ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব একশত চার
বাছিরুদ্দিন আপ্রাণ চেষ্টা করেন প্রতিশোধ নেবার । সুযোগ আর আসে না ।
সুরক্ষা বলয় এমন নিশ্ছিদ্র যে পিঁপড়েও গলতে পারে না । একসময় তাঁর মনে হল - নাহ্ হবে না । জবরদস্তি ঢুকতে গেলে অকালে জীবন দিতে হবে ।
ভৌমিক বাড়ির কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না । এমনকি বাড়িতে তাঁরা আদৌ আছেন কি নেই; তাও বোঝা যায় না ।
সেই পরিচিত সঙ্গীটি বলল - এই কিছুদিন আগেও এমন নিরাপত্তা ছিল না কত্তা । ইণ্ডিয়া থেকে ফিরে আসার পরই দেখছি গোটা বাড়িটা ঘিরে জমজমাটি পাহারা । কি এমন ভি আই পি যে এমন ব্যবস্থা - কিছুই বুঝি না ছাই !
বাছিরুদ্দিন বললেন - খবর নাও ভায়া, এই সুরক্ষা সরকারের দেওয়া নাকি ভৌমিকেরা নিজের খরচে বহাল করেছে । প্রহরীদের দেখছি বাড়ির ছাদেও ঘোরাফেরা করছে ।
- কত্তা গো ! এগুলো মনে হচ্ছে বাংলাদেশী পুলিশ বা মিলিটারি নয় । কেমন দেখেন- নাক চ্যাপ্টা, বেঁটে।
বাছিরুদ্দিন বললেন - আমি চোখে কম দেখি। চশমা পরেও তো ঠিকমত দেখছি না । তুমি ভায়া একটু এগিয়ে দেখে এসো না ।
- ও কথা বলবেননি কত্তা । আমার মরার ফুরসত নাই। ওই দেখেন নোটিশ বোর্ড - রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া ।
বাছিরুদ্দিন ওরফে আরণ্যক হাল ছেড়ে দেবার
পাত্র নন। জীবন বাজি রেখে পালিয়েছেন, জীবন বাজি রেখেই কাজ সারবেন । মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন - ধ্বংস চাই, ধ্বংস ।
সন্ধ্যে থেকে ভৌমিক বাড়ির নিরাপত্তা আরও বাড়ল ।
চার পাঁচটা ট্রাকে জংলী পোষাক পরা , মিলিটারি দেখতে, অন্তত জনা ষাটেক সুরক্ষা কর্মী কনভয় করে এল ভৌমিক বাড়িতে ।
কালো কাঁচে ঢাকা তিনটে গাড়িকে পাহারা দিয়ে বাড়িতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল । পাড়া প্রতিবেশীরা উঁকি মেরে দেখছিল । পথে বেরোতে কেউ সাহস করেনি।
আলমও করল না । বাধ্য হয়ে বাছিরুদ্দিন চশমা নাকে গলিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন । জায়গাটা নিয়ন বাতির আলোয় ঝলমল করছে। ছাদ থেকে সার্চ লাইটের আলো জ্বালিয়ে চারিপাশ খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে।
হঠাৎ বাছিরুদ্দিন কনভয়ের দিকে কাশতে কাশতে এগিয়ে গেলেন । ব্লক হসপিটাল যেতে হলে এটিই একমাত্র পথ ।
এমন কাশি কাশতে লাগলেন এই বুঝি দম বেরিয়ে যায়। রক্ষীদল কাশ রোগী ভেবে একটু তফাতে সরে দাঁড়াল। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে লাগল - দিনের বেলায় যেতে কি হয়েছিল ? বাছিরুদ্দিন শুনেও শুনলেন না । কাঁচ ঢাকা গাড়ি থেকে তখন সকলে নামছেন । কাছ ঘেঁষে পেরিয়ে যাবার সময় তিনি দেখলেন মিঃ ভৌমিক সপরিবারে তো ঠিকই ; আরও বেশ কিছু আত্মীয়ই হবে হয়তো, তাঁদের নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন ।
সন্দেহ হল বাছিরের । ঐত লোকজন তো তাঁর বাড়িতে নেই । তবে কি আমদানি করা মালগুলো ভারত থেকে আনা । আর তার জন্যই এই পাহাড়প্রমাণ পাহারার ব্যবস্থা ? পিছু ফিরে চাইলে পাছে সন্দেহ হয়; তিনি সোজা বেরিয়ে গেলেন ।ওখান থেকে হসপিটাল দু'তিন মিনিটের হাঁটা পথ । কাজেই তিনি হসপিটালে খুব দ্রুত পৌঁছে গেলেন ।
ডাক্তার না দেখিয়ে ওষুধ পাওয়া যাবে না । আবার ওষুধ না নিয়ে ফেরাও যাবে না । ফিরতি পথে এ ভাবে কেশেও যাওয়া যাবে না । এখানকার পুলিশ যদি তুলে এনে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয় ! ডাক্তারবাবু তো ধরে ফেলবেন কিছুই হয়নি তাঁর। ফলে ---
অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা করে তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন ।
বললেন - স্যার, সন্ধ্যে থেকে পোলাটার জ্বর সর্দি-কাশি। যদি একটা ওষুধ দেন পোলাটা বেঁচে যায় ।
ডাক্তার শুনে দু'একটা ওষুধ লিখে দিলেন । তিনি স্টোর থেকে ওষুধ নিয়ে ফিরে চললেন আলমের বাড়ির দিকে।
পথে কাশতে কাশতে চলেছেন । ভেবেছিলেন আসার মতই কেউ তাঁকে রুখবেন না ।
হঠাৎ কয়েকজন জলপাই রঙা পোষাকের পুলিশ এসে তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়াল। তিনি কাশির বহর বাড়িয়ে দিলেন আর বাড়িয়ে দিলেন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ও ওষুধ । ওরা মনে কর কোন পেশেন্ট; দেখেও তাই মনে হল, পথ ছেড়ে দিল । তিনি নির্বিঘ্নেই আলমের বাড়িতে চলে এলেন ।
আলম তাঁকে দেখে যেন ধড়ে প্রাণ পেল।
- আপনি বাঁইচ্যা আছেন কত্তা ?
- কেন ? আমি কি এখন ভুত হয়ে এসেছি নাকি ?
- না না তাই কই নাই। বলতেছি ওরা আপনারে ছাইড়া দিল ?
- কেন ? আমি কি চোর ডাকাত নাকি ! আমাকে ধরবে ?
- এহেনের পুলিশ তেমনই কত্তা । ইচ্ছা হইলেই ধরে, ইচ্ছা হইলেই ছাইড়া দেয় । তবে বুকের পাটা আছে আপনার কত্তা । প্রধান শুনলে আপনারে জেনারেল বানাইব।
- তুমি ওকে বলবে আজকের কথা । না না আমি জেনারেল হতে চাই না শুধু কাজ করে যেতে চাই।
- অবশ্য কইমু কত্তা । আলম বলে - ন্যান , হাত পা ধুইয়া বসেন খাইতে। আজ আপনার লগে বিফ আইনাছি।
আরণ্যকের গা ঘিনঘিন করতে লাগল । এখুনি তেন অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসতে চাইল । বার দুয়েক 'অক অক' করে উঠলেন । কিন্তু তিনি ঘাবড়ে গেলেন না । এই সময় সামান্য ভুল হলে প্রাণটাই চলে যাবে ।
তিনি হাত পা ধুয়ে ডিনারে বসলেন । কথায় বলে ' আপ রুচি খানা ' । অপছন্দের হলেও বিগলিত হৃদয়ে বললেন - এত খরচা করার কোন মানে হয় না । সামান্য আয়োজন করলেই হোত । আলু সেদ্ধ ডাল ভাতই আমি খুব পছন্দ করি।
- তাই কি হয় কত্তা ? বাড়িতে মেহমান এলে আলু সিদ্ধ খাওয়ানো যায় ! আপনি অইলেন গিয়া দলের ভবিষ্যত। আপনারে আলু সেদ্ধ খাওয়াই আর প্রধান আমারে বকাবকি করেন - সই কেমনে ?
এখটা কলাই করা থালায় ভাত, ভাজাভুজি, আলু-ফুলকপির তরকারি, চাটনি মাংস ( বীফ) - এই রাতের ছোট্ট আয়োজন ।
আরণ্যক খেতে বসলেন । গোঁড়া হিন্দু পরিবারের মানুষ। খাওয়া তো দূর; কল্পনাও করেননি কখনও এই অবস্থায় পড়তে হবে । আবার না খেলেও মুশকিল । প্রথম দিকে গাটা গুলিয়ে এলেও একটা পিস মুখে দিতেই তাঁর ধারণাটা বদলে গেল । ভীষণ স্বাদিষ্ট ভোজন । রান্না বোধ করি এই বাংলাদেশীরাই সবচেয়ে ভালো পারেন । চেটেপুটে খেয়ে নিলেন সব ।
- আর একটু বীফ দেই কত্তা ?
- না না ভায়া । পেটে আর তিলটুকুও ঢুকছে না ।
মনে মনে ভেবে নিলেন একটা মস্ত বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলেন।
ভোর রাতের দিকে শাখা প্রধান ভিজিটে এল । কিছু বোমা, গুলি আর একটা একে ৪৭ নিয়ে উপহার দিল বাছিরকে।
বলল - দল আপনার সাহস এবং বুদ্ধির তারিফ করে। সেইজন্য এই উপহার দেওয়া হল । এবার আপনি নিজেকে রক্ষা করতে এবং দলের উদ্দেশ্য সাধন করতে সচেষ্ট হয়েন।
বাছিরুদ্দিন প্রথামত রাইফেলটি হাতে নিয়ে মাথায় ঠেকালেন । হামেশাই পিস্তল, রিভলভার চালিয়েছেন। এবার এক্কেবারে অত্যাধুনিক রাইফেল হাতে নিয়ে বললেন - চালাতে পারব তো ?
প্রধান সব কিছু দেখিয়ে বললেন এই ট্রিগারে আলতো চাপ দিলেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেরিয়ে আসবে । লক্ষ্যবস্তুর প্রতি তাক করে চালালেই হবে ।
নেড়েচেড়ে দেখলেন আরণ্যাক ওরফে বাছির। প্রথমেই তার রজনী দেবীর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল । প্রতিবেশীর কেউ এসে হাতের শাঁখা ভেঙে দিল, নোয়া খুলে জলে ফেলে দিল আর সিঁথির সিঁদুরও মুছে দিল ।
( ক্রমশ )
