ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব তিরাশি
পাঞ্জাবী রমণীর বেশে মা ও মেয়ে এবং পুরো সাহেবী ড্রেসে সজ্জন সিং গাড়িতে চেপে বসলেন । তাঁর জাতিগত গোঁফ দাড়ি এবং পাগড়ীর বদলে ফেজ টুপিতে মাথা ঢেকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন সজ্জন সিং। পিছনের সীটে ললন্তিকা এবং তার মেয়ে দামিনী ।
খুবই সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল ললন্তিকাকে । চুপচাপ মেয়েকে ধরে ডসে রইল । সজ্জনও যে কিছুটা ভয় পাননি তা' নয় । পথে যদি বহুরূপীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বা সে যদি কোন কারণে তাদের ফলো করে এই ভয়টা তাঁকেও কুরে কুরে খাচ্ছে।
তবু পূরুষ যেহেতু; কামিনীকে সাহস দিয়ে চলেছেন ।
বললেন - কা জী ইতনা ভয়ভীত কিউ আপ ? কোই কুছ নেহি বিগাড় পায়েগা। ম্যায় হুঁ না !
শান্ত অথচ দৃঢ় ভাবে ললন্তিকা বলল - সেদিন কুম্ভমেলায় আমি ওকে দেখেছি । নাগা সন্ন্যাসীর বেশে থাকলেও আমি ঠিক চিনতে পেরেছি। ভুল হয়ে গেছে, পুলিশকে জানিয়ে দিলে খুব ভালো হোত ।
- তুমি সিওর নাগাবাবা আরণ্যকই ছিল ?
ললন্তিকা বলল - ড্যাম্ সিওর । তুমি আমাকে নিয়ে না এলে ঠিক ধরিয়ে দিতাম ।
আরণ্যক বিষয়ে সব আলোচনা করতে করতে ওরা এগিয়ে চলেছেন হাইওয়ে ধরে।
এর মধ্যে অরবিন্দ, অভয়ঙ্করবাবু দুজনেই খোঁজ নিয়েছেন কোন জায়গা ধরে আসছেন । অভয়ঙ্করবাবু মাঝে মাঝে রুটের কথাও বলে দিচ্ছেন।
সজ্জন সিং বিনীতভাবে বললেন - মেরে পাস জি পি এস লগা হুয়া হ্যায় সাব। কুছ তকলিফ নেহি হোগা ।
ললন্তিকাও ওদের সাথে কথা বলে অনেকটাই ভয় কাটিয়েছে।
ঠিক সন্ধ্যে নাগাদ ওঁরা এটাওয়া এসে পৌছালেন । রাত্রিবাসের জন্য পাওয়া গেল সুসজ্জিত হোটেল; কিন্তু ভাড়া খুব বেশী। দশ হাজার টাকা। সজ্জন সিং কার্পণ্য করলেন না । টাকার চেয়ে নিরাপত্তা অনেক বেশী মূল্যবান।
সারাদিন কোন অশান্তি হয়নি । রাতের বেলা আরণ্যক তাঁর অন্য সীমকার্ড ভরে ললন্তিকাকে ফোন করলেন ।
- তোমরা বেরিয়ে পড়েছ ? আন্দাজেই ছুঁড়ে দিলেন কথাটা ।
- বেশ বেশ আমিও কানপুরে আছি । পার তো দেখা করে যেও ।
ললন্তিকা একটু চালাকি করে বলল - আমরা তো লুধিয়ানায় আছি ।
ললন্তিকা ভাবল ওকে উল্টোদিকে চালিয়ে দিবে। কিন্তু আরণ্যক দেখে নিয়েছে ওরা কানপুরের দিকে আছে।
বললেন - বেশ বেশ। তাহলে কাল আমি লুধিয়ানাই যাচ্ছি। জান তো তোমাদের তিনজনকে একসঙ্গে পেয়ে যাব ভাবিনি ।
ললন্তিকা সজ্জনকে ফোন ধরিয়ে দিল । সজ্জন সিং অকথ্য ভাষায় আরণ্যককে তিরস্কার করলেন ।
- আ জা শালে সামনে, দিখা দুঙ্গা বাহাদুরি
আরণ্যক মাথা গরম করলেন না । বললেন - যো হোটেল মে আপলোগ রহ রহে হ্যায় , উস হোটেল মে ম্যায় ভি হুঁ।
দশ লাখ রুপিয়া ওয়াপস করনে আয়া হুঁ।
সজ্জন তাজ্জব বনে গেলেন । এই লোকটা এত ফেরোশাস দেখে বোঝা যায় না । তিনি ম্যানেজারকে বললেন সব ঘটনা । ম্যানেজার আশ্বস্ত করলেন এই হোটেলে কখনও কোন অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেনি । কারণ বাড়ির নীচের অংশটা একটা পুলিশ ফাঁড়ি।
সজ্জন একটু নিশ্চিন্ত হলেন । বুঝলেন স্রেফ ভয় দেখাতেই এসব নাটক করছে আরণ্যক।
ভোর না হতেই ওঁরা বেরিয়ে পড়লেন । এখান থেকে দুটো পথ দুদিক দিয়ে গেছে। কানপুর দিয়ে ঔরঙাবাদ( বিহার) এবং লক্ষ্ণৌ দিয়ে ঔরঙাবাদে গিয়ে মিশেছে। পাছে ললন্তিকা ভয় পায় তাই সজ্জন লক্ষ্ণৌর পথ ধরে চললেন। সন্ধ্যে সাত আটটার মধ্যেই রাণীগঞ্জে পৌঁছে গেলেন ।
সপরিবার অভয়ঙ্করবাবু তাঁদের সমাদরে বরণ করলেন । পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সঙ্গে । মিঃ গুপ্তকেও ডেকে এনেছিলেন । তিনিও বেশ কিছুটা সময় তাঁদের সঙ্গে কাটিয়ে থানায় যাবার আগে বললেন - এখানে নিশ্ছিদ্র নিরিপত্তায় আপনাদের রাখা হবে । কারণ আমাদের সকলের লক্ষ্য একজনই - মিঃ আরণ্যক বসুরায়।
- মাই বাপ ! না জানে কেয়া কেয়া কাম কিয়া হ্যায় উসনে!
সজ্জন সিং তাঁর অভিজ্ঞতার কথা নিবেদন করলেন মিঃ গুপ্তকে ।
অভয়ঙ্করবাবু বাবু বললেন - আরণ্যক বসুরায় কৌন হ্যায় জানতে হ্যায় আপ ?
সজ্জন হাঁ করে চেয়েছিলেন অভয়ঙ্করের মুখের দিকে।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - হমারা রিস্তেদার ।
সজ্জনের মুখ কালো হয়ে গেল । অভয়ঙ্করবাবু অভয় দিয়ে বললেন - প্লীজ ডোন্ট বি এফ্রেইড অফ হিম । উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট টু গেট হিম ব্যাক। ইসলিয়ে হমলোগ পুলিশ কে সাথ মিলকর য়ে ইন্তজাম কিয়া ।
সজ্জন সিং নিশ্চিন্ত হলেন ।
বললেন - ছোড়িয়ে জী। অব আইয়ে এক দুসরে কে সাথ জান-পহচান করে।
গোপালকৃষ্ণ বাবুরাও রয়ে গেছেন এখানে । তাঁরাও পরিচয় করলেন । অবাক করার মত ব্যাপার হল মেয়েরা কেউ ললন্তিকাকে দেখে নাক সিঁটকে পিছু হঠল না । বরং তাকে নির্ভয় দিয়ে একান্ত আপন করে নিল ।
আরণ্যক হিমালয়ের কোলে এক গুহায় বসে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন । তিনি খবর পেয়ে গেছেন এন আই এ তদন্তে জেহাদী বিস্ফোরণের তত্ত্ব ধোপে টেকেনি। খবরটা দিয়েছিল তার অফিসের মানে কনকাঞ্জলী প্রকাশনের ঝাড়ুদার গুগুন ; যার আসল নাম গুইরাম গুণ । আরণ্যকের বিশ্বস্ত কর্মচারী। আরণ্যক ওকে লাড্ডু সিং নামে ডাকতেন । লাড্ডুর মত ফান্টুস চেহারার গুগুন খবরটা পাচার করে দশ হাজার টাকা পেয়েছিল অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে।
তিনি গগুন ওরফে লাড্ডু সিং কে বললেন - রাণীগঞ্জের ঠিকানা দিচ্ছি । সাবধানে ওখানকার খবর জোগাড় করে দিতে পারলে পঞ্চাশ হাজার পুরস্কার দেব ।
এত টাকার লোভ ছাড়তে পারেনি গুগুন। চলে এসেছিল রাণীগঞ্জে । এক ধর্মশালায় ঠাঁই নিয়ে চেষ্টা করছিল অভয়ঙ্কর সরকারের বাড়ি পর্য্যন্ত পৌছাতে। বারবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ওদিকে যেতে পারেনি। অপরিচিত লোক দেখলেই পাড়ার লোকেরা রে রে করে তেড়ে আসে । গুগুনকেও পিছিয়ে যেতে হয় । তা ছাড়াও ঘন ঘন পুলিশের টহলদারি এড়ানোও তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
একদিন কিছু কাঁচা শাক-সবজি কিনে বসে পড়ল ছেঁড়া চটে পসরা সাজিয়ে চীনাকুঠি মোড়ের নয়া সবজি বাজারে । কয়েকদিনের মধ্যে অন্যান্য সবজিওয়ালাদের সঙ্গে আলাপ জমালো। মুখে মুখে রেঞ্জার সাহেবের নাম শুনে লোকটিকে চিনে ফেলল । তার মধুর নম্র ব্যবহারে আকৃষ্ট হয়ে রেঞ্জার সাহেব তার কাছে তাজা সবজি কেনা শুরু করলেন ।
দিন কয়েকের ভেতর তাদের মধ্যে হৃদ্যতা বাড়ল ।
রেঞ্জার সাহেব বললেন - জানো হে লাড্ডু ; তোমার চেহারা যেমন লাড্ডুর মতই মিষ্টি ; ব্যবহারটিও তেমনি।
থাকো কোথায় ?
লাড্ডু বলল - আজ্ঞে ?
- বাড়ি ? বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করছি।
- আজ্ঞে আমার বাড়ি অণ্ডালে । রোজ যাওয়া আসা করি।
- অণ্ডালে বেচ না কেন ?
- আজ্ঞে এখানে দুটো পয়সা বেশী লাভ হয় তো। তাই চলে আসি । এমন কিছু দূর তো নয় ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - কতটুকু জমিতে চাষ কর?
- আজ্ঞে তেমন জমি তো নেই । ঝুপড়িতে থাকি । রেলের জায়গায় কলাটা মূলোটা চাষ করে খাই।
আর কোন প্রশ্ন করার আগেই বলে - কোন পিছুটান নেই তো ! একা মানুষ। সকালে চলে আসি। দুপুরে গিয়ে চাষ দিই।
- বেশ। আজ গেঁটে শাকটা বেশীই দিও। ওই ধর কিলো দেড়েক । বাড়িতে অতিথি এসেছেন তো !
লাড্ডু দেড় কিলোর বেশীই দিয়ে দেয় একই দামে।
- আপনাদের বুঝি খুব বড় পরিবার ?
- মোটামুটি বড়ই । এখন অতিথি নিয়ে জনা বিশেক তো হবেই । নাও বল কত দেব ?
লাড্ডু হিসেব করে বলে পঁচাত্তর টাকাই দিন স্যার ।
অভয়ঙ্করবাবু একশ টাকা দিয়ে মাছের বাজারে চলে গেলেন । লাড্ডু তাঁকে খুঁটিয়ে পরখ করতে লাগল ।
( ক্রমশ )
