ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
চতুর্থ পর্ব
শরতের নির্মল আকাশ । সন্ধ্যে থেকে পূর্ণিমার চাঁদ রূপালী আলোকের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে । শহরের নিয়ন বাতির শত প্রচেষ্টায় সে আলোক বিন্দুমাত্র মলিন করতে পারেনি ।
আরণ্যক বসুরায়ের গাড়িটা তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে কৃষ্ণপুরের দিকে । গন্তব্য গোপালকৃষ্ণ চাকলাদারের বাড়ি । ভি আই পি রোডে উল্টোডাঙার দিক থেকে আসতে আসতে উড়ালপুল ছেড়ে বাঁ দিকে বাঁক নিল গাড়িটা । এবার উড়ালপুলের নীচ দিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে উল্টোডাঙার দিকে যেতে কয়েক গজ দূরে দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয়কে ডান পাশে রেখে থাকদাঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল । কৃষ্ণপুর মেইন রোড । রাস্তা অপ্রশস্ত । মুখোমুখি দুটো গাড়ি অবশ্য অনায়াসে যেতে আসতে পারে ।
কিন্তু অটো আর সাইকেল রিক্শার জন্য যেখানে সেখানে জ্যাম লেগে যায় । জনবহুল এলাকা। গাড়ির গতিবেগ বাড়ানো যায় না । আবশ্য একটু ফাঁক পেলেই অটোগুলো সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে যায় । চারচাকার এই এক যন্ত্রণা । ওভারটেক করতে গেলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে ।রবীন্দ্রপল্লী ,ঘোষপাড়া , বারোয়ারীতলা পেরিয়ে মিশন বাজারের কাছাকাছি আসতেই আবার জ্যাম ।
মিনিট কুড়ি পরে গাড়ি ঢুকল একটা কমপ্লেক্সে। সেখানেই দোতলায় এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকেন গোপালকৃষ্ণ চাকলাদার এণ্ড ফ্যামিলি ।
হন্তদন্ত হয়ে আরণ্যক দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন । কল্যাণী ঝুপ করে প্রণাম সেরে বলল - ওমা ! মেসোমশাই যে ! আসুন আসুন ।
- মঙ্গল হোক মা !
বলে আরণ্যক ' দাদা ! ও দাদা ! করে ডাকতে ডাকতে গোপালবাবু ও বনলতাকে প্রণাম সেরে কোন রাখঢাক না রেখে বললেন - দাদা! একটা বিপদে পড়ে এই অসময়ে এলাম । কিছু মনে করবেন না।
বনলতা দেবী - এ কেমন কথা আরু ! তুমি আসবে তার আবার সময় অসময় কি ! বস আগে। আমি চা জলখাবারের ব্যবস্থা করি ।
বনলতা দেবী চলে গেলেন কল্যাণীর সঙ্গে রান্নাঘরে । গোপাল বাবু বললেন - বল ভায়া ! কি বা হেতু আগমন তব ?
- দাদা ! ভীষণ বিপদ ! জনৈকা মহিলা মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে আমার নামে উকিলের চিঠি পাঠিয়েছে।
- আহ্ বিপদটা কি সে টা বলবে তো ! মামলা মোকদ্দমার কথা পরে হবে । আগে কি ঘটেছে বল ।
- দাদা ! মেয়েটি অনেকদিন থেকে লেখালেখি করে । কিছু বইও আমি প্রকাশিত করেছি।
- এতে দোষণীয় কি হয়েছে ?
- দাদা ! আপনি একজন আইনজীবী। এই দেখুন নোটিশটা । পড়লেই বুঝতে পারবেন।
গোপালকৃষ্ণ নোটিশ পড়লেন । তারপর মুখ গম্ভীর করে বললেন - হুমম্ ! মেয়েটি একটু বেশী চালাকি করেছে। আচ্ছা, তোমাদের যে চুক্তিপত্র হয়েছিল ওটা দাও তো! মিলিয়ে নিই।
আরণ্যক বসুরায় পড়লেন সমস্যায় । ওই চুক্তিপত্র দেখালে নিজের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। তাছাড়া পরিবারের সকলে জানতে পারলে তাঁর উপর একটা ঘৃণার মনোভাবও জন্মাতে পারে । আরণ্যক সেটা এড়িয়ে যেতে বললেন - যা : ওটা তো আনতে ভুলে গেছি। ভাবলাম নোটিশ পড়লেই বুঝে যাবেন । এখন কি হবে, তাহলে ?
গোপালকৃষ্ণ বাবু বললেন - না ভায়া, ওটা তো জরুরী। আসল চুক্তিপত্র না দেখলে বুঝব কি করে নোটিশের ওজন কেমন ! আচ্ছা, মেয়েটির সঙ্গে তোমার এমনই কোন ঘনিষ্ঠতা নেই তো ?
- একদমই না দাদা ! আর পাঁচ জন যেমন আসে তেমনই সম্পর্ক হয়েছে। কম অর্থের বিনিময়ে লেখা প্রকাশ করেই তো এত সুনাম অর্জন করেছি। আপনি তো জানেন সবই।
- আমি জানলে তো হবে না। কোর্টকে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে জানাতে হবে । নচেৎ একতরফা ফয়শালা হয়ে যেতে পারে ।
বনলতা এবং কল্যাণী চা জলখাবার এনে টেবিলে রাখলেন ।
বনলতা বললেন - কণা কেমন আছে ?
আরণ্যকের মাথা তখন বনবন করে ঘুরছে। কনকলতাকে যে তিনি কণা বলে ডাকেন সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে অবাক হয়ে বললেন - কণা ? কে কণা ?
- আ ম'লো যা ! নিজের বৌকেও ভুলে গেলে। কি এমন রাজকার্য করছ ?
আরণ্যক এবার মেকি হাসি হেসে বললেন - ওহো! কণা, মানে কনক - তা সে খুব ভালো আছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বনলতা দেবী বললেন - আর ভালো আছে ! তিন তিনটে বছর পেরিয়ে গেল, এখনও কোন ছেলেপুলে নিতে পারল না ! আচ্ছা আরুৎ! তোমরা কি কোন পিলটিল ইউজ কর ?
এক বিপদ থেকে আরেক বিপদ আসতে চলেছে দেখে আরণ্যক বললেন - কি যে বলেন দিদি ! আমিও তো আপনার মতই ছেলে মেয়ে যা হোক একটা চাই। কিন্তু দুঃখের কথা কি বলব কনক এখনও তাতে রাজী নয় । বলছে আরও দুটো বছর যাক ।
বনলতা কণার উপর রেগে গেলেন ।
- দেখছি ওকে । ও বউমা !
কল্যাণীকে বললেন - তোমার ফোন থেকে কণাকে ফোন লাগাও তো ! আজ ওর একদিন কি আমার একদিন হয়েই যাক ।
ভয় পেয়ে আরণ্যক বললেন - আ: দিদি ! ছাড়ুন না এ সব । ও তো মন্দ কিছু বলেনি ।
- ওওও , তার মানে তোমরা যোগসাজশ করে এমন করেছ।
গোপালকৃষ্ণ এবার হস্তক্ষেপ করলেন ।
- বণি ! কি হচ্ছেটা কি ? ও আমার কাছে এসেছে একটা জরুরী কাজে ! আর তুমি স্বভাবদোষে কি সব বকে যাচ্ছ?
- বেশ করছি। তাতে তোমার কি ? তুমি তোমার কাজ কর। আরু , যাবার আগে আমার সঙ্গে একবার দেখা করে যেও । এই বুড়োটার কাছে থাকলেই এখনই যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে ।
বনলতা হনহন করে চলে গেলেন। গোপালকৃষ্ণ বললেন - ভায়া ! কেসটা বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে । তুমি বরং কাল আরেকবার এসো । চুক্তিপত্রটা চাইই ।
হতাশ হয়ে আরণ্যক বললেন - তাহলে কি এবার জেলেই যেতে হবে আপনি থাকতে ?
- তা তো বলিনি। তবে ওটা পেলে আমার সুবিধে হোত। ভালো ভাবে মনে করে দেখো কোথায় রেখেছ ।
- সে তো দেখবই। ঠিক আছে দাদা, তাহলে আজ আসি। কাল কিম্বা পরশু ওটা পেলেই আবার আসব।
আরণ্যক যেমন এসেছিলেন তেমনই চলে গেলেন । ঘন্টাখানেক পর বনলতা বললেন - আরু চলে গেছে ! দেখাও করে গেল না ! এসবই তোমার জন্য হয়েছে।
গোপাল বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন - আচ্ছা, তুমি কি সবেতেই আমার দোষ ঘেঁটে বেড়াও না কি ?
বনলতা দেবী মুখ ফিরিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
আরণ্যক বসুরায়ের আরবান ব্লু অডিটা যখন এপার্টমেন্টের মেন গেট ছেড়ে রাস্তায় নামল জানালার কাঁচ দিয়ে তিনি দেখলেন ললন্তিকা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একটা অটোয় চাপল ।
মিঃ বসুরায় ড্রাইভারকে বললেন - নিউটাউন ব্রীজ দিয়ে চল ।
গাড়ি ঘুরিয়ে আরণ্যক নিউটাউনের দিকে গেলেন । ললন্তিকার চোখে পড়ল চেনা অডিটা। ওটা তো আরণ্যকেরই। অবশ্য নাম্বার প্লেটটা চোখে পড়েনি । তাই ভাবল অন্য কেউ তো হতে পারে ! এমন একটা অড জায়গায় আরণ্যকের মত ব্যক্তির আসা অবিশ্বাস্য । সুতরাং সে চিন্তা ছেড়ে চুক্তিপত্রের কপি নিতে সে আরণ্যকের অফিসের দিকে গেল । ভীষণ ভদ্রলোক ভেবেছিল তাঁকে । তাই চুক্তিপত্রের কপি নিয়ে কোন প্রশ্ন এতদিন করেনি । যদি তার লেখাগুলো প্রকাশিত না করে !
অফিসে গিয়ে ললন্তিকা দেখল ঝাঁপ বন্ধ। ভেবে পেল না, এই সন্ধ্যেবেলাতেই সংস্থা বন্ধ থাকার কথা নয় । তাহলে কি আরণ্যক কোন ভালো ব্যারিস্টারের খোঁজে কৃষ্ণপুরে এসেছিল !
সাতপাঁচ ভাবার সময় নেই ললন্তিকার । ব্যাগ থেকে উকিলের নোটিশ কপিটা বের করে ভালো করে আরেকবার পড়ে নিল । বেশ জব্বর কেস দেওয়া হয়েছে। এবার বুঝবে আরণ্যক বসুরায় ! কত ধানে কত চাল !
