ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব ছেষট্টি
আপাতত আরণ্যক পলাতক । এখানে সেখানে যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন । ললন্তিকা একটা স্থায়ী আস্তানাও পেয়ে গেছে।
এদিকে অরবিন্দ অভয়ঙ্করবাবুর ছত্রছায়ায় দিনাতিপাত করছে । আর উলুখাগড়ার দলের অনেকেই মৃত; যারা এখনও বেঁচে বর্তে আছে ; পুলিশের তাড়া খেতে হচ্ছে না , তারা এবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
যেমন জামির, জাহির, জাহিদ, জহিরুল । এরাই এখন অন্ধকার দেশের রাজা । মাঝেমধ্যে দলাদলি যে হয় না তা' নয় ; তবে তা নেহাতই নিজেদের মধ্যে পুলিশের চোখের আড়ালে । ওরা এখন ডাকাতির দল গড়েছে।
রাতের আঁধারে ঘুমের দেশের তারাই এখন প্রহরী । জাহিদ বলল - মাথাগুলো তো ফেরার । ছল এবার আমরা কাজ দেখাই। পেটে টান পড়ছে তো !
জাহিরুল বলল - এখানে আর কিছু হবে না রে ! চল দক্ষিণে যাই।
জামির বলল - দক্ষিণে কোথায় ?
জাহিরুল বলল - কত জায়গা আছে। বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর।
জাহিদ বলল - ধূর ! ওখানে কাঁচা পয়সা কোথায় ? চাষীবাসীদের জায়গা । কিস্যু পাবি না। যদি যেতেই হয় তো চল আসানশোল -দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে ।কয়লাখনির দেশে ।
জামির বলল - ওখানে কি কয়লা কাটার কাজ করব নাকি? দৈনিক মজুরিতে ?
জাহিদ বলল - এখানেই তো আসল কাজ আছে রে ! এতদিন তো গোরু পাচার, চামড়া পাচার করলি ; কি এমন রোজগার করেছিস ? এবার চল কয়লা পাচার করে বড়লোক হই ।
যুক্তি মন্দ নয় । জামির বলল - এক ট্রাক কয়লার কত দাম রে ?
- বিশ কিলোর বস্তা আটশো টাকা। এবার হিসেব করে নে এক ট্রাকে কত কয়লা থাকে !
জাহিরুল রাজী হয়ে বলল - দিনক্ষণ ঠিক করে সবাইকে জড়ো হতে বল । প্রয়োজনে ওখানকার কোন মাফিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না ?
- আবে ! কেতাদুরস্ত মাফিয়াকে তো আমরা সবাই খুব ভালো করে চিনি !
এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে জাহিদ বলল - কেন ? আমাদের অরবিন্দ ভাই আছে না ?
সমস্বরে বাকিরা বলল - অরবিন্দ ? কোথায় আছে সে ?
জাহিদ বলল - একদিন আমায় ফোন করে বলেছিল ওখানে কোন গীতা আশ্রমে সে লুকিয়ে আছে । জায়গাটা কি গঞ্জ না গেরাম বলেছিল মনে নেই ।
জামির বলল - রায়গঞ্জ ?
- না না , তবে তেমনই এক নাম ছিল । ও মনে পড়েছে। রাণীগঞ্জ ।
সবাই মেনে নিল - হাঁ ওটা কয়লার দেশ । মাটির নীচে কালোমাণিকে ভর্তি । অরবিন্দকে ফোন লাগা। খবর নে।
অরবিন্দ তখন ললন্তিকার সঙ্গে কথা বলছিল ।
- অরুদা ! প্লীজ ভুল বুঝো না আমায় । আমি আরণ্যকের সঙ্গে ইচ্ছে করে আসিনি। ও জোর করে আমাকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে । তারপর এখানে এক হোটেলে তুলেছিল । এদিকে পুলিশ তার সব ব্যাঙ্ক একাউন্ট সীল করে দিতেই হাতের পাঁচ যা ছিল শেষ হয়ে এল । তখন আমাকে বলল তোমার কাছে ফিরে যেতে ।
অরবিন্দ বলল - আর ফিরে এসে কি করবে ? আমিও গীতা আশ্রম থেকে পুলিশের তাড়া খেয়ে কোনমতে পালিয়েছি ।
- আমাকে বলতে দাও। আগে পুরোটা শোনো । আরণ্যক আমায় আবার ঠকিয়েছে । পাঁচ লাখ টাকায় আমাকে এক পাঞ্জাবী লোককে বিক্রি করে দিয়ে পালিয়েছে । আমার ভয় হচ্ছে ভীষণ !
- তোমার আর কোন কথা শুনতে চাই না । তোমার চাহিদা পূরণ করে এমন পুরুষ জন্মায়নি। আমি তো কোন ছার !
- অরুদা ! প্লীজ! এবারকার মত ক্ষমা করে দাও। তারপর তুমি যা বলবে আমি তাই করব ।
- প্রমিস ?
- প্রমিস প্রমিস প্রমিস ।
- তাহলে যা বলছি কর - তুমি ওখানেই থেকে যাও । আসার নামটি নেবে না ।
- অরুদা ! এরা যদি আমাকে প্রস্টিটিউটে বিক্রি করে দেয় ?
- খুব ভালো হবে । তোমার আজন্মের সাধ মিটবে। এবার ছাড়ো । আমার সাহেব আসছেন।
বলে ফোন রেখে দিল । ললন্তিকা কোন উপায় না দেখে অনিচ্ছাসত্বেও সজ্জন সিং এর আতিথ্য স্বীকার করে নিল ।
কললিস্টে জামির, জাহিরুল, জাহিদৈর মিসড কল দেখে অরবিন্দ গা করল না । যা ছেড়ে এসেছে নতুন করে তাকে আর ধরে রাখতে চায় না সে । ফোন করলেই কেটে দেয় বা ফোন সুইচ অফ করে দেয় ।
অভয়ঙ্করবাবু এসে বললেন - প্রশান্ত ! তোমাকে বলতে হবে আরণ্যকের স্ত্রী কনকলতাকে শুধু শুধু মারলে কেন ?
অরবিন্দ বলল - আরণ্যক স্যার প্রচুর টাকা দেবেন বলেছিলেন । বেশ মোটা টাকা এডভান্সও দিয়েছিলেন। তখনও আমি ওনাকে মারিনি বা ধরে নিন আমার খারাপ কাজ অযথা করতে বাধছিল । কিন্তু যেদিন ললন্তিকা ওঁর অফিস থেকে বাবার পাণ্ডুলিপিটা বাটপাড়ি করে নিয়ে এল তখন আমার কাছে জলের মত সব পরিষ্কার হয়ে গেল । বাবার করুণ ভয়ার্ত মুখটা বারবার মনে পড়ল ।
আমি ঠিক করলাম আজই আরণ্যককে শেষ করে দেব। সেই মত আরণ্যকের বাড়ির দিকে আসছিলাম । মেইন রোডে এসে মুখোমুখি কনকদেবীর দেখা পেলাম। রাস্তাটা তখন জনশূন্য ছিল । আমি ভেবে দেখলাম এই সুযোগ। বাড়িতে অথর্ব আরণ্যক একা আছে। আরও ভেবে দেখলাম দুটো কাজ একসঙ্গেই করি ।
কনকলতা দেবীর হয়তো তাড়া ছিল । আমি রাস্তার মাঝখানে তাঁর পথ আটকে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন - কে তুমি বাবা ?
বললাম - তোমার যম ।
একটা লোডেড ট্রাক দ্রত গতিতে আসছিল । আমি হ্যাচকা টান দিয়ে ওনাকে কাছে টেনে নিলাম। উনি ভাবলেন বেঁচে গেছি। ট্রাকটা তখনও যাচ্ছিল। আমি জোরে ধাক্কা দিয়ে ওনিকে রাস্তায় ফেলে দিলাম । দশ চাকার লোডেড ট্রাকের তলায় ছুঁড়ে দিলাম । ট্রাক পিষে চলে গেল । আমিও দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে সোজা আরণ্যকের রুমে ঢুকলাম ।
আমার হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। আরণ্যকের গলা চেপে ধরলাম - জোচ্চোর ! বাবার বই নিজের নামে করে যশ কুড়ানো ! তোর কাজ করে দিয়ে এলাম এবার আমার কাজ করি ।
আরণ্যক শুধু ফ্যালফ্যাল চেয়ে ছিল । আমার নজর পড়ল আলমারিতে। খুলে দেখি নগদ, সোনাদানার ছড়াছড়ি । একটা বড় থলেতে যতটুকু ধরে ভরে নিলাম। এমন সময় দরজায় এসে দাঁড়ালেন আরণ্যকের প্রতিবেশী সমরেশ্বর । তাঁর সাথে কথা কাটাকাটি চলছিল । পরিচয় দিলাম আরণ্যকের ভাইপো বলে। তিনি চলে যেতেই গোপালকৃষ্ণ বাবুকে ফোনে মৃত্যু সংবাদ দিলাম । তবে ওনারা যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবেন - ভাবিনি। বনলতা নামের ভদ্রমহিলা আমাকে সন্দেহ করলেন। তাঁর ছেলে রুদ্রকে সে কথা বলতেই রুদ্র আমার সঙ্গে কথা বলতে এলেন । আমি বিনয়ের সঙ্গে ওর সাথে কথা বলে ম্যানেজ করে বেরিয়ে গেলাম ।
পথে হারুর সঙ্গে দেখা । ওকে মালকড়ি কিছু দিয়ে শ্মশানে গিয়ে অদ্ভুত আচরণ করার পরামর্শ দিলাম। আমার ফোন টেলিকনফারেন্স মোডে রেখে হারুকে নির্দেশ দিতে লাগলাম। রুদ্র যতবারই আমাকে ফোন করে আমি হারু দুজনেই শুনতে পাই। উত্তর দিলে ওরাও শোনে । হারুর ভুতুড়ে চেহারা , অন্ধকার রাত, আমার গলা মিলে পরিবেশ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। রুদ্র ভাবে ভুতের পাল্লায় পড়েছে।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - এত বুদ্ধি তোমার ! পড়াশোনা করলে তো আজ নিজে একজন নামকরা ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে !
অরবিন্দ মাথা নীচু করে শুনল। কোন মন্তব্য করল না ।
( ক্রমশ )
