ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব ছিয়ানব্বই
অণ্ডাল এয়ারপোর্টে ললন্তিকাদের বিমান মাটি ছুঁতেই মিঃ ভৌমিক উঠে দাঁড়ালেন। অভয়ঙ্করবাবুও কেমন উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে পড়লেন । আরণ্যকের সময় ঘণিয়ে এসেছে বলেই হোক বা আনন্দের আতিশয্যে - দু'জনের মধ্যেই চঞ্চলতা দেখা গেল ।
সজ্জন সিং মেয়েকে কোলে নিয়ে আর ললন্তিকা ব্যাগেজ টানতে টানতে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
- মেসোমশাই ! কাকাবাবু ! আপনাদের আগে প্রণাম করে নি।
বলে দু'জনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। সজ্জন সিং নমস্কার জানিয়ে মিঃ ভৌমিকের সঙ্গে পরিচয় পর্বটাও সেরে নিলেন ।
হঠাৎ একজনকে পড়ি মরি দৌড়াতে দেখে অভয়ঙ্করবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন - বেয়াই মশাই ! ওই দেখুন অধীর বাবু প্লেনে উঠতে দৌড়াচ্ছেন ।
মিঃ ভৌমিক আরক্ষা বাহিনীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন - পকড়িয়ে উস আদমীকো। ক্রিমিনাল হ্যায় ।
তাদের একজন প্রশ্ন করল - আপ কৌন ?
দেরী না করে মিঃ ভৌমিক নিজের পরিচয় পত্র এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের চিঠি দেখালেন ।
বাহিনীর লোকজন নির্দেশ পেয়ে অধীর বাবুকে পাকড়াও করে নিয়ে এল ।
মিঃ ভৌমিক মিঃ গুপ্তকে ফোনে তক্ষুণই এয়ারপোর্টে আসতে নির্দেশ দিলেন । অভয়ঙ্করবাবুকে বললেন - আপনি এদের বাড়ি নিয়ে যান। আমি থানা ঘুরে একটু পর আসছি ।
অভয়ঙ্করবাবু সজ্জনদের নিয়ে চলে গেলেন । মিঃ ভৌমিক অধীর বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন - আপনি এভাবে দৌড়চ্ছিলেন কেন ? প্লেন ছাড়তে তো এখন অনেক দেরী !
অধীর বাবু বললেন - আমাকে ছেড়ে দিন, আমার স্ত্রী পুত্র প্লেন থেকে নামতে পারেনি।
- আপনিই তো অধীর বাবু ? রাণীগঞ্জ থানার সেকেণ্ড অফিসার?
অধীর বাবু চুপ করে রইলেন। মিনিট পনের পরই পুলিশের গাড়ি এয়ারপোর্টে চলে এল । মিঃ গুপ্ত অধীর বাবুকে হ্যাণ্ডকাপ পরিয়ে দিলেন। তারপর আরক্ষা বাহিনীর হাত থেকে হেফাজতে নিলেন ।
মিঃ ভৌমিক বললেন - জানেন অফিসার, এই আপনার সেকেণ্ড অফিসার পালাচ্ছিলেন । কেন পালাচ্ছিলেন আমি জানি।
- কেন স্যার ?
- ওনার মোবাইল চেক করে দেখুন, আরণ্যক বসুরায় হয় তাঁকে ফোনে কিছু বলেছে নয় তো ম্যাসেজ করেছে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ।
মিঃ গুপ্ত ফোন চেক করে দেখলেন একটি ম্যাসেজ এসেছে নতুন কোন খবর আছে কি না। অধীর বাবু তার উত্তরও দিয়েছেন - ললন্তিকা ল্যাণ্ডেড ।
মিঃ ভৌমিক বললেন - আমার আর কোন জিজ্ঞাস্য নেই। এবার যাবতীয় তথ্য আপনি আদায় করে নেবেন।
থানায় ওদের ছেড়ে দিয়ে পুলিশের জীপ চলল ভৌমিক স্যারকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।
এদিকে বাড়িতে যেন নরক গুলজার। পটকা আজ স্কুলে যায়নি । শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নিয়েছে।
অভয়ঙ্করবাবু ওকে বললেন - এই তুই আজ স্কুলে গেলি না যে !
পটকা বলল - শরীরটা ঠিক নেই ।
- খুব ভালো করেছিস । আজ তোর খাওয়া দাওয়া রেস্ট্রিক্টেড বুঝলি! একটু মুড়ির ঝোল খেয়ে থাকিস। নইলে আবার বাড়াবাড়ি হলে মুশকিলে পড়বি।
পটকা হেসে গড়িয়ে পড়ল ।
- হুঁ! আপনারা ললিপপ খাবেন আর আমি মুড়ির ঝোল চুষব ! আমার কিছুই হয়নি। এঁরা এলেন বলে স্কুলে গেলাম না ।
ওদিকে ললন্তিকাকে পেয়ে বাড়ির মেয়েরা খুব কোলাহল করছেন । রজনী দেবী বললেন - কেমন আছো মা ?
ললন্তিকার এ বাড়িটা আর পর পর মনে হয় না । এঁদের ব্যবহারে এতটাই আপ্লুত হয়ে আছে যে তার মনে হয় এটাই যেন তার বাপের বাড়ি ।
পলা, বিল্টু ললন্তিকার মেয়েকে নিয়ে খুনসুটি করছে। ললন্তিকার জন্য দু'একটা বাংলা শিখে নিয়েছে । তাই দিয়ে সেও ওদের সঙ্গে দারুন ভাবে মিশে গেল ।
সজ্জন সিং এরও আড়ষ্ট ভাব এখন আর নেই । মিঃ ভৌমিকের মত নামজাদা লোককে পেয়ে খুব খুশি। সারাক্ষণই তাঁর পিছু পিছু ঘুরছেন । আর ললন্তিকাকে কেন বিয়ে করেছেন, বিয়ের পরবর্তী জীবন কেমন কাটছে সে নিয়ে গল্প শুরু করেছেন মিঃ ভৌমিক তেমন ভাবে হিন্দি ভাষাটা রপ্ত করতে না পারলেও সব বুঝতে পারছেন ।
লাঞ্চ সেরে খানিক বিশ্রাম নিয়ে অভয়ঙ্করবাবু, ভৌমিক সাহেব, সজ্জন সিং, রুদ্র, পটকা, এবং গোপালকৃষ্ণ বাবু সকলে এক জায়গায় বসে আলোচনা করছেন গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে ।
সব মেয়েরা ললন্তিকাকে ঘিরে গল্পে মশগুল। ললন্তিকা বলল - তাহলে আমরা কবে যাব গঙ্গাসাগর মেলায় ?
শৈল দেবী বললেন - ঠিক জানি না। তবে শুনছিলাম মঙ্গলবারের ফ্লাইটে কলকাতা এবং সেখান থেকে পুলিশের হেলিকপ্টারে চেপে গঙ্গাসাগর ।
ললন্তিকার শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল । সবেতেই পুলিশ কেন ? আমরা তো মজা নিতে যাচ্ছি ।
শৈল দেবী নিজের ভুল বুঝতে পেরে সামলে নিয়ে বললেন - সে তো ঠিকই। কিন্তু বেয়াই মশাই তো আমাদের মত সাধারণ মানুষ না ; বাংলাদেশের প্রাক্তন আই জি, আর শুধু তাই নয়; তিনি যে সরকারি অতিথি। সরকারের আমন্ত্রণে এসেছেন।
ললন্তিকা বলল - তাই তো ! আমি ভুলেই গেছিলাম।
গোপালকৃষ্ণ মিঃ ভৌমিককে বললেন - যা হোক একটা কিছু কর ভায়া । আর এই অশান্তি বয়ে বেড়াতে পারছি না ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - মন্ত্রের সাধন অথবা শরীর পাতন। বুঝলেন বেয়াই মশাই - এবার ইসপার-উসপার - একটা কিছু হবেই ।
- কি করে বুঝলেন ? ভায়ার কথায়?
- বলতেই পারেন । এবার এমন আঁটঘাট বাঁধা হয়েছে যে পাখি কেন ; পিঁপড়েও গলতে পারবে না ।
পটকা বলতে গেল ওদের কোন দায়িত্ব নিতে হবে কি না ।
মিঃ ভৌমিক বললেন - সে পরিস্থিতি বুঝে বলব । তোমরা এত উতলা হয়ো না । আর এই আলোচনা এবার বন্ধ থাক । বেশী জানাজানি হয়ে গেলে ---
প্রসঙ্গ চাপা পড়ল ।
আরণ্যক বসুরায় এবং অনন্ত মোহন সরখেল নাগা সন্ন্যাসীর বেশ ধরে কখনো ট্রেনে, কখনো বাসে করে এসে পৌঁছালেন ধর্মতলায় ।
সাধু সন্ন্যাসীদের এবং পূণ্যার্থীদের জন্য পৃথক অস্থায়ী যাত্রীনিবাস তৈরি করে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নাগা সন্ন্যাসীদের জন্য পুলিশি পাহারার বন্দোবস্তও করা হয়েছে। সেখানে আরণ্যকসহ অনন্তের দল রাত কাটাচ্ছেন। খিচুড়ি পাকানোর ব্যবস্থাও আছে ।
আরণ্যক অনন্তকে বললেন - শীত লাগুক বা না লাগুক শরীর নগ্ন করে রাখতেই হবে। নইলে বিপদ। আর আমাকে তো চেনই; নিজে বাঁচতে তোমাকে মেরে ফেলতেও আমার দ্বিধা নেই !
অনন্ত সভয়ে বলেন - ঠিক আছে।
রাত কাটতে না কাটতেই ; এক্কেবারে ব্রাহ্মমুহুর্তে ওঁরা যাত্রা করলেন কাকদ্বীপ নামখানার উদ্দেশ্যে । শিয়ালদা থেকে প্রথম ট্রেনে চেপে বসলেন যাতে তাড়াতাড়ি সাগরে যাওয়া যায় । সেখানে থাকার জায়গা ঠিক করতে হবে তো !
আরণ্যকের এখন একমাত্র লক্ষ্য ললন্তিকা। এক এক করে প্রায় সব কাঁটা দূর হয়ে গেছে । হাতে বড় কাঁটা বলতে ওই ললন্তিকা । আরণ্যক আর একবার ললন্তিকার মুখটা - যে মুখটা তিনি প্রথমবার দেখেছিলেন - সেই মুখটা মন-ক্যামেরায় দেখে নিলেন । সার্জারির পরের মুখটা তো সেই সেক্স-ডলের মত করিয়ে দিয়েছেন।
আয়নায় দেখে নিলেন তাঁর নিজের মুখটাও। প্লাস্টিক সার্জারির দৌলতে আরণ্যককে এখন চেনে কে ? শুধু ওই অনন্ত মোহন ছাড়া !
মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয় অনন্তকে সরিয়ে দেওয়া মানে আরও নিরাপদ হয়ে যাওয়া । যে কোন সময় তাকে মেরে ফেলাই যায় । কিন্তু তিনি চান ললন্তিকার সামনে তাকে মেরে ফেলতে। মরার আগে ললন্তিকা যাতে দেখে যেতে পারে আত্মীয় বন্ধুহীন এই জগতে তার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই ।
আবার ভাবেন তাঁরও তো এখন কোন আত্মীয়স্বজন নেই। সবাই এখন তাঁর শত্রু । তা না হলে দেবেন্দ্র ভৌমিক কেন আসবে এখানে ? আহা রে! কনকের আর এক বোনও না বিধবা হয়ে যায় । আরণ্যকের মনোভাব এখন এরকমই - ডু অর ডাই ।
( ক্রমশ )
