ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব ঊননব্বই **
কিল চড় খেয়ে সাধুবাবা ' বাঁচাও বাঁচাও ' বলে চেঁচাতে লাগল । পি সি ও মালিক সাধুবাবার মার খাওয়া দেখে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে গেল ।
কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে ঠিক করতে না পেরে পুলিশ ডাকল । ততক্ষণে ওরা দু'জন দৌড়াতে শুরু করে দিয়েছে। পুলিশ এল অনেক দেরীতে। ওরা দৌড়াতে দৌড়াতে আবার পাহাড়ি পথে লুকিয়ে গেল ।
আরণ্যক বসুরায় একসময় লোকটাকে ধরে ফেললেন। টানতে টানতে নিয়ে যাবার সময় বারবার বলতে লাগলেন - পরিচয় দাও; নইলে দু'জনেরই সমূহ বিপদ । কেউ একজন ধরা পড়লেই ফস্কা গেরো খুলে যাবে ।
তোমার কোন ভয় নেই। যতক্ষণ আমার কাছে থাকবে
পুলিশ তোমার টিকিও ছুঁতে পারবে না । আবার কিছু কামধান্দাও জোগাড় করে দেব ।
লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বলল - আমি অনন্ত। অনন্ত মোহন সরখেল । আপনি আমার পাণ্ডুলিপি চুরি করে আমাকেই খুন করার নির্দেশ ছিলেন ; কিন্তু আপনার সাগরেদ ঠিকমত লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি । আমার যমজ ভাইকে খুন করে ভেবেছিল আমাকেই মেরে ফেলেছে ।
- হুমম্ ! এবার বুঝেছি গুহায় কেন ' কেউটের ছোবল ' কথাটা লেখা ছিল । ভেবেছিলে পুলিশ এসে যদি খোঁজ করে এই লেখার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যাবে ।
- আমি আপনাকে দেখে স্থির থাকতে না পেরে পুলিশকে খবর দিই । মি: আরণ্যক বসুরায় সাধুর বেশে এই গুহায় রয়েছেন। কিন্তু আমি একেবারে হিন্দি জানি না তাই পুলিশ হয়তো বুঝতে পারেনি । তখন মাঝরাতে গুহা থেকে পালিয়েছিলাম জন অরণ্যে মিশে যেতে ।
আরণ্যক বসুরায় বললেন - তোমার সাহস তো কম নয় । আমার নামে নালিশ কর ! এই জন্যই প্রশান্ত - তোমার ছেলে পুলিশের হাতে বন্দী আছে ।
আরণ্যক এভাবে অনেক কিছুই বানিয়ে বলতে লাগলেন । অনন্ত মোহন বলল - পাণ্ডুলিপি আমি চাই না। আমি আপনার নামে উৎসর্গ করে দিচ্ছি আর আপনি আমাকে মেরে ফেলুন - ক্ষতি নেই - কিন্তু প্রশান্তকে বাঁচতে দিন দয়া করে !
মি: বসুরায় বললেন - দয়া ! দেখো এই দয়া, মায়া, স্নেহ, ভালবাসা - এগুলো হল অন্তরের সুক্ষ্ম অনুভূতি। যার কোন কিছু আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। তুমি জানো! তোমার প্রশান্তকে দিয়ে আমি আমার নিজের বউকে খুন করিয়েছি? তুমি কি জানো,তোমার ভাগ্নি ললন্তিকাকে আমি রক্ষিতা বানিয়েছি ? তুমি কি জানো ললন্তিকাকে আমি একজনের কাছে বেচে দিয়ে এসেছি ?
এক এক করে মি: বসুরায় নিজের কীর্তি ফাঁস করছেন আর তা' শুনে অনন্থ মোহন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
এবার অনন্ত আরণ্যকের পা জড়িয়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইল প্রশান্তর ।
- আপনিই পারেন আমার অভাগা ছেলেকে বাঁচাতে! আপনি দয়া করুন।
আরণ্যক বললেন - করলাম ! এবার উঠে দাঁড়াও। আর আমি যা বলছি তাই কর ।
প্রকাশ্য দিবালোকে নির্জন প্রান্তরে অনন্তকে একলা পেয়েও আরণ্যক তাকে খুন করতে চাইলেন না। আর খুনোখুনি নয় ; বললেন
- আমার সঙ্গে তোমাকেও থাকতে হবে। কোন রকম চালাকি করবে না । আমি কতকগুলো নাম্বার দেব । যখন যে নাম্বার দেব সেখানে তুমি ফোন করে তুমিই আরণ্যক বসুরায় পরিচয় দিয়ে কথা বলবে। আমি লিখে দেব; আমার সামনে তোমাকে রিহার্সাল করিয়ে কখন কাকে কিভাবে কি বলতে হবে তাও শিখিয়ে দেব । আর আমি যখন যেখানে যাব তোমাকে আমার সঙ্গে থাকতেই হবে ।
অগত্যা অনন্ত সম্মত হল । প্রথমেই ললন্তিকার ফোন নং দিয়ে বললেন - একে বলবে - আগামী কৌশী অমাবস্যায় তোর মেয়েকে বলি দেব ।
অনন্ত ললন্তিকার নাম শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল। মা বাবা হারা অনাথ মেয়েটা প্রশান্তকে বিয়ে করেছে - অনুচিত কাজ করেছে - হয়তো অসামাজিক প্রথা সেটা - তবু তো সে তার ছেলের বউ । তাকে একথা বলে কি ভাবে?
আরণ্যক পেটে একটা গুঁতো মেরে বলল - কই ? ফোন কর ।
অনন্ত ডায়াল করল । ফোন সুইচ অফ । সে কথা আরণ্যককে জানাতেই আর একটা থাপ্পড় বসল তার গালে। তারপর বললেন - প্রশান্তকে বল তোর বাবা মরে নি। সে বেঁচে আছে।
অনন্ত অরবিন্দকে তাই বলল । অরবিন্দ ওরফে প্রশান্ত
বাবা মরেনি শুনে অবাক হল । সে অভয়ঙ্করবাবুকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলল - স্যার , আরণ্যক বসুরায় বলছে আমার বাবা নাকি বেঁচে আছে। অথচ সত্যি হল আমি নিজে তার মুখাগ্নি করেছি ।
অনন্ত শুনতে পেল অরবিন্দর কথা । তার মনে হল বলে ' ওরে সত্যিই আমি মরিনি । তুই তোর কাকার মুখাগ্নি করেছিস । তুই জানিস না পাণ্ডুলিপিটা চুরি হবার পর তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমি প্রাণ হাতে করে পালিয়েছি । এই যে যখন তখন ফোনে তোর খবর নিই সে যে আমি - তোর হতভাগ্য বাবা । তুই হয়তো জেনেছিস বাবার খুন দেখে তোর কাকা পালিয়েছিল তোদের মুখের গ্রাসের দায়িত্ব এড়াবার জন্য ।
আরণ্যক অনন্তকে জুলপি ধরে টেনে দিতেই তার চেতনা ফিরল । অভয়ঙ্করবাবু দেখলেন টাওয়ারের লোকেশন গৌতমবুদ্ধ নগর । তিনি মি: গুপ্তকে তা জানিয়ে দিলেন। মি: গুপ্ত গৌতমবুদ্ধ নগর পুলিশের অধীক্ষককে ফোনে তা' বলে দিলেন ।
এবার যাচাইয়ের জন্য গৌতমবুদ্ধ নগরের কোটাল ওই নাম্বারে ফোন করলেন ।
অনন্ত বলে উঠল- আমি মি: আরণ্যক বসুরায় বোলতা হুঁ। আপ কৌন বলা হেয়।
আরণ্যক ঝট করে ফোনটা ওর হাত থেকে নিয়ে দেখল এটা গৌতমবুদ্ধ নগর পুলিশ সুপারের ফোন।
কথায় বলে অতি চালাকের গলায় দড়ি। আরণ্যক মুহুর্তে তা জেনে গেলেন । এত তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন ছিল না । তাঁর অরবিন্দ সম্পর্কে ধারণাটাই বদলে গেল ।
অরবিন্দ এখন সরকার বাড়িতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আছে । তাকে দুম করে ফোন করতে যাওয়া ঠিক হয়নি । কলটা কেটে দিয়ে অনন্তকে বললেন - পালাতে হবে। আর এক দণ্ডও এখানে থাকা যাবে না ।
বোকার মত অনন্ত চেয়ে রইল আরণ্যকের মুখের দিকে। আরণ্যক তাঁর যাবতীয় শক্তি দিয়ে অনন্তকে টানতে টানতে খেয়াঘাটে গিয়ে নৌকোয় চড়ে বসলেন ।
অন্য পাড়ের গভীর জঙ্গলে গা ঢাকা দিলেন। ফোনের সুইচ অফ করে ওকে নিয়ে গেলেন পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় । তখন গোধূলি বেলা । সূর্য্য হেলে পড়ছে। তাঁরা তরতর করে নামতে লাগলেন পাহাড়ের উল্টো দিকের ঢাল বেয়ে ।
অনন্তের মুখে রা নেই । দুর্বল শরীরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট । কিন্তু আরণ্যকের পশুশক্তি তাকে নামতে বাধ্য করছে ।
সন্ধ্যের কিছু পরে যখন চারিদিক শুনশান জঙ্গলে অন্ধকার ঘণিয়ে এসেছে অনন্ত বলল ' জল, একটু জল' বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল । আরণ্যকের তখন ভীষণ প্রস্রাব পেয়েছে। তিনি একটা শালপাতা মুড়ে ঠোঙার মত করে তাঁর প্রস্রাব ধরলেন । তারপর একটু একটু করে অনন্তের মুখে দিলেন। চোখে তার ছিটে দিলেন। অনন্ত নড়ে উঠল । আবার শুরু হল নীচে নেমে যাওয়া ।
আরও খানিকটা নেমে গিয়ে দেখেন একটা শেয়াল কিছু কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে । ঝোলা থেকে পিস্তলটা বের করলেন । না : অনন্তকে মারতে নয় । বরং নিজেদের সাবধানে থাকতে । সেখানেই রাত্রিবাস শেষে , ভোরের আলো ফুটলে তাঁরা রওনা দিলেন হরগৌরী কা কুঞ্জ নামে একটি আশ্রমে।
উত্তরাখণ্ড মানেই তো অসংখ্য আশ্রমে ভর্তি। তাঁরা পুনরায় সাধুর বেশ পরে আশ্রমে উপস্থিত হলেন ।
এই সব আশ্রমে সাধারণের উপস্থিতি নেই। সাধু সন্তদের আখড়া। কেউ কাউকে চেনেন না মানে কারও প্রতি অন্যের কোন কৌতুহল নেই । সুতরাং নির্বিঘ্নে ওদের দলে মিশে যাওয়া যায় । ওঁরাও সেই ভাবে একাত্ম হয়ে গেলেন। দু'চারদিন এখানেই কাটিয়ে দিলেন ।
( ক্রমশ )
