Nityananda Banerjee

Thriller

4  

Nityananda Banerjee

Thriller

ললন্তিকা ধারাবাহিক

ললন্তিকা ধারাবাহিক

5 mins
237


পর্ব পঁচিশ

বি ডি আর পোস্টের অদূরে একটা বকুল গাছের তলায় খলিল একটা কম্বল পেতে দিল ।বলল- 

এই মাইয়া আদ্দেক কম্বলে শুয়ে পড়। শীত করলে বাকি আদ্দেকটা গায়ে জড়িয়ে নিও । আমি তোমারে পাহারা দিতে থাকি ।

ললন্তিকা তাই করল । তেমন ঠাণ্ডা না পড়লেও অর্ধেক কম্বলে যথাসম্ভব মুড়ে নিল শরীরটা । কয়েকজন জোয়ান এসে টর্চ জ্বালিয়ে মুখটা দেখার চেষ্টা করছিল বটে; খলিল মিয়া এসে সব সামাল দিয়েছে।

ললন্তিকার লজ্জা হল । কি ভেবেছিল লোকটাকে আর সে তো দেখছি অন্য রকম । তথাপি না আঁচালে বিশ্বাস নেই । বলল - আপনিও একটু বিশ্রাম নিন ।

- ওটি হচ্ছেনি বেটি ! এখন আমি ঘুমায়ে গেলে বিপদ হইব। দিনকাল ভালো না মা । তুমি একটু আরাম করে ন্যাও ।

ললন্তিকা মুগ্ধ হয়ে গেল । সব মানুষ খারাপ হয় না । আর এই বৃদ্ধ তো তাকে বেটি মা বলে সম্বোধন করছে!

আর যাই হোক ওর মতলব খারাপ নয় ।

খুব ভোরের দিকে খলিল ললন্তিকাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিল । বলল - এবার চল বেটি। প্রথম বাস সাড়ে চারটার সময় । ধরতে পারলে দুপুর নাগাদ তাহেরপুরে পৌঁছে যাব ।

ধড়মড় করে উঠে বসল ললন্তিকা। তারপর সেই বৃদ্ধের সঙ্গে হাঁটতে লাগল । ট্রিকের মত মুখ নিয়ে একটা লজঝড়ে বাস অদূরে দাঁড়িয়ে। মোটামুটি ফাঁকাই ছিল। খলিল ললন্তীকাকে একটা লেডিস সীটে বসিয়ে দিয়ে কাছাকাছি অন্য সীটে গিয়ে বসল । 

বলল - বোরখা ঢেকেই থাকবা । কেউ কইলেই মুখ দেখাবা না ।

ললন্তিকা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল ।

ঠিক সাড়ে চারটেয় বাস ছেড়ে দিল গুটিকয় প্যাসেঞ্জার নিয়ে । মিনিট দুই পরে কণ্ডাক্টর এসে ভাড়া চাইলে ললন্তিকা খলিলকে দেখিয়ে দিল । 

কণ্ডাক্টর বলল - কয়জন আছেন কত্তা ? 

- দুই জন। কত ভাড়া ?

কণ্ডাক্টর বলল - তাহেরপুর ! একল বিশ টাকা।

 খলিল বলল - কিছু কম কর কণ্ডাক্টর ভাই। ভোরের বেলা দুই দুইটা প্যাসেঞ্জার পাইয়া গেলা ।

কণ্ডাক্টর বলল - কমানো যাবে না । একশ বিশই লাগবে।

খলিল ভাড়া মিটিয়ে সীটে হেলান দিয়ে বসল । বাসের দুলুনী আর সারা রাত জেগে থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই খলিল ঘুমিয়ে পড়ল । 

পাশে বসা মেয়েটি বলল - এহেনে নতুন নাকি গা ?

ললন্তিকা ঘাড় নেড়ে বলল - হাঁ।

- তা কোথায় যাবে শুনি ? তোমার কত্তা কই গেল ?

ললন্তিকা ঈশারায় খলিলকে দেখিয়ে দিল ।

- অ । কচি মাইয়ার বুড়া বর । তা ভালই ।

তারফর নিজের মনে গজরাতে লাগল - কোথা থেকে আমদানি করেছে কে জানে ? বুড়াদের সগ মন্দ না। দেখ গিয়ে ঘরে দুই তিনটা সতীন ।

ললন্তিকা চুপ করে রইল । কামিল ভাই বলে দিয়েছে কারও সাথে মুখ খুলবে না আর কথা কইবেন না আপা।

ওটা অইল গিয়া বাংলাদেশ। ফুঁসলাইয়া লইতে পারে ।

ওরে বাবা ! কি বিপদ ! হে ঈশ্বর সহায় হও ।

ললন্তিকা মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল । 

হঠাৎ খলিলের ঘুম গেল ভেঙে । ললন্তিকার কাছে উঠে গিয়ে বলল - খিদা পাইসে না কি গা ? আসো, এহেনে বাস পনের মিনিট দাঁড়াইব । কিসু খাইয়া লও ।

ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছিল ললন্তিকার । খলিলের সঙ্গে নামল বাস থেকে । একটাই দোকান । চপ , মুড়ি, তেলেভাজা , আর চা ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না । খলিল নিজের ও ললন্তিকার জন্য দুই থালা মুড়ি আর দুটো করে চপের অর্ডার দিল ।

মুড়ি ও চপ দেখে তো ললন্তিকার গা-পিত্য জ্বলে উঠল। এটা আবার কি ধরণের খাবার ! এই ক্ষিধের সময় এগুলো ভালো লাগে নাকি ! বলল - আমি খাব না। শুধু এক কাপ চা পেলেই যথেষ্ট ।

খলিল অনেক অনুরোধ করল - চাট্টি খাইয়া লও বেটি । তাহেরপুরে গিয়া ইলিশের ঝোল ভাত খাওয়াব ।

ললন্তিকা শুধু চা-ই নিল এক কাপ । এখন আফশোষ হচ্ছে বিস্কিটের প্যাকেটটাও রেখে দিয়ে এসে । কামাল ভাই এতক্ষণে নিশ্চয় ওগুলো সাবাড় করে দিয়েছে ।

চায়ের বিরতির পর বাস ছাড়ল । আর বেশি দূর নয় তাহেরপুর । ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছবে।

খলিল বলল - এই আইসা গেছি। পেত্থমে গিয়েই তোমারে খাওয়াব ।

ললন্তিকা কথাগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই আনল না । বিদেশ বিভুঁই বলে কি নিজের রুচিও বদলাতে হবে নাকি !

তাহেরপুরে নেমে ওরা একটা রিক্সায় করে আতাউর কামালের বাড়িতে উঠল ।

সুন্দর ছিমছাম একটা মাটির বাড়ি ; ঠিক যেন তার গাঁয়ের বাড়িটির মত । সামনে প্রলস্ত উঠোন। বেড়ার ধারে রকমারি ফুলের গাছ । গাছে গাছে কত ফুল, পাখি, প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে।

কামালের মা আমিনাবিবি এসে হাসিমুখে তাকে আপ্যায়ণ করলেন । 

- কি মিষ্টি মেয়ে ! এমনটাই তো চেয়েছিলাম । হতভাগা ছেলেটার গাঁয়ে থাকতে ভালো লাগল না । কোথায় কোন শহরে গেছে রোজগার করতে ।

ললন্তিকার ইচ্ছে হল সত্যি কথাটা তাঁকে জানিয়ে দিতে। কিন্তু কামাল ভাই তার যে উপকার করেছে ; কৃতজ্ঞতা বশে কিছু প্রকাশ করল না ।

- সত্যি আন্টি! কামাল ভাই বড় উঁচু মনের মানুষ। এই দেখুন না, আমাকে নেমন্তন্ন করে এনে নিজে থেকে গেল।

- ছেলেটা আমার অমনিই । তা' হ্যাঁ মা জননী ! তুমি তো হিন্দু । কামাল বলেছিল । তা' বাছা, এই মোছলমানের রান্না তুমি খাবে তো ? এই বেলাটা কষ্ট করে খেয়ে নাও। বিকেলে না হয় ভৌমিক সাহেবের বাড়িতে পাকা বন্দোবস্ত করে দেব , কথা হয়ে আছে ।

ললন্তিকা ভাবল তা' সেখানেই তুললে তো পারত। এখন দেখছি জাত ধর্ম সব খোয়াতে হবে । কিন্তু আমিনা বিবির আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে বলেই দিল - আমি ও সব মানি না । খুব ক্ষিধে পেয়েছে মাসীমা । হাত পা ধুয়ে নিচ্ছি , আগে খেয়ে নি তারপর মন ভরে কথা বলব ।

আমিনা বিবি খলিলকে বললেন - আপনিও হাতমুখ ধুয়ে আসুন ভাইজান। সেই কবে খেয়েছেন। খিদে তো পেয়েছে ঠিক।

খলিল বলল - আমার বাড়ি তো দু'চারটে ঘর পরই। আমি বাড়ি যাইয়া খামু না হয়, মাইয়াডারে পেট পুইরা খাওয়াও। কিচ্ছুটি খায়নি ; এক কাপ চা ছাড়া ।

খলিল চলে গেল ।ললন্তিকা খেতে বসল। গরম গরম ইলিশ ভাজা, ইলিশের পাতুরি , কচুশাকের চচ্চড়ি, ডাল, ভাত । শেষপাতে এক খিলি পান ।

পান দেখে ললন্তিকা বলল - আমি পান খাই না ।

আমিনা বিবি বললেন - তাই তো, তাই তো! এমন সোঁদর মাইয়া পান খায় নাটি। দাঁত নষ্ট করতে !

ললন্তিকার কোন ভাবান্তর হল না । সুন্দরী কথাটা এতবার শুনেছে যে এখন আবার কেউ বললে তার মনে হয় যেন বিদ্রুপ করছে । এই সৌন্দর্য্যের জন্যই তো তার আজ এমন হাল । দেশছাড়াও হতে হয়েছে। তবু ভগবানকে একটা ধন্যবাদ দেয় । 

' সাথে থেকো ঠাকুর' ।

আমিনার সঙ্গে গল্প করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে যায় ললন্তিকা । বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়। আমিনা বিবি বলেন - চা বসাই । চা খেয়েই তোমাকে ভৌমিক সাহেবের বাড়িতে দিয়ে আসব । ভীষণ ভালো মানুষ । তোমাকে দেখলে খুশি হবেন ।

ললন্তিকা হাঁটতে হাঁটতে আমিনার সঙ্গে চলে । কয়েকটা কাঁচা বাড়ি পেরিয়ে একটা পাকা বাড়ির দরজায় এসে আমিনা বিবি কড়া নাড়েন ।

মুস্তাফা বলে ভৌমিকের কোন তাবেদার দরজা খুলে দেয়।

আমিনা বিবি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে - কই গো গিন্নি মা ! তোমাদের অতিথিকে নিয়ে এসেছি।

সৌম্যকান্তি এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে এসে ওদের ভেতরে নিয়ে যান । 


( ক্রমশ )


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller