ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পরব চুরাশি
মিঃ সজ্জন সিং পাঞ্জাবী হলেও বাঙালি রান্না খেতে তাঁর খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। অসুবিধা একটাই। বিয়ার ছাড়া তাঁর ঘুম আসে না । রোজ রাতে দু'পেগ পেটে না পড়লে সারা রাত জেগে কাটাতে হয় ।
ললন্তিকা তা' জানে । কিন্তু এই পরিবার তা' কেমন ভাবে নেবে বা আদৌ নেবে কি না ভেবে সজ্জনকে বোঝানোর চেষ্টা করে । কিন্তু কথায় তো চিঁড়ে ভেজে না। সজ্জন নির্ঘুম রাত কাটান । এ ভাবে দিন দুই পর তিনি মিঃ সরকারকে বলেন - অব মেরে কো জানা চাহিয়ে কিউ কি শোরুম ছোড়কে য়হাঁ রহনা উচিত নেহি হোগা। বেওসা পলট জায়েগা ।
অভয়ঙ্করবাবু বলেন - সে কি করে হয় ? আপনার সংসার রইল এখানে; আপনি চলে গেলে ওরা তো চিন্তায় পড়ে যাবে ।
সজ্জন বললেন - চিন্তা কিস বাত কি ?
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - চিন্তা হবে না ? আরণ্যক বসুরায়ের টার্গেটে রয়েছেন আপনারা । যা শুনেছি তাতে আমারই হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে । আর আপনি ললন্তিকার স্বামী হয়ে তার থেকে রেহাই পাবেন - এটা আমাদের বিশ্বাস করতে বলেন ?
ললন্তিকা বলল - কাকাবাবু ! আপনি ঠিক বলেছেন । আসলে কি জানেন -
- কি মা ?
- কাকাবাবু ! ও তো পাঞ্জাবপ্রদেশের লোক। এখানে পাঞ্জাবি খানা তো পাচ্ছেন না; বিশেষ করে বিয়ার-
বিয়ার ছাড়া ওনার রাতে ঘুম হয় না । হি টেকস বিয়ার এভরিডে এট নাইট ওয়ানস ওনলি । কিন্তু আপনারা কি ভাববেন সে জন্য ---
- ওওও এই ব্যাপার ! কোন অসুবিধা নেই। আমি নিজে এর বন্দোবস্ত করে দেব ।কোন ব্র্যাণ্ডের বিয়ার খান বললেই এনে দেওয়া হবে ।
বনলতা এবং রুক্মিণী দেবী উভয়ে ফোঁস করে উঠলেন - মা গো মা! এটা তো জানা ছিল না ! সত্যিই তো ওনাদের ঐই অভ্যাস চিরকালীন। ঠিক আছে বাবা, তুমি তাহলে এসো অফিস সামলাও।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - কিন্তু ওনার প্রাণ সংশয় আছে আপনারা বুঝতে পারছেন ? আরণ্যক এখন মরীয়া হয়ে আছে। যে কোন সময় অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারে ।
ওঁরা চুপ করে গেলেন। অভয়ঙ্করবাবু বললেন - কম সে কম পঁদরহ বিশ দিন তো রহনা হি পড়েগা। উসকে বাদ পতা লগাকে দেখুঙ্গা হালচাল কেয়া হ্যায় : তব শোচুঙ্গা যানা ঠিক হোগা কি নেহি ।
সজ্জন বললেন - লেকিন মেরা বেওসা।
- লেট ইট গো টু হেইল । পহলে জান বাদ মে বেওসা।
সজ্জন অভয়ঙ্করবাবুর কথা কাটতে পারলেন না। থেকে যাবার মনস্থ করলেন ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - কল সে আপকা পাঞ্জাবি খানা মিল যায়েগা। উই আর সরি, উই সুড থিঙ্ক এবাউট ইট।
পরদিন বাজার যাবার পথে ' শের-ই-পাঞ্জাব' হোটেলে কথা বলে নিলেন । খাবার এবং পানীয় উভয়ই সাপ্লাই দিতে হবে । কিন্তু তিনি নিজে বা বাড়ির কেউ যেয়ে খাবার নিয়ে আসবে ।
বাজারে এসে লাড্ডুর কাছে শাক-সবজি নেবার সময় বললেন - ওহে ছোকরা ! তোমাদের অণ্ডালে পাঞ্জাবি খাবার রান্না করার লোক পাওয়া যাবে ?
লাড্ডু প্রথমে কিছু ভেবে নিল । পরে বলল - স্যার , যদি কিছু মনে না করেন, জিজ্ঞেস করতে পারি ?
- বল।
- আপনাদের কি পাঞ্জাবী আত্মীয়ও আছেন নাকি ?
- আত্মীয় ঠিক নয়; তবে অতিথি বলতে পারো। আছে কেউ? কিছুদিন রান্না করে দিবে ?
- স্যার, রাতে আমি শের-ই-পাঞ্জাবের অণ্ডাল শাখায় রাঁধুনির কাজ করি । যদি বলেন তো একটা চান্স দিয়ে দেখতে পারেন ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - কাল বলব ।
লাড্ডু খুশি হল । পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে সে ।
পরিচিত হলেও যেহেতু সে অজানা; অভয়ঙ্করবাবু পরের দিন লাড্ডুকে বললেন - চল আমার সঙ্গে ।
লাড্ডু তো খুশিতে বিহ্বল । পিছু পিছু চলতে লাগল । থানার সামনে এসে ওকে বললেন - তোমার কোন আইডেন্টিটি কার্ড আছে ?
লাড্ডু আইডেন্টিটি কার্ড নাম শুনে বলল - ও তো ঘরে রেখে এসেছি ।
- ঠিক আছে । চল, পুলিশ ভেরিফিকেশন করে নিই। বুঝতেই তো পারছ পার্মানেন্ট চাকরি বলে কথা ।
লাড্ডু ভয় পেয়ে বলল - পুলিশ কেন স্যার । আমি গরীব।
এই গরীবিই তো আমার পরিচয় ।
- এসই না। আমি আছি। ভয় কিসের ?
ওঁরা থানায় এসে ঢুকলেন ।
- আবার কাকে এনেছেন রেঞ্জার সাহেব ? মিঃ গুপ্ত বললেন।
- এই লোকটি পাঞ্জাবি খানা বানাতে জানে বলছে। একে কি রান্নার কাজে নেওয়া যাবে ?
অভয়ঙ্করবাবু লোকটির বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য বললেন যাতে তার বিশ্বাস হয় সত্যিই তাকে রান্নার কাজে লাগাবেন ।
মিঃ গুপ্ত বললেন - তুমি রান্না করতে জানো ?
লাড্ডু বলল - হাঁ স্যার । আমি অণ্ডালে পাঞ্জাবী হোটেলে রান্না করেছি ।
- হোটেল মালিকের ফোন দাও কথা বলি ।
লাড্ডু পড়ল ফাঁপরে। একটু বেশী চালাকি করে চরণজিৎ সিং মানে তার দাদার নাম্বারটা দিয়ে বলল- ওর নাম চরণজিৎ সিং। শুধিয়ে নিন।
- অণ্ডালে কোথায় তার হোটেল ?
- একেবারে বাসস্ট্যাণ্ডে ।
সন্দেহ হবার মত কিছু ছিল না । তবু পুলিশ তো । বললেন - চল , হোটেলটা দেখে আসি। ওখানেই সব কথা হবে ।
লাড্ডুর মাথাটা লাট্টুর মত ঘুরে গেল । মিঃ গুপ্ত বললেন - রেঞ্জার সাহেব আমি ছোটবাবুকে এর সঙ্গে পাঠাচ্ছি। ভেরিফিকেশন হয়ে গেলে আপনাকে বলব ।
সেই থেকে লাড্ডুর জায়গা হল পুলিশ চৌকিতে । পঞ্চাশ হাজারের স্বপ্নটা হঠাৎ দু:স্বপ্ন হয়ে গেল ।
অণ্ডালে এ ধরণের কোন হোটেল না পেয়ে ছোটবাবুর তো সন্দেহ হল । তিনি ওকে বললেন - বাড়ি কোথায় তোর ?
- আজ্ঞে অণ্ডালের এক ঝুপড়িতে। রেল লাইনের ধারে থাকি। রোজ রাণীগঞ্জে যাই সবজি বেচতে।
- শুনেছি তুই নাকি শিক সবজি চাষও করিস। কোথায় তোর চাষ দেখে আসি। এসেই যখন পড়েছি।
রেল লাইনের ধারে কিছু কিছু সবজি চাষ হয় রেলেরই জায়গাতে । লাড্ডু তাঁদের সেখানে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে দেখাল - ওই যে দেখছেন ফুলকপি, বাঁধাকপির চাষ - ওইটে আমি লাগিয়েছি।
বাঁধা কপিগুলো সবে পাতা মুড়তে শুরু করেছে । তবে ফুলকপিগুলো বেশ বেড়ে উঠেছে।
ছোটবাবু বললেন - যা তো দু'চারটে ফুলকপি উপড়ে নিয়ে আয় । রান্না করে খাব।
বাধ্য ছেলেটির মত লাড্ডু মাঠের ভেতর থেকে ফুলকপি তুলতে গেল । তা' দেখে ঝুপড়িতে থাকা লোকজন হা রে রে করে তেড়ে এল । লাড্ডুকে ধরে খানিক উত্তম মধ্যম দিয়ে পুলিশের দলকে বলল - আপনারা পুলিশ হয়ে চুরি করাচ্ছেন ?
ছোটবাবু এই আশঙ্কাই করেছিলেন । তিনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন লাড্ডু পুরোপুরি মিথ্যে কথা বলছে। জনতাকে বললেন - লোকটা একটা আসামী। তা প্রমানের জন্য ওকে এখানে এনেছি। তোমরা কেউ একে চেন ? ও তো বলছে এখানেই একটা ঝুপড়িতে ও থাকে !
জনতা সবস্বরে বলল - সব মিথ্যে কথা। ওকে আমরা কখনও দেখিনি। কি রে তোরা কেউ দেখেছিস ?
একযোগে সবাই বলল - না ।
তারপর লাড্ডুকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ থানায় ফিরে এল । আর যে দু' চারটে ফুলকপি লাড্ডু তুলেছিল তার দাম মিটিয়ে দিলেন
এবার লাড্ডু পড়ল মিঃ গুপ্তের পাল্লায় । হাজতে ঢুকিয়ে বেদম প্রহার করলেন । ওর মোবাইল কেড়ে নিয়ে বললেন - নাম কি তোর ?
- আজ্ঞে লাড্ডু সিং।
- ওটা ছাড়া আর কি কি নাম ধরিস ?
মারের বহর এত অসহনীয় ছিল যে লাড্ডু টুকটুক করে বলতে লাগল - আসল নাম গুইরাম গুণ। অফিসের লোকেরা বলে ' গুগুন ' ।
- লাড্ডু সিং নামটা কে দিয়েছে ?
চুপ করে রইল লাড্ডু ।
- ভাস্কর বাবু !
ভাস্কর নামের কনস্টেবল এসে হাজির । সুঁই সুতো নিয়ে আসুন । এটা যখন কথা বলতে চায় না জিভ আর ঠোঁট দুটো সেলাই করে দিন ।
লাড্ডু স্বপ্নেও ভাবেনি এ ধরণের কোন শাস্তির কথা ।
কপালের আসন্ন লিখন বুঝতে পেরে কেঁদে কেঁদে বলল -
স্যার সব বলে দিচ্ছি । আমাকে তো রামে মারলেও মারবে; রাবণে মারলেও মারবে । তাই রামের হাতে মরাই ভাল ।
- বেশ সুন্দর কথা বলতে পারিস তো তুই ?
মিঃ গুপ্ত বললেন - নে এবার বল লাড্ডু সিং নাম কে দিয়েছে ?
- আজ্ঞে, আমার আগেকার কত্তা - আরণ্যক বসুরায়। আমি ওনার প্রেসে ঝাঁট পাট দিতাম । এখানে তিনিই পাঠিয়েছেন সরকার সাহেবের অন্দরমহলের খবরাখবর নিতে । তাই সবজি বেচার নামে তাঁকে খুশি করি। যাতে তাঁর বাড়িতে যেতে পাই। সুযোগ এসেছিল, ভাবলাম কেল্লা ফতে । পঞ্চাশ হাজার ইনাম দেবেন বলেছিলেন আরণ্যক স্যার ।
- সে এখন কোথায় ?
- তা তো জানি না স্যার । ফোনে যোগাযোগ রাখেন ।
- তাই বুঝি ? নে ওকে ফোন কর। বল অপারেশন সাকসেসফুল।
তারপর ছোটবাবুকে বললেন - ভিডিও তৈরি করুন এবং লোকটার লোকেশন ডিটেক্ট করুন ।
লাড্ডু আহাম্মক । কিন্তু আরণ্যক বসুরায় তো তেমনটি নন। লাড্ডুকে যে সিমে ফোন করেছিলেন তা তিনি আর সঙ্গে রাখেন নি । বরফের তলায় চাপা দিয়ে দিয়েছেন ।
নট রিচেবল । অতএব কিছু করার নেই । অভয়ঙ্করবাবুকে জানিয়ে দিলেন - মস্ত ফাঁড়া কেটে গেল আপনাদের । লোকটা আরণ্যকের ভাড়া করা গুণ্ডা ।
অভয়ঙ্করবাবু নিজের বুদ্ধির তারিফ নিজেই করলেন ।
সজ্জন সিং সহ সবাইকে বললেন ঘটনাটা। আর বিশেষ ভাবে সজ্জন সিং কে জানালেন - এখনও কি যেতে চান ? এবার তো সব রাগ গিয়ে পড়বে আপনার উপর ।
সজ্জন সিং মাথা নীচু করে রইলেন । বললেন - সাব, আপলোগোঁকা উপর ইতনা প্রেসার আয়েগা; মুঝে পতাহি নেহি থা । ঠিক হ্যায় , ম্যায় ম্যানেজারকো মেইল কর দেতা হুঁ আফিস সম্ভালনে কে লিয়ে । আই অ্যাম রিয়েলি গ্রেটফুল টু ইয়োর কোঅপারেশনস ।
( ক্রমশ )
