ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব আটচল্লিশ*
শ্রীমান অরবিন্দ সরখেল গীতা আশ্রমে নতুন নাম পেল - বাউল কাকা । ললন্তিকা বোষ্টমী কাকিমা। দু'জন বেশ সুখেই আছে । কোন চাপ নেই, উত্তেজনা নেই, কারও লোলুপ দৃষ্টি নেই । এর চেয়ে সুখী জীবন ললন্তিকা কি কখনও কল্পনা করেছে ?
বোধ হয় না । যদি করত তবে ছদ্মবেশ ধরে বহুরূপীর জীবন কাটাতে হোত না ।
অরবিন্দেরও একই অবস্থা । অনর্থক লোভ লালসার জন্য জীবনটা বরবাদ করে দিয়েছে। এর জন্য ও অবশ্য ওর বাবা মা কাউকে দোষ দেয় না । ধরেই নিয়েছে এটা তার কৃতকর্মের ফল ।
পাপ পূণ্য সব সঞ্চয় এখানে এই জীবনে । এর জন্য স্বর্গ নরক কোথাও যেতে হয় না । সব ফলাফল হাতেনাতে পাওয়া যায়। কতকটা ঠিক সরকারি কর্মচারীদের ডি এ বোনাস ইনক্রিমেন্ট পাবার মত ।
অরবিন্দ ঠিক করে নিল ওরা এখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে । রাধামাধবের চরণে নৈবেদ্য দিবে। ললন্তিকা মোটের উপর অনেক খুশি। আরণ্যক তো ওর জীবনে অভিশাপ মাত্র ।
বেশ কেটে গেল দু'এক মাস । একদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মোহান্ত মহারাজ সকলকে ডাকলেন ।
বললেন - পরিব্রাজকের মত ভিক্ষা সংগ্রহে বেরোতে হবে । আশেপাশের গ্রাম এবং রাণীগঞ্জ শহরে , আসানশোলে, দুর্গাপুরে যেতে হবে যে যতখানি পারেন অনুদান জোগাড় করতে ।
বেঁকে বসল ললন্তিকা । এ আবার কি ধরণের মানসিকতা মোহান্ত মহারাজের ! এখন দু'বেলা ওরা গান শুনিয়ে আশ্রমের তহবিলের কলেবর যথেষ্ট বাড়িয়েছে। এরপরও যদি ওদের বাইরে যেয়ে ভিক্ষে করতে হয় তবে তো মান-সম্মান বলে কিছু থাকে না !
মোহান্ত মহারাজ বললেন - মা! তোমাকে যেতে হবে না। তুমি রাধামাধবের সেবায় নিয়োজিত হও। বোষ্টম ঠাকুরের গলা ভারি সুন্দর ! ও গেলে ভিক্ষের দান মিলবেই।
অরবিন্দ বলল - কিন্তু মহারাজ ! রসকলি যে আমায় ছেড়ে থাকতে পারে না । কৃষ্ণের যেমন রাধা তেমনই আমিও যে তার কৃষ্ণ !
- ভারি ভাবনায় ফেললে হে বোষ্টম ! আমিও তো রইব তোমার সাথে !
- মোহান্ত মহারাজ ! আমরা জাতে বোষ্টম হলে কি হবে ; রাধামাধবের দয়ায় আমাদের বাপ ঠাকুর্দারাও ভিক্ষেয় বেরোতেন না । যা জুটত তাতেই দিব্যি চলে যেত ।
- ওহে বোষ্টম । ভিক্ষা নামটা শুনতে খারাপ ; কিন্তু উঞ্ছবৃত্তি নয় । এ হল সেবা। সাধারণের মধ্যে অসাধারণের প্রতিষ্ঠা । ঈশ্বরের নাম বিলিয়ে প্রতিদানে কিছু অনুদান নেওয়া পূণ্যের কাজ । কেন না আমরা কেউ স্বার্থের জন্য এই কাজ করছি না ।
অরবিন্দ বলল - মোহান্ত মহারাজ আপনার জ্ঞান অসীম। কথায় তো আপনার সঙ্গে পেরে উঠব না। ঠিক আছে, বলছেন যখন যাব।
মোহান্ত খুশি হলেন ।
- তবে বোষ্টম ! তোমাকে বেশী দূরে যেতে হবে না। কারণ সকাল সন্ধ্যে তোমার নামগান খুব প্রয়োজন। আশ্রম তখন এক অপূর্ব মূর্ছনায় ব্যাপ্ত হয় ।
অরবিন্দ গর্বিত হয় । ললন্তিকা জ্বলে যায় । বলে
- কেন ঠাকুর ! আমি কি কোন অংশে কম নাকি ? আপনি শুধু ওর নামকীর্তন করছেন ?
জিভ বের করে মোহান্ত বলেন - না মা ! তেমন ভেবোনি। তোমাকে আমি পরম স্নেহ করি । তোমার মঙ্গল হোক। তুমি যেতে চাওনি বলে বোষ্টমকে বললাম।
ললন্তিকা দাঁত বের করে হাসল । সে হাসিতে দাঁতগুলো সবকটা যেন ঝলকে উঠল । মোহান্ত মুগ্ধ হয়ে রাধিকাকে স্মরণ করলেন ।' বোষ্টম খুব ভাগ্যবান মা !' মোহান্ত বললেন - সাত জনমের পূণ্যফলের প্রাপ্তি হয়েছে বোষ্টম ঠাকুরের । তোমার মত সহধর্মিনী পেয়ে ।
ললন্তিকা মুখ ব্যাজার করে নামিয়ে নিল। অরবিন্দ একটু হাসল মাত্র ।
সন্ধ্যারতি শুরু হল আশ্রমে । চণ্ডীমন্দিরের ঘন্টাধ্বণি শোনা গেলেই রাধাকৃষ্ণ আশ্রমেও আরতি শুরু হয় দুই বেলা।
আরতি শেষে গান আর প্রসাদ বিতরণ - এই এখন অরবিন্দ ও ললন্তিকার কাজ ।
আজ একটু বেশীই তিলক কেটেছে ওরা দু'জনই । তারপর মন্দিরে গিয়ে আরতি দেখেছে, গান গাইছে।
পুলিশের ভারি বুটের আওয়াজ এল । বোলেরো গাড়ি থেকে নেমে এলেন রাণীগঞ্জ থানার ওসি মিঃ সন্তু মুখার্জী।
- আমাদের কাছে খবর আছে এই আশ্রমে একজন কুখ্যাত মেয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছে। আমরা তল্লাশি নেব।
মোহান্ত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন ।
- অবশ্যই নেবেন হুজুর । সন্ধ্যারতির সমাপ্তি পর্য্যন্ত অপেক্ষা করুন দয়া করে । তারপর আমরাই আপনাদের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগীতা করব ।
- সেই সুযোগে যদি পালিয়ে যায় ? আপনি দায় নেবেন?
- নেব। নেব হুজুর । আজ পর্য্যন্ত এই আশ্রমে কোনদিন পুলিশ আসেনি । প্রয়োজন পড়েনি হয়তো । এখন আপনাদের সন্দেহ হয়েছে আপনারা এসেছেন। আমার কাজ আপনাদের সহযোগীতা করা ; শুধু আর দশটা মিনিট ধৈর্য্য রাখুন । আমি নিজে নিয়ে যিব আপনাদের ।
সন্তু মুখার্জী চারিপাশে পুলিশ ছড়িয়ে দিলেন । আসানশোল দুর্গাপুর থেকে বিশেষ প্রশিক্ষিত মহিলা পুলিশও নিয়ে এসেছেন ।
মোহান্তকে বললেন - সেদিন যে নাম্বারটা দিয়েছিলাম; তাকে ফোন করে দেখেছিলেন ?
- দেখেছি, দেখেছি স্যার । বহু বার চেষ্টা করে দেখেছি। সব সময়ের জন্য ফোন বন্ধ করা আছে । এই দেখুন - আবার করছি -
বলে তিনি ফোন করলেন । অবাক কাণ্ড ফোনে রিং হচ্ছে।
উৎফুল্ল হয়ে মোহান্ত বললেন - এই দেখুন স্যার । ফোন বাজছে এখন ।
সন্তু মুখার্জী ফোন হাতে নিলেন । কেউ ওঠাল না । তিনি নিকটবর্তী ফোন কোম্পানি অফিসে নির্দেশ দিলেন এই নাম্বারের লোকেশন ডিটেক্ট করতে ।
এদিকে আশ্রম পুলিশ ঘিরে ফেলেছে দেখে অরবিন্দের কোন ভাবান্তর না হলেও ললন্তিকা অধীর হয়ে উঠল । অরবিন্দ বলল - চঞ্চল হয়ো না । রাধামাধবের উপর আস্থা রাখো। আমার উপর ভরসা রাখ । পুলিশ কিছু করতে পারবে না ।
ললন্তিকা বলল - চল পালিয়ে যাই।
অরবিন্দ বলল - কোথায় পালাবে । পালালে তো পুলিশের এমনকি আশ্রমের সবার ধারণা দৃঢ় হবে আমরা আসামী ।
ললন্তিকা অস্থির হয়ে বলল - তা' হলে কি করবে ? পুলিশকে ধরা দেবে ?
অরবিন্দ ললন্তিকার হাতে ট্যাবলেটের মত দেখতে একটা কিছু দিয়ে বলল - এটা রাখো । পুলিশের হাতে ধরা পড়লে মুখে ভরে নেবে । আমার কাছে রয়েছে আরও কিছু।
ললন্তিকা বলল - কি এটা ?
- পটাসিয়াম সায়ানাইডের ট্যাবলেট ।
ললন্তিকা হতবাক হয়ে অরবিন্দের মুখের দিকে চেয়ে রইল ।
মিঃ সন্তু মুখার্জী বললেন - মোহান্ত ঠাকুর ! সেদিন রাতে আপনার আশ্রমের কাছাকাছি কোন গুলির আওয়াজ পেয়েছিলেন ?
- গুলি ? কই শুনিনি তো !
- সে কি? আপনার থেকে বিশ পঁচিশ গজ দূরে গুলি ছুঁড়ল কেউ আপনারা শুনতে পাননি ?
- সত্যি বলছি , শুনিনি স্যার । অন্য কেউ শুনলেও তো আমার কানে খবরটা দিত !
- ঠিক আছে । এখন চলুন তল্লাশি নিতে হবে ।
তখনই ফোন এল সিম কোম্পানি থেকে । কেউ বলল
- স্যার লোকেশনটা সঠিক পাওয়া যাচ্ছে না । তবে মনে হচ্ছে হুগলির কোন একটা জায়গা ।
সন্তু মুখার্জী বুঝে গেলেন সিমের মালিক এই তল্লাটে নেই।
মোহান্তকে বললেন - বিশেষ কাজে চলে যেতে হচ্ছে। থাক আর তল্লাশি নেব না ।
পুরো টিমকে ফিরিয়ে নিয়ে তিনি চলে গেলেন ।
অরবিন্দ ললন্তিকা এমনকি মোহান্ত মহারাজও তখনকার মত স্বস্তি পেলেন । তাঁর মাথায় একটা চিন্তা এল। বোষ্টমী যেদিন থেকে এসেছে সেদিন থেকে পুলিশের উৎপাত বেড়েছে কেন ! আশ্রমে তো কোন দুর্বৃত্ত আছে বলে মনে হয় না । বোষ্টমী তাহলে কে ? হঠাৎ এসে বোষ্টমকেই বা কন্ঠীবদল করল কেন ?
( ক্রমশ )
