরণ্যক কামালকে ইঙ্গিত করতেই গর্জে উঠল থ্রি নট থ্রি । নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরপর তিনটে গুলি গিয়ে বিঁধল বাবার কপালে। আমি গুলির আওয়াজ পেলাম মাত্র । কামালকে চিনতে পারিনি। তবে স্যুট টাই পরা লোকটাই যে আরণ্যক বসুরায় দেখেই বুঝে গেলাম ।
ললন্তিকা বলল - তুমি তো আগে কখনও দেখনি আরণ্যককে - বুঝলে কি করে ?
অরবিন্দ বলল - বাবার মুখে শুনতাম আরণ্যক বসুরায়ের নাম । কলেজ স্ট্রীটে তাঁর প্রকাশনা সংস্থা - কনকাঞ্জলী প্রকাশন । বাবা বলছিলেন কলেজ স্ট্রীটে যেয়ে একদিন আলাপ করে এসেছেন । পাণ্ডুলিপির জেরক্স জমা দিতে বলেছিলেন । বাবা দিয়েছিলেন; কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে তিনি বাবাকে আর ডাকেননি।
- শুধু নাম শুনেই চিনে ফেললে ?
- তা কেন ? বাবা বলত আরণ্যক বসুরায় বাঙালি লেখক হওয়া সত্বেও তিনি কোনদিন বাবার মত ধুতি শার্ট বা পাঞ্জাবি পরেন না । সব সময় নাকি সাহেবদের ড্রেসে থাকতেন ।
সেদিনও দেখেছি পরিপাটি চুল , মাথায় হ্যাট , ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, কোট, স্যুট টাই , চকচকে বুটজুতো পরে এসেছিলেন। সিগারেট ধরিয়ে ঈশারা করলেন । অমনই গুলি করে ওরা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল ।
মা থানা পুলিশ করেছিল ; লাভ হয়নি। ফরমালিটি রেখে পুলিশ পোস্টমর্টেম করিয়ে বডি ছেড়ে দিল । এমনকি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যেটা দিয়েছিল সেটা ভূয়ো। মা কিছু করতে পারেনি ।
সেই ঘটনার কয়েকদিন পর সাগর এল আমাদের বাড়ি । সহানুভূতি দেখাল । আমাকে প্রতিশোধ নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করল ।
সাগরকে আমি ভালো লোক ভাবতাম । আমাকে ওর দলে ভিড়িয়ে দিল । কামাল এসে বেশ কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করল। বলল আজ থেকে আমরা বন্ধু । মোটামুটি মেনে নিলাম সেই জীবন । দেখতে দেখতে কয়েকবছরের মধ্যে আমি প্রিয় হয়ে উঠলাম আরণ্যকের । দুষ্কর্মের দলপতি হয়ে দল পরিচালনা করে প্রচুর ইনকাম করেছি । আবার তা ঝরাপাতার মত টুপটুপ করে খসে পড়ল । ইতিমধ্যে তোমাদের বাড়িতে যেতে হল এবং সেখানে থাকতে থাকতে তোমার প্রতি আকৃষ্ট হলাম । সে ঘটনা তো তুমি জানো।
তবে তোমার মাথায় যে বাবার মত ভাবনা রয়েছে সেটা প্রথম জানলাম তোমার উকিলের চিঠি দেওয়ার পর ।
কারণ তুমি কোথায় যেতে, কি করতে জানার কোন আগ্রহ দেখাইনি। নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেছি ।
ললন্তিকা বলল - আই অ্যাম সরি। ভুল করেছিলাম।
অরবিন্দ বলল - দ্যাটস ওকে। এখন আমাদের দুজনেরই লক্ষ্য একটাই। আরণ্যক রায় ।
ললন্তিকা বলল - আমি প্রতিশোধ নিতে চাই।
ওরা একটা প্রাইভেট কার বুক করে রাণীগঞ্জে নামল। তারপর টোটোয় চেপে মেজিয়া ব্রীজের আগে নেমে গেল । বাকি পথ হেঁটে গীতা আশ্রমে ঢুকল ।
আরণ্যক বসুরায় উপস্থিত হলেন থানায় । রেকর্ড করা আডিও টেপ থেকে বিপরীতধর্মী কিছু উক্তি ডিলিট করে বাকি অংশটুকু জমা দিলেন মি: পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্যকে।
পরমেশ্বর কথাগুলো শুনে বললেন - এবার কি করবেন ?
- কি করা উচিত বলে তুমি মনে কর? এডভাইস নিতেই তো তোমার কাছে এলাম ।
- দেখুন স্যার । অনেক ভি ভি আই পির কেস নিয়ে তদন্ত করেছি। এমন হেঁয়ালি ভরা কেস একটাও পাইনি । ওরা তো এখন ভীমগড়ে আই মিন লোকেশন তাই বললেও আমি মনে করি ওরা এমন একটা অড জায়গায় থাকবে না । অবশ্য বলা যায় না থাকতেও পারে । আপনি ওদের কথামত কিছু টাকা নিয়ে চলুন। আমরা পুলিশকে এলার্ট করছি । যে ছেলেটিকে টাকা নিয়ে যেতে বলছেন তাকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন । না হলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে অরবিন্দের কেসটার মত ।
আরণ্যক বললেন - কাল সকালে সে আসবে। তখন তোমাকে দেখিয়ে দেব
- উঁহু । ঘাড় নেড়ে মিঃ পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য বললেন - দেখিয়ে দিলে তো হবে না। তার নাড়ী-নক্ষত্র সব আমাকে জানতে হবে । ওকে থানায় নিয়ে আসবেন ।
আরণ্যক আর এক ঝামেলায় পড়লেন । সাগর ছেলেটা নিজেও তো একজন দুর্বৃত্ত । প্রথম কথা পুলিশ শুনলেই তো অরাজী হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত পুলিশের জেরায় যদি ভুলভাল কিছু বলে বসে তখন তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে! থানায় না এলেই বরং ভালো হোত। এখন পড়লেন উভয় সঙ্কটে। এগোতেও পারছেন নি আবার পিছিয়ে আসতে গেলে পরমেশ্বর তো ঘাড়ে চেপে বসবে !
আরণ্যক ফোন করলেন সাগরকে । সব অবগত করিয়ে অভয় দিলেন আমি থাকতে তোর কিচ্ছুটি হতে দেব নি ।
নিমরাজি হয়ে সাগর আসবে বলল ।
হাসপাতালে তিনদিন হয়ে গেল । গোপালকৃষ্ণ বাবুর জ্ঞান ফিরে আসেনি । ডাক্তাররা বলছেন অভাবনীয় শক থেকে এরকম হয়েছে। ঘাবড়ে যাবার মত কিছু নয় । উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন ।
এমন সময় রুদ্র এসে বনলতা দেবীকে জানাল যে মেসোমশাই অর্থাৎ আরণ্যক বসুরায়কে বাবা যে বলেছিলেন না যে সামওয়ান অরবিন্দ সরখেল মেসোমশাইএর বিষয় সম্পত্তি দাবী করেছে ; সে টা সত্যি।
- বলিস কি রে ! তোর বাবা তো বানিয়ে বলেছিলেন!
- না মা ! বানিয়ে বলেননি। উনি নিশ্চয় জেনেছিলেন কোন সোর্স থেকে ।
- সে কি ?
রুদ্র বলল - হাঁ মা এটাই ঘটনা। মেসোমশাই এখন থানার শরণাপন্ন হয়েছেন । আমাকে পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য কলেজ স্ট্রীট থানার ওসি জানালেন ।
- আরু যে এমন লোক আগে জানলে কণাকে সাবধান করে দিতাম । ভিজে বেড়ালের মত ভান করে ছিল ।
- সেটাই তো মা চিন্তার বিষয়। এখন আমরা যে কি করি?
- ভয় পাসনি বাছা । ধর্ম অধর্ম বলে একটা কথা আছে।
- এই তো দেখছি ধর্মের বিধান। বাবা অজ্ঞান হয়ে রয়েছেন। কখন যে জ্ঞান ফিরবে কি জানি !
আরণ্যক বসুরায় ফোন করলেন রুদ্রকে, ক্ষমা চেয়ে ঘটনাটা ভুলে যেতে বললেন ।
রুদ্র বলল - ভুলে যাব ? এত বড় একটা ঘটনা ভোলা সম্ভব ? আমরা বিধাননগর থানায় যাব বাবা সুস্থ হলেই ।
- শোনো রুদ্র । কোন লাভ হবে না। বিধাননগর কেন কলকাতার কোন থানাই কেস নেবে না । সে বন্দোবস্ত করে এসেছি ।
- শুনুন মিঃ আরণ্যক বসুরায় ! আমিও রুদ্রভৈরব চাকলাদার। নামের সঙ্গে আমার কামেরও যথেষ্ট সঙ্গতি রয়েছে। আপনি আমার ছেলের মাথায় রিভলভার ঠেকিয়েছেন; আমার বাবাকে অসুস্থ করে দিয়েছেন, আমি আপনাকে কোনমতেই ছাড়ব না ।
বনলতা দেবী রুদ্রের রুদ্রমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেলেন । বললেন - ও বাবা! এখানে চেঁচামেচি করবি না । সবাই শুনতে পাচ্ছে ।
- শুনুক । দেখুন মা ! আমি কালই একটা ডায়েরী করব । দেখি পুলিশ তা নেয় কি না ।
- সে তুই কাল যা করার করিস। এখানে আর অশান্তি বাড়িয়ে তুলিস না ।
আরণ্যক সব শুনলেন । রুদ্রকে ছেড়ে তখনই ধরলেন বিধাননগর কমিশনারেটের এসি মি: সালভেকে। সব জানিয়ে দিলেন । সালভে তাঁকে নিশ্চিন্তে থাকতে বলে বিধাননগর থানার ওসিকে নির্দেশ দিলেন যথাযথ ব্যবস্থা নেবার ।
( ক্রমশ )
