ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব চুয়ান্ন
অরবিন্দ খুব ভালো জানে যে ললন্তিকার এই নাম্বারটা কত পরিচিত। আরও ভালো জানে আরণ্যক কতখানি বিপজ্জনক ব্যক্তি । তাই হয়তো ইচ্ছে করে ফোন তোলেনি অথবা পাছে পুলিশ তার অবস্থান জানতে পেরে যায় !
অরবিন্দ এটাই চেয়েছিল । বলল - একদমই ঠিক কথা বলেছ । অপরিচিত ফোন এভয়েড করাই ভালো।
ললন্তিকা এর কোন উত্তর বা দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করল না। ইদানিং অরবিন্দ মাঝে মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে যায় ; একবার জিজ্ঞেস করবে ভেবেছিল । কিন্তু সাহস পায়নি । ললন্তিকা মর্মে মর্মে বোঝে এই 'অ' এবং 'আ' দিয়ে শুরু নাম দুটোর দেহধারীরা একে অন্যের পরিপূরক। তাদের পরিচয় আজ বা কালের নয় ;; বহু বছরের ।
একদিন এই প্রশ্নটা করেও ছিল ; অরবিন্দ নেহাত তখন তার প্রেমে পড়ে গেছে তাই কিছু বলেনি কিন্তু হাবেভাবে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিল এ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনদিন যেন প্রশ্ন বা আলোচনা না করে ।
আবার ফোন করলেন মিঃ আরণ্যক বসুরায়। এবার ফোন হাতে স্বয়ং অরবিন্দ । দু'তিনটে রিং হতেই ফোন তুলল।
- হ্যালো , তুই অরবিন্দ তো !
আরণ্যক রায়ের গম্ভীর কন্ঠস্বর অরবিন্দর কানে গেল ।
- আজ্ঞে না। গলার স্বরটা পরিবর্তন করে উত্তর দিল অরবিন্দ।
- তবে কে তুই ? কোত্থেকে কথা বলছিস ?
অরবিন্দ বলল - তা আপনার না জানলেও চলবে । অরবিন্দ নামের কেউ এখানে নেই । আমি প্রশান্তমোহন বলছি । বলুন, ফোন করেছেন কেন ?
আরণ্যক অবাক হয়ে গেলেন । সাগর এটা ভুল নাম্বার দেয়নি তো !
- অরবিন্দ সরখেলকে ফোন দে । তার সঙ্গে কথা আছে।
অরবিন্দ বলল - বললাম তো অরবিন্দ বলে এখানে কেউ নেই! এটা আমার নাম্বার । প্রশান্তমোহনের ।
তাঁর সঙ্গে মজা করছে ভেবে আরণ্যক বসুরায় আরও তপ্ত হয়ে উঠলেন। নাহ্ আজ দিনটা মনে হচ্ছে তাঁর পক্ষে বড় অশুভ । একে তো এই সদ্য একটা সুন্দর সম্পর্কে ছেদ টেনে এসেছেন । তায় আবার দ্বিতীয় কৌতুক। রাগে গরগর করতে লাগলেন মিঃ আরণ্যক বসুরায়।
ইচ্ছে হচ্ছে ফোনটা কেটে দিতে। ইচ্ছে হচ্ছে ওটাকে নয়ানজুলিতে ছুঁড়ে ফেলতে । নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলেন বসুরায় । যথাসম্ভব গলা নামিয়ে বললেন - এটা ইয়ার্কি ঠাট্টার সময় নয় সোনা । একটু সিরিয়াস হও। মঙ্গল হবে ।
অরবিন্দের খুব হাসি পেল । আরণ্যকের মত লোকের এই পরিবর্তনে ভেবে নিল জব্দ হয়েছে ব্যাটা ।
অরবিন্দ মজা করেই বলল - কি নাম বললেন যেন আপনার ? আরণ্যক বসুরায় ! নামটা আমার কাছে তেমন পরিচিত নয় ! যাকগে, কি বলবেন বলুন। আমি অরবিন্দ সরখেলই বলছি ।
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না মিঃ বসুরায়।
দূর থেকে আর একটি মেয়েলি গলার স্বর শুনতে পেলেন । ললন্তিকা নয় তো ! দীর্ঘ দিন কন্ঠস্বর শুনতে পাননি; আজকে তেমনই কারও গলার স্বর শুনে বললেন - কে কথা বলছে রে ?
অরবিন্দ বলল - আমার বউ ।
- মানে ? ললন্তিকা নাকি ?
- ও তো আগের পক্ষের ছিল । আপনার ছোঁয়ায় এখন রূপকথার দেশে । যতটুক শুনেছি সম্ভবত ও বাংলাদেশে চলে গেছে ।
- যাক বাবা বাঁচলাম। ও তাহলে ফিরতে পারেনি ?
সে প্রশ্নের উত্তর দিল না অরবিন্দ। বলল - নেন স্যার , আমার বউকে দিচ্ছি। আপনি ওর সঙ্গে কথা বলুন। হাঁকপাক করছে । বোধ হয় চেনে আপনাকে ।
ললন্তিকার হাতে ফোন দিয়ে কথাবার্তা রেকর্ড করতে লাগল অরবিন্দ ।
ললন্তিকা বলল - হাঁ স্যার, আপনি আমায় চেনেন না; আমি লতিকা বলছি । আপনার ' কেউটের ছোবল ' উপন্যাসটা পড়েছি । এক্কেবারে ফাটাফাটি লিখেছেন স্যার ।
আরণ্যক বসুরায় কথাগুলো শুনতে পেলেও কোন প্রতিক্রিয়া দিলেন না ।
ললন্তিকা আবার বলল - স্যার, আমার একটা আবেদন আছে ।
অরবিন্দ আর কথা বলছেন না দেখে ললন্তিকা বলল - হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো ! নাহ্ কেটে গেছে বোধ হয় লাইনটা । সাড়া পাচ্ছি না তো !
- আছি আছি !
তড়িঘড়ি জবাব দিলেন আরণ্যক বসুরায় ।
- বল কি বলছ ?
ললন্তিকা সুযোগ পেয়ে বলল - স্যার ' কেউটের ছোবল' বইটার মূল পাণ্ডুলিপিটা আমাকে দেবেন ?
চমকে উঠলেন সাহিত্যিক বসুরায় । পাণ্ডুলিপি চাইছে কেন ? আর এভাবে হঠাৎ পাণ্ডুলিপি চেয়ে বসা মেয়ে - এ তো কোন সাধারণ মেয়ে হতে পারে না ! এই পাণ্ডুলিপির কথা কারও জানার নয় । তবে কি ললন্তিকা !
তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়লেন পাণ্ডুলিপিটার জন্য ।রাত হয়ে গেছে। এখন তো আর অফিসে যেতে পারবেন না । তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ছে পাণ্ডুলিপি প্রিজার্ভ করার জন্য বিশেষ লকার আছে অফিসে ; যা খোলা বা বন্ধ করার চাবি তো সবসময় তাঁর পকেটেই থাকে !
পকেটে হাত দিলেন - এই তো রয়েছে !
আরণ্যককে চুপ করে থাকতে দেখে ললন্তিকা বলল
- লাইনে আছেন তো স্যার ? আমি কি খুব বড় আবদার করে ফেলেছি ?
কি বলবেন ভাবতে পারছেন না মিঃ আরণ্যক বসুরায়।
কোনমতে বললেন - পাণ্ডুলিপি নিয়ে তুমি কি করবে ?
ললন্তিকা কোন রকম না রেখেঢেকে সোজাসুজি বলে দিল - ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠাব ।
আরণ্যক এত বিস্মিত হলেন যে তাঁর মনে হল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে ।
ললন্তিকা বলল - কি সাহিত্যিক আরণ্যক! ছোটা সা ধাক্কা জোরসে লগ গিয়া কেয়া ?
আরণ্যক বুঝে গেলেন মেয়েটি ললন্তিকা ছাড়া অন্য কেউ নয় ।
- ওহ্ ডিয়ার সুইটি ! তুমি লতিকা নামে পরিচয় দিয়ে ইয়ার্কি করছিলে ? কতদিন তোমায় দেখিনি ডার্লিঙ !
ভীষণ কষ্ট দিচ্ছ কিন্তু । কোন কথা শুনব না; সোজা চলে এস আমার ঘরে ।
তারপর একটা ঢোক গিলে বললেন - না না ঘরে নয়; অফিসে এস । পাণ্ডুলিপিটা তো আমি সঙ্গে নিয়ে ঘুরি না । ওটা সযত্নে রাখা আছে । তুমি এস; পাণ্ডুলিপি নাও, আমার তো এখন আপনার কেউ নেই । বউটাকে মেরে দিয়েছি । হে হে হে ! তুমি ছাড়া এখন আমার আর কেই বা আছে ! তুমি এস, দেখা কর। আমি তোমাকে আমার ঘরে তুলব । প্রমিস।
ললন্তিকা বলল - তুমি কি এখনও আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেগ ?
- অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম ডার্লিঙ । ওই শালা শুয়োরের বাচ্চা , অরবিন্দ সব মাটি করে দিল । আমি তো তোমাকেই চাই। অরবিন্দকে নয় ।
ললন্তিকা বলল - ঠিক আছে। কথা দিলে কিন্তু ! আর নিশ্চয় ঠকাবে না ?
- ফিরে পাওয়া ধন কি পায়ে ঠেলতে আছে লক্ষ্মীটি ? আমি আমার সর্বস্ব তোমাকে দিয়ে দেব । হে হে হে । না দিলে তো পাঁচ ভুতে খেয়ে নেবে ! হে হে হে ।
ললন্তিকা নকল করে বলল - হে হে হে ! আমি অন্য কিছুই চাই না ; শুধু পাণ্ডুলিপিটা চাই ! আর তা পেয়েও গেছি । হে হে হে আরণ্যক বসুরায় ! আমার নাম ললন্তিকা সেন । ওয়াইফ অফ মিঃ অরবিন্দ সরখেল । যে এখন আমায় বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে। আমার হাজব্যাণ্ড, আমার প্রাক্তন মামাতো দাদা , আমার আসল প্রেমিক । তুমি তো দেহটাই চেয়েছিলে ; দিয়েও ছিলাম । রাখতে পারনি ।
এবার আরণ্যক ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন । পাণ্ডুলিপি চুরি করে নিয়েছে ? কি ভাবে ? ধুর! যত সব মিথ্যে কথা বলে ভয় দেখানো ছাড়া অন্য কিছু নয় ।
অট্টহাসে ফেটে পড়লেন মিঃ আরণ্যক বসুরায়।
- হা হা হা ! ইউ আর এ গ্রেট কমেডিয়ান ললু ! যেটা পেয়েছ ওটা আসল নয় । আমি জানতাম তুমি চুরি করবে ; তাই ইচ্ছে করেই লকারটা খুলে রেখেছিলাম।
ললন্তিকা সত্যি ভেবে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ।
( ক্রমশ )
