ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব ষাট
সাগর সৈকত দত্ত নামে যে ছেলেটিকে আরণ্যক বসুরায় নিযুক্ত করেছিলেন সে উপস্থিত হল কলেজ স্ট্রীট থানায়। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল - আমি সাগর স্যার।
সাগরের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে মিঃ পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য বললেন - হুমম্ । মিঃ বসুরায়ের সাগরেদ ।
প্রথমটায় খুব ভয় পেয়ে গেল সাগর ।
বলল - স্যার, আমার একটা ওষুধের দোকান আছে। আরণ্যক স্যার ডেকে পাঠালেন ; বললেন এখানে আপনার সঙ্গে দেখা করতে তাই এসেছি ।
- বেশ করেছ। এবার বল দেখি মিঃ আরণ্যক বসুরায় এখন কোথায় ?
- তাই তো স্যার ! তাঁরও তো আসার কথা ছিল । আসেননি ?
- জানি না। আসবেন কি না । ঠিক আছে একটু অপেক্ষা কর । উনি এসে পড়লে তখন তোমায় ডাকব ।
সকাল থেকে দানাপানি পড়েনি সাগরের । এখন দুপুর হতে চলল । ক্ষিধেয় পেটে ইঁদুরে ডন দিচ্ছে। বলল - স্যার , খুব ক্ষিধে পেয়েছে। সেই জলপাইগুড়ি থেকে আসছি তো ! কিছু খেয়ে আসব ?
পরমেশ্বর বললেন - ও তাই বুঝি ? ওই ঘরের ভেতরে অপেক্ষা কর দশ মিনিট; রেডিমেড খাবার পেয়ে যাবে ।
আগেও বলেছি সাগর একটু ভীতু প্রকৃতির । পরমেশ্বরের কথায় বেশ ভয় পেয়ে গেল । যতই হোক, পুলিশ বলে কথা। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা ; কিন্তু পুলিশে ছুঁলে?
আঙুল গুনতে লাগল সাগর । হিসেব আর মেলে না ।
পরমেশ্বর বললেন - কি হল ? দাঁড়িয়ে রইলে কেন ? বললাম তো ওই ঘরে গিয়ে বস ; খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হবে ।
সাগর বুঝে নিল কপালে কি আছে ! কেন যে মরতে স্যারের কথা শুনতে গেলাম । এর চেয়ে অরবিন্দের কথায় রাজী হলে ভালো হোত ।
সাগর বসে আছে । স্যারের আসার নাম নেই । পকেট থেকে ফোন বের করে আরণ্যককে ডায়াল করল । দ্য পার্সন য়ূ আর কলিং হ্যাজ আইদার সুইচড অফ অর আউট অফ রিচ ।
এমন সময় একজন কনস্টেবল এসে ভাত, ডাল, সব্জি আর চিকেন দিয়ে গেল ।
- কপাল ভালো তোমার । আজকের মেনু এইটে। খেয়ে নাও ।
পকেট থেকে একটা কড়কড়ে পাঁচশ টাকার নোট বের করে কনস্টেবলকে দিতে গেল ।
- এটা রাখুন । আর বলে দিন কোন পথে বেরিয়ে যাব ?
- কি বলছ হে ছোকরা ! কাকে কি বলতে হয় শেখোনি ?
রেখে দাও তোমার পাঁচশ। সাহেব দেখতে পেলে চাকরিটাই যাবে ।
সাগর খেতে খেতে বলল - ওহ্ কম পড়ল বুঝি ! আচ্ছা আরও পাঁচশ দিচ্ছি ।
কনস্টেবল তখনও বলে চলেছে - কর কি হে ছোকরা ! সাহেব জানতে পারলে তোমাকেও আস্ত রাখবে না ।
সাগর বিরক্ত হয়ে ওকে কাছে ডাকল । কানে কানে বলল - রাখ তো তোমার সাহেব । আরও হাজার দিচ্ছি ছেড়ে দাও ।
দু হাজার পেয়ে কনস্টেবলের শুকনো মুখ থেকে দাঁতগুলো সব বেরিয়ে গেল । সাহেবের দিকে চেয়ে দুহাছার পকেটস্থ করল । তারপর বলল - ধীরে সুস্থে খেয়ে নাও । তারপর এসে তোমাকে নিয়ে যাব ।
সাগর খুশি হয়ে বলল - এই আমি খেয়ে নিচ্ছি ।
সে চলে গেল । পরমেশ্বর এসে ঘরে ঢুকল ।
- পেট ভরেছে তো ?
- হ্যাঁ স্যার । বলে লম্বা ঢেকুর তুলল । হাতমুখ ধুয়ে সাহেবকে বলল - স্যার আসেননি ?
পরমেশ্বর বললেন - আসবে না । আর তুইও যেতে পারবি না । এখানে এই শ্রীঘরে বন্ধ থাক । স্কাউণ্ড্রেল !
সাগর হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারল না । পরমেশ্বর ওকে তালা বন্ধ রেখে দিলেন । সাগরের যন্ত্রণাময় জীবনের শুরু হল ।
ঘন্টা দুই পরে পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য তিনজন পুলিশ নিয়ে ঢুকলেন হাজতে ।
সাগরের তখন পালপিটেশন শুরু হয়েছে । তেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সাগরের সামনে এসে বললেন - বল তো মাণিক ! মিঃ বসুরায় কেন এলেন না ?
- স্যার আমাকে তো এখানে আসতে বললেন । আরও বললেন একটু পরে আমি আসছি অফিসারের সামনেই তোমাকে ব্যাগটা দেব । নইলে তুমি যদি পালিয়ে যাও !
- ব্যাগে কি টাকা ছিল ।
- তা তো জানি না স্যার । বললেন ওই ব্যাগটা ভীমগড়ে বলে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে ।
- কেন ?
- অরবিন্দ নামের কেউ আসবে তাকে ব্যাগটা দিলে ওনার চুরি হওয়া বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা অরবিন্দ আমার হাতে দেবে ; আমি যেন সেটা নিয়ে আসি ।
- পাণ্ডুলিপি ?
- তাই তো বলেছেন ।
- ওনার যে পাণ্ডুলিপি চুরি গেছে তার কি প্রমাণ আছে ?
- স্যার, আমি খেটে খাওয়া মানুষ। অতশত বুঝি না। পৌঁছে দিলে মোটা টাকা বকশিস দেবেন বলেছিলেন। সেই লোভে--
- তা, মিঃ বসুরায়, তোমাকেই ডেকে পাঠালেন জলপাইগুড়ি থেকে ? কলকাতায় কাউকে পেলেন না ? লগতা হ্যায় ডাল মে কুছ কালা হ্যায় । ত্রিলোচন !
গম্ভীর কন্ঠে ডাকলেন । কালো কুচকুচে হোৎকা চেহারার মোটা গোঁফওয়ালা কনস্টেবল ত্রিলোচন কে দেখে সাগরের আত্মারাম তো খাঁচা ছাড়া ।
ত্রিলোচন বলল - ফরমাইয়ে সাব ।
- এই লোকটার জামা প্যান্ট আণ্ডার উইয়ার সব খুলে ফেল । আর টেবিলের উপরে ছাগল খাঁসি করার সাঁড়াশিটা রেখে এসেছি ; ওটা নিয়ে এস ।
- জী সাব ।
ত্রিলোচন সাঁড়াশি নিয়ে এল । পরমেশ্বরের হাতে দিয়ে সাগরের জামা গেঞ্জি খুলতে শুরু করল ।
পরমেশ্বর বললেন - কি কর ত্রিলোচন ? জামা খুলতে হবে না । শুধু প্যান্ট আর জাঙ্গিয়া খুলে দাও।
ত্রিলোচন জামা ছেড়ে প্যান্টের হুকে হাত দিতেই সাগর কেঁদে কেঁদে বলল - স্যার, প্লীজ এমন করবেন না । আমার লজ্জা পাচ্ছে ।
পরমেশ্বর বললেন - লজ্জা তোর আছে শুয়োরের বাচ্চা?
বল , অরবিন্দ সরখেল আর আরণ্যক বসুরায়ের সঙ্গে কি ভাবে পরিচয় হল ? ওরা কি করত ?
সাগর বলল - সব বলে দেব স্যার । যা কিছু বলবেন সব সত্যি বলব।
- হুমম। বল তবে !
- স্যার অরবিন্দ সরখেল আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আর স্যার ছিলেন আমাদের স্কুলের শিক্ষক।
- ওগুলো শুনতে চাই না । কি কি দুষ্কর্ম ওদের সহযোগীতায় করেছিস আগে তাই বল । নইলে জানিস তো ! হাতের বস্তুটা কি বল তো ?
সাগর চটপট উত্তর দিল - সাঁড়াশি স্যার ।
- এটা দিয়ে গাঁয়ের লোকেরা কি করে জানিস ?
- আজ্ঞে কাঠে পোঁতা পেরেক তোলে ।
- উঁহু । পরমেশ্বর বললেন - সে তো ছুতোর মিস্ত্রিরা করে ; আর কি করে জানিস - পাঁঠা ছাগলকে এটা দিয়ে খাঁসি বানায় । আমি কি করি জানিস ? রেপিস্টদের খাঁসি করি ; যাতে কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়ে আর রেপ করতে না পারে । যাক্ ত্রিলোচন প্যান্টটা তো খুলেছ এবার জাঙিয়াটা নামিয়ে দাও ।
সাগর হাঁউমাও করে কাঁদতে লাগল ।
পরমেশ্বর ধমক দিলেন - কেঁদে কোন লাভ নেই মাণিক । যার পাল্লায় পড়েছ, সে যে কত ভয়ানক দেখতে পাবে।
- স্যার স্যার আমি সব বলছি। বলুন কি কি জানতে চান ?
- সব জানতে চাই - তোর জন্ম থেকে হাজতে ঢোকা পর্য্যন্ত সব । নইলে কিন্তু বিচি দু'টো গুঁড়ো করে দেব ।
- দিন সাল আমার কিছুই মনে পড়ছে না । একদিন আরণ্যক স্যার এলেন আমাদের বাড়িতে । মাকে বললেন তোমার ছেলে তো একটা জুয়েল । শুধু শুধু লেখাপড়া শিখিয়ে আর একটা বেকার তৈরি করবে না কি টাকাকড়ির মুখ দেখবে ? মা বলল - চাকরি পাওয়া কি সোজা সাহেব ? তবে আপনি যদি দয়া করেন তো ওকে আপনার হাতেই তুলে দিলাম ।
হয়ে গেলাম আরণ্যকের মাইনে দেওয়া কর্মী । মাসিক তিন হাজারে তিনি আমায় কিনে নিলেন । তখন জলপাইগুড়ি শহরে একটা ঝুপড়িতে থাকতাম ।
বাধা দিয়ে পরমেশ্বর বললেন - কি কাজ দিয়েছিল তোর আরণ্যক স্যার ?
মুখ নামিয়ে সাগর বলল - মিঃ বসুরায়ের একটা বড় দোষ ছিল । তা হল মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ । আমার কাজ হল কোন মেয়েকে কিডন্যাপ করে তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া । সপ্তাহে দু'একজনকে তুলে এনেছি স্যার । তবু তার আশ মেটেনি। একদিন বাড়ি ফিরে দেখি আমার মায়ের সঙ্গে ---
সাগর একটু চুপ করে গেল । তারপর বলল - সেই থেকে মা এবং তার উপর আমার আক্রোশ জমল । মাকে তো কিছুতেই সহ্য করতে পারতাম না । দিলাম একদিন টাসিয়ে । তারপর স্যারের কথায় আশ্রম নিলাম গরুমারা জঙ্গলে । স্যার বললেন নতুন ব্যবসায় ঢুকে পড় । কামাল, বশীর, জামির, জাহির, জাহিরুল - এরা যা করে তুই ওদের দলে ভীড়ে যা। নিরাপদে থাকবি আবার টাকাও রোজগার করবি । স্যার ওদের কাজ ছিল বুনো পশুদের পাচার করা, হরিণ, গণ্ডার, সাপ মেরে খড়্গ, চামড়া ইত্যাদি পাচার করি । আর মোটা রোজগার হয় ।
একদিন অরবিন্দের বাবা অনন্তমোহন সরখেল রেঞ্জার অফিসে চাকরি করতেন বলে ওর ছেলেকে জঙ্গল দেখাতে এনেছিল । আমাদের সবাইকে হাতেনাতে ধরল। তখন আরণ্যক স্যারও ছিলেন আমাদের সামনে । তিনি এগিয়ে এসে অনন্তমোহনকে বললেন - হ্যালো মিঃ --
আপনি তো শুনেছি লেখালেখি করেন !
- আজ্ঞে হ্যাঁ - ওই এক আধটু লিখি।
- হাতে ওটা কি ? ডায়েরী ?
- না স্যার । এটা আমার একটা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি।
- কি শিরোনাম দিলেন উপন্যাসের ?
- আজ্ঞে কেউটের ছোবল ।
- দুর্দান্ত। বুঝে নিলাম নামে । দারুন উপন্যাস হবে। তা একটু দেখব কি কেমন আপনার সাহিত্য জ্ঞান । যদি পছন্দ হয়ে যায় আমি ছাপিয়ে দেব। আমার একটা প্রকাশনা সংস্থা আছে কোলকাতার কলেজ স্ট্রীটে।
অনন্তমোহনের দুই চোখ কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল । মনে হল যেন তিনি চাঁদে হাত দিয়েছেন ।
পাণ্ডুলিপির কয়েকটা পাতা পড়ে স্যার বললেন - কলেজ স্ট্রীটে আসুন একদিন। রয়্যালটি নিয়ে কথা বলব । এই জামির এই ভদ্রলোককে কিছু টাকা দিয়ে দে ।
জামির ওনাকে বেশ কিছু টাকা গছিয়ে দিলেন । এমন সময় ওর ছেলে অরবিন্দ চেঁচিয়ে উঠল - ওকে তোমরা মারছ কেন ? ও তো একটা পশু!
অনন্তমোহন ছেলেকে বুঝিয়ে কাছে চলে এলেন। বললেন - ওকে বুঝিয়ে দেব। তোমরা তোমাদের কাজ কর ।
তিনি ছেলের কাছে যাওয়ার আগেই আমাদেরআমাকে নির্দেশ দিলেন ছেলের হাতে রাখা বইটা ছিনিয়ে আনতে। জামির তখন পিস্তল উঁচিয়ে ধরেছে । আমি অরবিন্দকে সরিয়ে না দিলে সেদিন গুলিটা ওর মাথায় লাগত ।
ওরা বাপ বেটা মোটামুটি নিরাপদেই চলে গেল । তার পরের দিনই শুনলাম অনন্তমোহন খুন হয়েছেন । আমি ওদের বাড়িতে গেলাম । বন্ধুত্ব করলাম অরবিন্দের সাথে। একদিন সেও আমাদের দলে ভীড়ে গেল ।
- অরবিন্দের মা থানায় যাননি ?
- কি জানি স্যার । কেসটার কোন গতি আজ পর্য্যন্ত হয়নি।
পরমেশ্বর বললেন - এবার হবে । তুই বলে যা ।
( ক্রমশ )
