ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব একাত্তর
মিঃ অভয়ঙ্কর সরকার - দ্য এক্স-রেঞ্জার অর্থাৎ পটকার কাকাবাবু এবং শ্রীমান প্রশান্তমোহন সরখেল ওরফে অরবিন্দ সরখেল ; গোপালকৃষ্ণ চাকলাদার ও বনলতা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে গীতা আশ্রমে উপস্থিত হলেন সন্ধ্যারতি দেখার জন্য ।
অরবিন্দ আশ্রমের সব স্থান চেনে, জানে , কিন্তু তাঁদের গীতা আশ্রমে না এনে সেই জায়গায় নিয়ে গেল যেখানে আরণ্যককে লক্ষ্য করে ললন্তিকা গুলি ছুঁড়েছিল ।
সেই মুহুর্তে আবার একটি ফোন এল অরবিন্দের ফোনে ।
ওর মনে হয়েছিল রিজেক্ট করে ; কিন্তু অভয়ঙ্করবাবু ঈশারায় ফোন তুলতে নির্দেশ দিলেন।
অরবিন্দ বলল - হ্যাঁ ললন্তিকা বল !
অন্য প্রান্ত থেকে মিঃ সজ্জন সিং উত্তর দিলেন - আপ মিঃ সরখেল হ্যায় কেয়া ?
অরবিন্দ বিনীতভাবে বলল - জী বোলিয়ে। য়ে তো ললন্তিকা সেনকি নাম্বার হ্যায় ! আপ কৌন বোল রহা হ্যায় স্যার ?
সজ্জন সিং অল্প হেসে গল্প ফাঁদলেন ।
- ম্যায় ডেলহি পুলিশ ক্রাইম ব্রাঞ্চ সে বোলতা হুঁ।
আশ্চর্য্যের বিষয় অরবিন্দের কোন বিকৃতি লক্ষ্য করা গেল না । কি জানি হয়তো ভেবে বসে আছে অভয়ঙ্করবাবু নিশ্চয় কিছু ব্যবস্থা করবেন ।
বলল - সো তো সমঝা স্যার ! লেকিন ললন্তিকা অগলবগলমে হ্যায় কেয়া ?
- য়ে লো বাত করো । বলে হাসতে হাসতে সজ্জন সিং ললন্তিকাকে ফোন ধরিয়ে দিলেন ।
ললন্তিকা ! অরবিন্দ সরখেলের পিসতুতো বোন ; তার প্রথম প্রেম ; তার প্রাক্তন পত্নী । ললন্তিকা ব্যভিচারিণী! অসংযমী নারী মাত্র । আরণ্যক বসুরায়ের রক্ষিতা । তবু অরবিন্দ তাকে ফিরিয়ে দেয়নি। স্বীকার করে নিয়েছিল তার বৈবাহিক সম্পর্ক ।
গীতা আশ্রমে রাধাকৃষ্ণের সম্মুখে পুনরায় কন্ঠীবদল করেছিল অরবিন্দ। তথাপি তাকে ছেড়ে সেই দুর্বৃত্ত আরণ্যকের সঙ্গেই পালিয়েছিল । সেই ললন্তিকা এখন ফোনের অন্য প্রান্তে ।
ভাবছিল অরবিন্দ মুখে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে মুখটা হয়তো বদলে দিয়েছে কিন্তু কন্ঠস্বর ! তাও কি এখন বদলে গেছে নাকি !
- বল ললন্তিকা !
অরবিন্দই প্রথমে কথা বলল । শারীরিক খোঁজ খবর নেবার পর বলল - তোমাকে ফোন করতে নিষেধ করেছিলাম; তবু কেন ফোন করলে ?
ললন্তিকারও আজ অরবিন্দের প্রতি কোন ক্ষোভ বা অভিমান নেই । সে এখন ধনী পাঞ্জাবী পরিবারের গৃহবধূ। স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন এখন তার ।
প্রথমে ভেবেছিল একটু অহংকার দেখাবে । নিজের ভাগ্যকে বদলে ফেলার কথা বলবে । হয়তো ভেবেছিল অরবিন্দকে বলে 'পথের কুকুর পথেই মরে ' ।
কিন্তু সজ্জনের মুখের দিকে চেয়ে , তার মর্য্যাদার কথা ভেবে বলতে পারল না । কোনমতে বলল - তোমাকে একটা সুখবর দিতে চাই !
অরবিন্দ নির্লিপ্ত ভাবে বলল - বল ।
- আমি সন্তানের মা হতে চলেছি ।
অরবিন্দ কোন উত্তর দিল না ।
ললন্তিকা বলল - এইমাত্র হসপিটাল থেকে কনফার্ম করল।
তবু অরবিন্দ এ নিয়ে কিছু বলল না ।
ললন্তিকা বলল - কি হল ? চুপ করে রইলে যে !
- বলবে তো তুমি । আমি নয় । সেজন্যই তো ফোন করেছ?
অরবিন্দ নির্বিকার চিত্তে কথাগুলো বলল ।
ললন্তিকার অভিমান হল ।
- তুমি খুশি হওনি ?
- আমার খুশিতে তোমার কি আসে যায় ? নাও , আর কিছু বলবে কি ? নইলে ক্রাইম ব্রাঞ্চের অফিসারকে ফোন দাও।
ললন্তিকা এবার হেসে ফেলল। ক্রাইম ব্রাঞ্চ শুনে অরবিন্দ চমকে গেছে ! বলল - ভয় নেই । উনি পুলিশের লোক না । উনি আমার বর্তমান স্বামী । ভীষণ ভালো লোক বুঝলে ! আমার কত যত্ন-আত্তি করছেন ।
- বেশ বেশ । মেলা ঘাটিও না তে ! রাখছি।
বলে অরবিন্দ ফোন কেটে দিল ।
অভয়ঙ্করবাবু প্রশ্ন করলেন - এতক্ষণ কার সাথে কথা হল ?
- ললন্তিকা সেন ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - আরে সেই মেয়েটা ! মিঃ দেবেন্দ্র ভৌমিকের বাড়ি থেকে যে পালিয়ে এসেছে !
অবাক হয়ে অরবিন্দ বলল - দেবেন্দ্র ভৌমিক ! এই নাম তো শুনিনি স্যার ! উনি কি পুলিশ ?
- ছিলেন একদা । এখন আমার মত রিটায়ার্ড জীবন উপভোগ করছেন । তা' তুমি ওকে এভাবে ছেড়ে দিলে কেন ? নাও নাও ধর ওকে। কিছু কথা জানার আছে।
অরবিন্দ সুবোধ বালকের মত ললন্তিকাকে ফোন করল।
ফোন তুলে ললন্তিকা বলল - রাগ ভাঙল শেষে ?
অরবিন্দ বলল - স্যার একটু কথা বলবেন। এই নিন স্যার। ললন্তিকা সেন ।
অভয়ঙ্করবাবু ফোন হাতে নিলেন। বললেন - এই যে মেয়ে; আমার বেয়াইকে তুমি অসম্মান কর কোন সাহসে ?
ললন্তিকা বলল - কে আপনি ?
- আমি অভয়ঙ্কর সরকার। এক্স রেঞ্জার । তুমি ললন্তিকা সেন তো ?
- হ্যাঁ বলছি বলুন ।
- মিঃ দেবেন্দ্র ভৌমিককে চেন ?
ললন্তিকার মনে পড়ে গেল। সুন্দর সুঠাম দেহের পুলিশ অফিসার । বাংলাদেশে ওনার বাড়িতেই তো ছিল কিছুদিন।
বলল - চিনি ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - না না চিনি নয় , চিনি নয়, তিনি এক্কেবারে ঝাল ধানীলঙ্কা ।
বলে হাসলেন ।
- তুমি ওখান থেকে পালিয়ে আবার ভারতে চলে এসেছ।জানতে পারলে তোমাকে ছেড়ে দিতেন না ঠিকই ; তবু তাঁর আতিথ্যে যে ক'টা দিন ওখানে ছিলে , ফিরে এসে ওনাকে খবরটা দিলেই পারতে । জানো! উনি এখনও তোমায় নিয়ে ভাবেন । বলছিলেন 'আহা, মেয়েটা যদি দুষ্টু লোকের পাল্লায় পড়ে নির্ঘাৎ মরবে ' !
- চোর পুলিশ খেলা কি এভাবে চলে স্যার ! আমি ওঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই । কিন্তু তার জন্য শুধু শুধু পেছনে বাঁশ নেব ভাবলেন কি ভাবে ?
- হুমম। খুব চতুর মেয়ে তুমি। আচ্ছা , তুমি যেখানে আছো থাকো ; ভালো থাকলে আমারও ভালো লাগবে।
ললন্তিকা বলল - ধন্যবাদ।
- উঁহু , শুকনো ধন্যবাদ দিলে হবে না। সুখবর দিয়েছ মিষ্টি পাঠিয়ে দিও এক হাঁড়ি।
তারপর ফোনের উভয় প্রান্ত থেকে শুধু হাসির শব্দ উঠল।
অভয়ঙ্করবাবু অরবিন্দকে ফোন দিতে দিতে বললেন - নাও, এবার মন্দিরে চল ।
মোহান্ত মহারাজ ওদের সকলকে দেখলেন ।
' বোষ্টম ঠাকুর না !'
এগিয়ে এসে অরবিন্দকে বললেন - ওহে বোন্টম , এখানেই রয়েছ ; গানের সময় আসছ না! বলি কি ব্যাপার ?
অরবিন্দ বলল - মহারাজ ! মন মেজাজ ভালো নেই । বোষ্টমী আমায় ত্যাগ দিয়ে পালিয়েছে ।
- রাধামাধব ! রাধামাধব ! এ কি শুনছি হে বোষ্টম ? বোষ্টমী গেলেন কোথায় ?
- কি করে জানব মহারাজ ? আমাকে কি বলে গিয়েছে কার সঙ্গে কোথায় পালিয়েছে ?
- তুমি কেমন আছো বোষ্টম ? তুমি যাবার পর পুলিশ আবারও দু'বার এসেছিল তল্লাশি নিতে। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না ; আশ্রমে এত উৎপাতের উপদ্রব হল কেন ?
অভয়ঙ্করবাবু এগিয়ে এসে বললেন - আর পুলিশ আসবে না, মোহান্ত ঠাকুর।
মোহান্ত সবিস্ময়ে দেখলেন রেঞ্জার সাহেব সশরীরে বর্তমান। বললেন
- কি সৌভাগ্য আমার ! আপনি এসেছেন ? এনারা নিশ্চয় আপনার আত্মীয় ? ওহে ছোটো বোষ্টম ! এবার একটা গান ধর হে । শোনাও।
অরবিন্দ সেই বিখ্যাত গানটি গাইতে লাগল - বিদায় দে মা শচীরাণী , আমি সন্ন্যাসেতে যাই ।
আহা ! কি সুর ! কি গান ! আর গলা! সে তো পাতা ঝরানোর যাদু !
সকলে গান শুনে চোখের জল মুছতে মুছতে বিদায় নিলেন । মোহান্ত বললেন - কি শোনালে হে বোষ্টম । আহা! মনে হচ্ছে প্রাণ খুলে বলি - হরি হরি ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - প্রশান্ত !
অরবিন্দ একটু আনমনা ছিল। শুনতে পায়নি । অভয়ঙ্করবাবু আবার বললেন - প্রশান্ত মোহন সরখেল !
অরবিন্দ সভয়ে উপস্থিত মুখগুলো দেখতে লাগল ।
সভয়ে চমকে বলল - কে !
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - আমি । আমি হে ছোকরা। এবার মোহান্ত মহারাজকে তোমার স্বরূপটুকু জানিয়ে দাও ।
করুণ মুখে অরবিন্দ চাইল অভয়ঙ্করবাবুর দিকে।
মোহান্ত বললেন - এ কি কথা ! তুমি তো বোষ্টম - তাই না ?
অরবিন্দ বলল - ছিলাম। এখন প্রশান্ত। প্রশান্ত মোহন সরখেল। সন অফ লেট অনন্ত মোহন সরখেল । একজন ক্রিমিনাল। গা ঢাকা দিয়ে থাকতে আপনার আশ্রয়ে ছিলাম ।
মোহান্ত বললেন - ওহে, তোমরা কে আছো! আমার ফোনটা দাও দেখি। থানায় জানাতে হবে। বাবু বলে দিয়েছেন।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - তার প্রয়োজন হবে না । ও এখন আত্মসমর্পণ করেছে।
( ক্রমশ )
