ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব একশত
হালকা ডিনার করল ললন্তিকা। জানে আজ রাতে ঘুম আসবে না । সজ্জন সিং তা' লক্ষ্য করলেন । কিন্তু কিছু বললেন না । ললন্তিকা মাঝে মধ্যে এমন করে থাকে। কখনও বা না খেয়েই শুয়ে পড়ে । কিছু বলতে গেলে বলে
' গা গুলোচ্ছে , আজ খাবার ইচ্ছে নেই' ইত্যাদি। ভোর রাতে এনকাউন্টার। হয়তো সেজন্য ললন্তিকা চিন্তিত । আর তার বসল তার এই হালকা ভোজন ।
সজ্জন বলেন - এত লাইট খাবার খেয়ে রাত কাটবে ?
ললন্তিকার জবাব দিতে ইচ্ছে হল না । বলল - আর একটু চিকেন দিই ?
বেশ খাদুড় লোক সজ্জন , লোভীও । চিকেন হাণ্ডির পুরোটাই সাবাড় করে দিলেন । তন্দুরি রুটিও গোটা ছয়েক খেয়ে নিলেন । তারপর মস্ত ঢেকুর তুলে ঘুমের পিল খেয়ে শুয়ে পড়লেন ।
ললন্তিকা জানে এই পিলের কার্য্যকারিতা । আগামীকাল সকাল দশটার আগে সজ্জনের ঘুম ভাঙবে না । বড় নিশ্চিন্ত হল সে । ইচ্ছে করল মেয়েটাকেও যদি পিল খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় তো মন্দ হয় না । পরম নিশ্চিন্তে কাজে বেরোতে পারবে ।
পিল হাতে মেয়েকে দিতে গিয়ে পেটটা কনকন করে উঠল । যদি সে ঘুম কখনও না ভাঙে ! তবে সজ্জনের আপন বলতে কেউ রইবে না । বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে পিল খাওয়ানো থেকে বিরত হল ।
সে জানে, আজ রাতে তার ঘুম আসবে না । এ কাজে যে ভীষণ রিস্ক আছে সেটা তার অজানা নয় । বিশেষত কাজটা যখন আরণ্যক বিষয়ক। গত তিন বছরে সে হাড়ে হাড়ে চিনতে পেরেছে আরণ্যককে। যাকে বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবেছে ; দেখা গেছে সেইই আরণ্যকের গুপ্তচর । এভাবে চলতে গিয়ে একসময় নিজেকেও অবিশ্বাস করে আরণ্যকের সাথে পালিয়েছে। কপাল গুনে হয়ত সজ্জনের মত জীবনসঙ্গী পেয়েছিল ।
এবার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল । সজ্জনের কথা মনে পড়তেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল ললন্তিকা। বড় হতভাগ্য সজ্জন সিং। জন্মের পর থেকে আপন গর্ভধারিণীর চক্ষুশূল হয়ে ছিল সে । তারপর একটু বড় হতেই যখন দেখল তার মা বাবাকে মেরে ফেলে নিজের প্রেমিকের সাথে চলে গেল । সজ্জন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করে বসেছিল জীবনে মেয়েদের কাছ থেকে হাজার যোজন দূরে থাকবে।
কিন্তু ললন্তিকাকে দেখে --
কি আছে তার মধ্যে? ললন্তিকা নিজেকে নিয়ে চুলচেরা ব্যাখ্যা করতে লাগল । বিয়ে মানে যে দৈহিক মিলন - তা তো অনেকবারই অরবিন্দ বা আরণ্যক এমন কি কামাল ভাইয়ের সাথে হয়ে গেছে ; তা জানার পরও সজ্জন কেন তাকে সামাজিক ভাবে বিয়ে করেছেন , ভাবতেই অবাক লাগে । পাঁচ লাখ টাকা উশুল করার জন্য ? তা যে নয়; সে তার ভালবাসার মধ্য দিয়ে বোঝা গেছে ।
মেয়ে ? সে তো তারও প্রাণের প্রিয় । সজ্জনের জন্যই তো তার মুখ দেখা। যা এক নারীর চির আকাঙ্ক্ষিত ।
বড় মামা অনন্ত সরখেলের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে ললন্তিকা। গোপনে তাঁরই ছেলেকে প্রেম নিবেদন করে দু' দু'বার গর্ভপাত করিয়েছে। অরবিন্দ তার সিঁথিতে সিঁদুরও পরিয়ে দিয়েছিল । তবু কিসের লোভে সে আরণ্যকের মত পাপীর
কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ! ললন্তিকা জানত প্রাইমারি শিক্ষা নিয়ে লেখিকা হওয়া যায় না । তবূ টুকটাক যা লিখত ছাপার অক্ষরে দেখার জন্য সে এত উদগ্রীব হয়েছিল বলেই তো আরণ্যককে মেনে নিয়েছিল কঠিন শর্তে রাজী হয়েও । পরের গল্প তো সবার জানা।
রইল বাকি অরবিন্দ। অরবিন্দ সরখেল - বড় মামার ছেলে। ভাই-বোনের সম্পর্কটা কি ভাবে স্বামী-স্ত্রী হয়ে গেল ভাবতে পারছে না ললন্তিকা। এজন্য হয়ত বলে প্রেম ধর্ম মেনে চলে না । খুব দুঃখ হয় তার অরবিন্দের জন্য । মনে হয় তার এই অধ:পতন ওর জন্যই হয়েছে। নইলে দিব্যি তো পড়াশোনা করছিল । অযথা কেন বোনের প্রেমে পড়ল? সে তো তাকে বিয়ে করেছিল রাধামাধবের সামনে। তবু ললন্তিকা তাকে ছেড়ে আরণ্যককে আবার ধরল। তার মারা যাওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না । বাবাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল ভুল পথে ।শেষ রক্ষা হয়নি।
অরবিন্দের বাবার কথা ফের মনে হতেই ললন্তিকার হাবেভাবে কঠোরতা এনে দিল । দু'পুরুষে মামা ছাড়া আর কেউ নেই। ললন্তিকার মুখ কঠোর হয়ে গেল। যে ভাবেই হোক মামাকে বাঁচাতেই হবে । সেজন্য যদি তাকে মরতে হয়; মরবে ।
হঠাৎ নজর গেল সজ্জনের দিকে । ঘুমের বড়ি খেয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে যেন দুনিয়ার প্রশান্তি তার মুখে। একবার সজ্জনের কাছে গেল । হাত ধরে বুকে রাখল। মনে মনে বলল - আর যদি না ফিরি , দুঃখ পেও না । সুখ মা লক্ষ্মীর মতই চঞ্চল। এই আছে এই নেই। মেয়েকে রেখে গেলাম স্মৃতিরূপে রেখে দিও।
বলে ঘুমন্ত মেয়েকে তার পাশে শুইয়ে দিল । ঘড়ি দেখে নিল । রাত দু'টো বেজে গেছে। সাড়ে তিনটায় অপারেশন আরণ্যক ।
টয়লেটে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল । এই ডাক এল বলে !
মিঃ ভৌমিক এবং মিঃ অভয়ঙ্কর সরকার আড়াইটের সময় এলার্ম দিয়ে রেখেছেন। এলার্ম বাজতেই উভয়ে উঠে পড়লেন । ঘুমের গ্লানি দূর করতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন মন্দির এবং মেলা প্রাঙ্গন আলোয় আলোয় ঝলমল করছে । দর্শনার্থীদের বেশির ভাগ জন নিদ্রিত । যে ক'জন জেগে আছেন তারা ভোরের স্নান করতে তৎপর । রাতভর জেগে থাকা পুলিশ প্রহরীগণ কেউ ঢুলছেন, কেউ টহল দিচ্ছেন, কেউ বা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা পান করছেন ।
- এক কাপ কফি হলে মন্দ হয় না । কি বলেন বেয়াই মশাই?
অভয়ঙ্করবাবু যেন সম্মতির প্রত্যাশায় ছিলেন। মিঃ ভৌমিক বললেন - তা যা বলেছেন । কিন্তু দোকানগুলো তো এখান থেকে দূরে । কফির মজাই আসবে না ।
- বলেন তো আমি ট্রাই করে দেখি।
মিঃ ভৌমিক বললেন - এই রাতবিরেতে ঠাণ্ডায় যাবেন কফি আনতে ?
অভয়ঙ্করবাবু হেসে উত্তর দিলেন - যেতে হবে কেন ! এখানেই তৈরি করে নেব। পাত্র পাত্রী সব তো রেডি আছে।
মি: ভৌমিক বললেন - আপনার সত্যিই অনেকগুলো গুন আছে।
- হে হে হে ! কি যে বলেন না ! দশ বছর রেঞ্জারগিরি করেছি প্রত্যন্ত জঙ্গলে। সব কিছু নিজেকে করে নিতে হোত। আর আজ সামান্য দু'কাপ কফি বানাতে পারব না ?
- দু'কাপ নয় কাকাবাবু! তিন কাপ কফি এনেছি। এই নিন গরমাগরম কফি।
ভৌমিক সাহেব এবং রেঞ্জার সাহেব উভয়ে অবাক হয়ে দেখলেন একটা প্লেটে করে তিন কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি হাতে ললন্তিকা টেবিলে নামিয়ে দিল ।
তিনজনে তিন কাপ কফি হাতে নিয়ে পরিকল্পনার কথা আলোচনা করতে লাগলেন ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - জানো মা! জীবনে এই প্রথমবার কোন এনকাউন্টারে যাচ্ছি। রেঞ্জার ছিলাম তো ! জানোয়ার তাড়িয়েছি, দুর্বৃত্তদের পিছু ধাওয়া করেছি কখনও এই রকম বুদ্ধিমান জানোয়ারের সঙ্গে মোকাবিলা করিনি । আজ সেটাও হতে চলেছে।
বলে কপিলমুনির মন্দিরের দিকে দু'হাত মাথায় ঠেকিয়ে বললেন - হে ঠাকুর! নির্বিঘ্নে যেন কাজ সমাধা করতে পারি।
মিঃ ভৌমিক বললেন - কপিলমুনি আপনার প্রার্থনা শুনেছেন । আশা করি মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন ।
ললন্তিকাও বলল - তাই যেন হয় দয়াময়।
ঘড়িতে রাত তিনটে বেজে কুড়ি। ওরা তৈরি হয়ে পুলিশ দলকে নির্দেশ দিয়ে নাগা সন্ন্যাসীদের বারো এবং তেরো নং চালাঘর দুটি দূর থেকে ঘিরে ফেলতে বললেন । শুরু হল পুলিশি তৎপরতা ।
এদিকে এঁরা তিনজন বেরিয়ে পড়লেন নি:শব্দে।
( ক্রমশ )
