ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব পঁয়তাল্লিশ
সন্তু মুখার্জীকে যে জন্য জন্তু বলে লোকে তার উদাহরণ নিজের চোখে দেখে নিলেন সাহিত্যিক আরণ্যক বসুরায়।
অভয়ঙ্কর বাবুকে বললেন - জানেন বেয়াই মশাই ! আজ আমার জীবনের একটা বড় ফাঁড়া কেটে গেল ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - ওই লোকটার সঙ্গে আপনার শত্রুতা হল কি ভাবে ?
- কোন শত্রুতা সরাসরি আমার সঙ্গে নেই বেয়াই। যাকে আপনারা থানায় ধরে এনেছিলেন সেই অরবিন্দ সরখেল যে এমন খিলাড়ি ভাবলে শিউরে উঠতে হয় । ও তো পুলিশের খপ্পর থেকে পালিয়েছে ; হয়তো হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ।
- বেয়াই মশাই ! আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না । সব কেমন হেঁয়ালি মনে হচ্ছে । একটু খুলে বলুন তো দেখি !
আরণ্যক বসুরায় আরম্ভ করলেন বলতে ।
আমার স্ত্রী কনক যেদিন মারা গেল পথ দুর্ঘটনায় ; আমি তখন রোগশয্যায় । পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছি । নড়াচড়ার শক্তি নেই । ওষুধ শেষ হয়ে গেছল । কনক বলল সে ওষুধ আনতে চলল । খোলা জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম কনক আনমনে রাস্তা পার হচ্ছে । দূরে একটা গাড়ি - ট্রাকের মত ভারি যান ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছে ।
- তারপর ?
- অন্য দিক থেকে একটি ছেলেও রাস্তা পেরোচ্ছে । কনকের মুখোমুখি হতেই কনক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসছিল । ছেলেটি তাঁকে ধরতে গেল। ইতিমধ্যে ট্রাকটা এসে পড়েছে । কনক এমন ভাবে পিছোচ্ছিল ; অনায়াসেই সরে যেতে পারত । অবাক হলাম ছেলেটি কনককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পালিয়ে গেল । কনক গাড়ি চাপা পড়ল। স্পট ডেথ।
আমি শিউরে উঠলাম । দেখি ছেলেটি দৌড়ে পালিয়ে গেল ।
- ছেলেটাকে কেউ ধরতে পারল না ?
- দুপুর রোদে রাস্তা ফাঁকা ছিল । ছেলেটি পালিয়ে এল আমারই বাড়িতে । আমাকে বলল সে আমার বউকে মেরে ফেলেছে। বলে রাস্তার দিকে আঙুল তুলে দেখাতে লাগল । আমি চোখদুটো ঘুরাতে পারতাম ; অন্য অঙ্গ অসাড়। মুখেও কথা বেরোয় না ।
ছেলেটি বলল - আলমারির চাবি দাও । তারপর আমার দশা দেখে হেসে উঠল । নিজেই চাবি খুঁজে বের করে টাকাকড়ি গয়নাগাটি যা ছিল একটা থলেতে ভরে নিয়ে চলে গেল । পথের উপরেই মেডিশিন শপ । কনক বলেছিল যাবে আর আসবে । তাই দরজাটা ভেজিয়ে চলে গেছল ।
- তারপর ?
- সন্ধ্যের দিকে ছেলেটি আবার এল। তখন কি অমায়িক ব্যবহার ! আমার শুশ্রূষা শুরু করল । ততক্ষণে রুদ্র আর বনলতাদি এসে পড়েছে । দিদি একটা উটকো লোক দেখে চঞ্চল হয়ে পড়লেন । রুদ্রকে বললেন কিছু একটা করতে । রুদ্রর সঙ্গে ছেলেটির কথাবার্তা হল। আমি শুনতে পেলাম ছেলেটির নাম অরবিন্দ সরখেল।
- ও বুঝেছি । সেই স্কাউণ্ড্রেলটার ছেলে । অনন্তমোহন সরখেল । আমার অফিসে কাজ করত ।
- ওই অনন্তমোহনের জন্যই ছেলেটা বখাটে হয়েছে।
- আপনিও অনন্তকে চেনেন ?
- বিলক্ষণ ! সাগর দিশারী নামে আমার এক আত্মীয়ের ছেলেকে লোভ দেখিয়ে বন্যজন্তু পাচারের কাজে লাগিয়ে দেয় । সাগরও তো এখন পেনশন নিয়ে আমতায় একটা ওষুধের দোকান খুলেছে । তো সেই অনন্তমোহন একদিন আমার কাছে এসে বলে তার কিছু কবিতা ছেপে দিতে হবে। পাণ্ডুলিপি চাইলাম । দিয়েছিল। কিন্তু অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ বেশি ছিল বলে ছাপাইনি। বললাম - পাঁচ হাজার দিতে হবে অগ্রিম বাকি পাঁচ হাজার প্রকাশের পর । দিয়েছিল পাঁচ হাজার । আমার হঠাৎ অসুস্থতার জন্য ছাপানোর কথা ভুলে গেছি। তখন একদিন বাড়িতে এসে টাকা দাবী করতেই কনক ঝাঁঝিয়ে ওঠে। তখন এই অরবিন্দ সরখেল বলে সব সুদেমূলে উসুল করে নেবে।
- এইবার বুঝলাম অরবিন্দ সরখেল কে ?
- ও আমাকে অনেকবারই খুন করতে চেষ্টা করেছিল; ভাগ্যগুনে বেঁচে আছি। তারপর তো ওকে আপনারা পুলিশে দিলেন।
একবার শ্বাস নিয়ে আরণ্যক আবার বললেন - এখন তো সে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। কি জানি কোথায় আছে!
- যেখানেই থাক কিছু করতে পারবে না । আর এখানে তো নয়ই । আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। দেখলেন তো সন্তু মুখার্জীর দক্ষতা ।
আরণ্যক বসুরায় ভাবলেন সত্যিই যদি পরমেশ্বরের পরিবর্তে এই সন্তু মুখার্জী কলেজ স্ট্রীট থানায় থাকতেন তবে অরবিন্দ পালিয়ে যেতে পারত না ।
নাহ্ এবার প্রসঙ্গ বদলাতে হবে। নইলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে । আরণ্যক বললেন - বেয়াই মশাই , চলুন আজ সন্ধ্যায় রাধাকৃষ্ণের আরতি দেখে আসি ; সঙ্গে ওই বোষ্টম ঠাকুরের গানও শোনা যাবে।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - ঠিক আছে । দুপুরটা তো পেরিয়ে যাক ; পড়ন্ত বিকেলে যাব 'খন ।
ললন্তিকা কামালের মর্মান্তিক মৃত্যুতে যতখানি আহত হয়েছে তার চারগুণ ভয় পেয়েছে। মথুরা চণ্ডী মন্দির চত্বরে না ঢুকে , উল্টোদিকের গাছগাছড়ায় ভরা গীতা আশ্রমে ঢুকে পড়ল ।
অরবিন্দ তখন প্রাতরাশ করছিল । দেখতে পেল একটি মেয়ে বকুল গাছের আড়ালে নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে ফেলতে চাইছে । কাল বিলম্ব না করে সে চুপিচুপি ওই গাছের দিকে এগোতে থাকল । ললন্তিকা একবার উঁকি মেরে দেখে নিয়ে আবার নিজেকে আড়াল করে নিল ।
তার পরণের শাড়ি মন্দ হাওয়ায় উড়তে থাকল। ললন্তিকা তা' খেয়াল করেনি । বাগানে জল দেবার অছিলায় অরবিন্দ বকুল গাছের তলায় এসে ইচ্ছে করে চমকে ওঠার ভাণ করল ।
- কে গো মেয়ে ? ওখানে কি করছ ?
ললন্তিকা আড়াল থেকে ফিরে বোষ্টম দেখে ওর পা জড়িয়ে ধরল ।
- আমাকে বাঁচান ঠাকুর । আমি অসহায় হয়ে এখানে ঢুকে পড়েছি ।
- কি হয়েছে তোমার গা ? এত ভয় পাচ্ছ কেন ? এযে রাধামাধবের মন্দির ! চলে এস, কোন ভয় নেই ।
ললন্তিকা উঠে দাঁড়াল। তারপর সেই বোষ্টমের দিকে
চেয়ে রইল ।
অরবিন্দ এক নিমেষে ললন্তিকাকে চিনতে পারল ।
আর ওকে চমকে দিয়ে বলল - ললন! তুমি!
বোষ্টমের কথায় বিস্মিত হয়ে গেল ললন্তিকা। এই চেনা নামে তো অরবিন্দ ওকে ডাকত আদর করে । শুনেছিলাম অরবিন্দ কোথাও পালিয়ে গেছে। ও কি তবে এখানে -- তাই বা কি করে সম্ভব! ওর তো চেনাজানা জায়গা নয় এটা ?
বোষ্টম বলল - শোন ললন্তিকা ! আমি অরবিন্দ। এখানে ছদ্মবেশ ধরে আছি । তোমাকে যে এভাবে ফিরে পাব ; রাধামাধবের ইচ্ছে না হলে তা' কখনোই সম্ভব হোত না ।
ললন্তিকা যেন প্রাণ ফিরে পেল । বলল
- জানো ! কামাল ভাইকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম আরণ্যককে খুঁজতে। পথের মাঝে দিনের আলোয় আরণ্যককে দেখেছি। আর দেখেছি ---
অরবিন্দ ব্যাকুল হয়ে বলল - আর কি দেখেছ ললন্তিকা ?
কামালকে পুলিশ গুলি করে মেরে দিল । আমার মনে হয় এর পিছনে আরণ্যক বসুরায়ের হাত আছে ?
- ললন্তিকা ! আমিও আরণ্যক বসুরায়কে দেখেছি এই মন্দিরে । তবে দিনের আলোয় নয়; সন্ধ্যাদীপের আলোয়। আমার গান শুনে ওনার হয়তো ভালো লেগেছে। তাই খবর নিতে এসেছিলেন । ভাগ্যিস আমার কাছেই খবর নিচ্ছিলেন । আমি বলেছিলাম সন্ধ্যেবেলায় আসতে ; আসেননি। মনে হয় এখানে থাকলে আবার একদিন আসবেন ।
ললন্তিকা বলল - আজ আসে যদি আর ছাড়াছাড়ি নেই। আমার ব্যাগে একটা পিস্তল আছে।
অরবিন্দ বলল - চুপ চুপ । খবর হাওয়ায় ওড়ে । পরে শুনবো সেসব । এখন চল আমার সাথে। মোহান্ত মশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি।
অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে ললন্তিকা অরবিন্দকে অনুসরণ করে চলল ।
ললন্তিকা বলল - তুমি বোষ্টম হতে গেলে কেন ? কেউ তোমাকে সন্দেহ করেনি ?
- সব বলব। এখন আগড়ায় চল । তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে । রাধাগোবিন্দের সামনে তা' দেখাব।
( ক্রমশ )
