ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব আটাত্তর
আরণ্যক বসুরায় অবগত হয়েছেন জাহিদদের কেস চলে গেছে সি আই ডির হাতে। আপাতত অনেকটাই স্বস্তিতে রয়েছেন তিনি। কিন্তু নাটের গুরুরা তো এখনও সশরীরে বর্তমান। প্রশান্ত মোহন সরখেল ওরফে অরবিন্দ এবং ললন্তিকা সেন ওরফে কামিনী সিং।
এই দুটোকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলে হৃত রাজ্য ফিরে পাবার সম্ভাবনা প্রবল । অথচ ওরা দু'জন এমন অবস্থায় আছে চট করে তাদের গায়ে হাত দেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয় ।
ললন্তিকা যদি বা একটু সুবিধেমত জায়গায় আছে কিন্তু অরবিন্দ - সে তো এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে । অথচ এই অরবিন্দকেই আগে সরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে ।
সে কথা ভেবেই রাণীগঞ্জে যাওয়া ; কিন্তু ওই চার শুয়োরের বাচ্চা - সব মাটি করে দিল । কি প্রয়োজন ছিল অরবিন্দকে কাছে টানার ? একটা গুলিতেই তো সাফ করে দেওয়া যেত । কি জানি হতচ্ছাড়াগুলোর কি মতলব ছিল ! নে এবার সাজা ভুগে মর ! একেই বলে সুখে খেতে ভুতে কিলোনো !
নিজেকে ভীষণ ধূর্ত ভাবেন আরণ্যক বসুরায়। মনে করেন পুলিশ গোয়েন্দাদের চোখে ধূলো দিয়ে কেমন তাদেরই নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন । গন্ধ পাচ্ছে ওরা কিন্তু তার উৎপত্তিস্থল খুঁজে পাচ্ছে না ।
আবার বলিহারি মিঃ সজ্জন সিং। ভালোমানুষীর মূল্য তোমাকে পেতেই হবে।
ট্রেনে তাঁর কেপমারি হয়েছে বলে নয়ডায় দরজায় দরজায় সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগলেন । কেউ খাবার দিয়ে, কেউ পুরানো জামা কাপড় বা টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে লাগলেন । এ ভাবে চলতে চলতে তিনি সজ্জন সিং এর প্রতিবেশী শ্রী প্রদ্যুম্ন ঘোষাল মহাশয়ের বাড়ির দরজায় টোকা দিলেন ।
আজ তিনি এসেছৈন ভিখারীর মত । জানতেন প্রদ্যুম্ন বাঙালি। তাই বাংলাতে কথা শুরু করলেন। আর কথা মানে তো সেই কেপমারির গল্প । আগন্তুক বাঙালি দেখে ঘোষাল মশাই তাঁকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এলেন ।
যথাসম্ভব আপ্যায়ণও করলেন । সন্ধ্যে হয়ে গেছে দেখে আরণ্যাক বললেন - আমি তাহলে আসি আজ্ঞে! সন্ধ্যে হয়ে গেছে একটা আশ্রয় তো খুঁজতে হবে রাত কাটাতে। তারপর সকালের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যাব ।
প্রদ্যুম্ন ঘোষাল বললেন - বাড়ি কোথায় আপনার ?
- আজ্ঞে আসানশোল ।
- আসানশোল ! তা' আসানশোলের কোন জায়গায় আপনার বাড়ি?
- আজ্ঞে নাম বললে কি চিনতে পারবেন ?
- কেন পারব না ! আমারও বাড়ি তো আসানশোলে । কর্মসুত্রে এখানে এসে এখানকার বাসিন্দা হয়ে গেছি ।
- ওও । তবে তো চিনবেনই। আমার একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি আছে মহীশীলা কলোনীতে । ওই যে আসানশোল সরকারি হাসপাতালের ঠিক পিছনে ।
- তাই ? প্রদ্যুম্ন ঘোষালকে মনে হল তিনি নস্টালজিয়ায় ভুগছেন ।
- যখন ছোট ছিলাম জায়গাটা একেবারেই ফাঁকা ছিদ । জঙ্গল আর হাসপাতালের জঞ্জালে ঠাসা ছিল । তবু ওখানেই আমরা ফুটবল খেলতাম। সন্ধ্যে হলেই দুষ্কৃতীদের দখলে চলে যেত ।
আরণ্যকের এসব শুনতে ভালো লাগবে কেন ? তিনি বললেন - আজ্ঞে এবার উঠি ! অন্ধকার হয়ে এল ।
প্রদ্যুম্ন ঘোষাল বললেন - বসুন বসুন , যাবেন কোথায় ?
- আজ্ঞে দেখি স্টেশনের প্লাটফর্মে কোথাও থেকে যাব।
- আরে দূর মশাই ! আমার দেশের লোক; জেনেশুনে ছেড়ে দিই কোন মুখে ? আপনি আমার বাড়িতেই থেকে যান । সারা রাত দেশের কথা বলব,শুনব ।
আরণ্যক খুশি হলেন তবে আসানশোল সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণা নেই বলে চিন্তিত হয়েও পড়লেন । ঠিক করলেন তিনি হবেন শ্রোতা । হুঁ হাঁ না করে কাটিয়ে দেবেন ।
ডিনারের আয়োজন সেরে প্রদ্যুম্ন ঘোষাল বললেন - আরে হাঁ, আপনাকে তো বলতেই ভুলে গেছি ! আমার প্রতিবেশী মাননীয় সজ্জন সিং মহাশয় দু'তিনটে বাড়ির পরে থাকেন । তিনি এক বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছেন। তাঁদের একটি ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে। চলুন তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। সজ্জন সিং খুবই ভালো লোক । বিয়ে করছিলেন না শুধু ছেলেপুলে হলে ঝক্কি পোয়াতে হবে বলে । আসল কারণটা অবশ্য জানি না ।
ঘোষাল সাহেব আসলে জানেন ; অচেনা জনের নিকট প্রকাশ করতে চাননি ।
- যাই হোক, তিনি আমার কথায় বিয়ে করতে সম্মত হন । তবে শর্তসাপেক্ষে। তাঁর শর্ত দিয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় আর তারপরই ওই মেয়েটিকে নিয়ে তাঁর কোন আত্মীয় ওঁকে সজ্জনকে দিয়ে যান । দেখুন এ জন্যই বলে - জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে - তিন বিধাতা নিয়ে ।
আরণ্যক বললেন - খুব খাঁটি কথা ।
- একজাক্টলি । নইলে ভাবুন তো কোথায় পাঞ্জাব আর কোথায় বাংলা ! বিধাতার লিখন তো অবশ্যই । নিন, চলুন পরিচয় করে রাখুন , ভবিষ্যতে কাজে আসবে ।
আরণ্যক তো সব কিছুই জানেন । আর দ্বিতীয়বার প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছেন নিশ্চয়ই ললন্তিকাও চিনতে পারবে না ।
ঘোষাল সাহেব সজ্জনকে ফোন করে জানালেন ওঁরা আসছেন ।
ঘরে ঢুকতেই সজ্জন সিং আপ্যায়ণ করলেন - আইয়ে আইয়ে পরদুমন সাব । বৈঠিয়ে।
বলে পরিচয় করলেন নয়া আগুন্তকের সাথে । ললন্তিকা কফি ও বিস্কুট সার্ভ করল । অচেনা জনকে নিয়ে ঘোষাল সাহেব এসেছেন । রাত দশটা পর্য্যন্ত সেখানে কাটিয়ে ঘোষাল এবং বসুরায় বাড়ি ফিরলেন । সজ্জন বা ললন্তিকা টেরও পেল না আরণ্যক তাদের অন্দরমহল দেখে নিল ।
ঘোষাল সাহেব গোটা বাড়িটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরণ্যককে দেখালেন । স্ত্রীর সঙ্গে তো আগেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ।
আরণ্যক বাড়ির ভেতরটা বেশ ভালো ভাবে দেখে নিলেন । কোথায় কি আছে না আছে সব দেখে রাখলেন । রাতের অপারেশন শুরু করার আগে ডিনার তো করতেই হবে ।
কথায় বলে ' দুর্বৃত্তের ছলের অভাব নেই। আরণ্যকের মত আকৃতজ্ঞের তো ভাণ্ডার পরিপূর্ণ।
ডিনার টেবিলে ওঁরা তিনজন বসতেই আরণ্যক বললেন - ছেলে মেয়েরা কোথায় ? দেখছি না তোৎ!
ঘোষাল সাহেব বললেন - ছেলে লণ্ডনে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি - সে তো শ্বশুর বাড়িতে। এখন আমরি শুধু দু'জনই থাকি ।
আরণ্যক মনে মনে বললেন - বাহ খুব ভালো।
তারপর ঘোষাল সাহেবকে বললেন - তাই ভাবছি । এত বড় বাড়ি আর লোকজন নেই!
খেতে খেতে ঘোষাল সাহেব বললেন - আজ রাতটা গল্প করে কাটিয়ে দেব । সুমিতা তুমি আজ আমাকে কিছু বল না যেন । দেশের লোক ! খত কথা জমে আছে পেটে।
সুমিতা দেবী হেসে বললেন - বেশ বেশ ।
আরণ্যাক এমনই একটা সুযোগ খুঁজছিলেন। ওদের কথায় হেসে হেসে ইচ্ছে করেই জলের গ্লাসটা কনুই দিয়ে ঠেলে দিলেন । জল সমেত গ্লাস নীচে গড়িয়ে পড়ল । আরণ্যক লজ্জা পাবার ভান করলেন ।
- ইটস ওকে, ইটস ওকে বলে ঘোষাল সাহেব সামাল দিলেন।
সুমিতাকে বললেন আর একটি অন্য গ্লাসে জল দিতে।
সেই সুযোগে আরণ্যক একটু বেশী ডোজের ঘুমের ওষুধ ওদের দুটো গ্লাসে ফেলে দিলেন । কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তা গলে গিয়ে জলের সাথে মিশে গেল ।
রাত এগারোটা নাগাদ খাওয়া দাওয়া শেষ হলে ঘোষাল সাহেব এবং আরণ্যক ড্রয়িং রুমে এলেন গল্প করতে ।দশ মিনিট পর ওষুধের কাজ শুরু হল । সুমিতা দেবী এবং ঘোষাল সাহেব যে যেখানে ছিলেন ঘুমিয়ে পড়লেন । আরণ্যকের চোখ দুটো জ্বলে উঠল । এই সন্ধিক্ষণ ! আরণ্যক নি:সন্দেহ হতে ওদের দুজনকে উল্টে পাল্টে দেখে নিলেন । যে ঘুম ঘুমিয়েছে, আগামীকাল বেলা বারোটার আগে তা ভাঙবে না ।
( ক্রমশ )
