ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব বাষট্টি
ললন্তিকা এবং আরণ্যক রাতের ট্রেন ধরে নিরুদ্দেশে চলে গেলেন । পড়ে রইল অরবিন্দ গীতা আশ্রমে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই পুলিশ ঘিরে ফেলল গোটা আশ্রম ।
খানা তল্লাশির পর যখন ওদের কাউকে পাওয়া গেল না মোহান্ত মহারাজকে থানায় তুলে নিয়ে গেল । অরবিন্দকে ডেকে মোহান্ত বললেন - ওহে বোষ্টম , ভোরের আরতি এবং ব্রাহ্মসঙ্গীত যেন বন্ধ না থাকে ।
পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেশ করলেন - এই বোষ্টমের নাম কি ?
মোহান্ত বললেন - নাম ? এখানে নামধাম শুধু একজনেরই হয় তিনি রাধামাধব।
বলে দু'হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম নিবেদন করলেন ।
পুলিশ অফিসার বললেন - গাড়ি থামাও ।
গাড়ি থেকে নেমে ওই বোষ্টমের খোঁজ নিতে শুরু করলেন ।
- কি ছোট গোঁসাই ! নিবাস কোথায় ?
- এই যে হুজুর এই রাধামাধবের চরণে !
- কতদিন থেকে এই আশ্রমে আছো ?
- তা আজ্ঞে বছর খানেক তো হবেই।
- এক বছর আগে কোথায় ছিলে ?
- জয়দেব কেন্দুলিতে বাউলদের আখড়ায়।
- তার আগে?
- আজ্ঞে মনে নেই।
- তার মানে তোমার বয়স খুব কম। ছেলেবেলার কথা আমারও মনে নেই । তবু জানো মা বাবাকে বেশ মনে আছে। তোমার নাম, বাবা মায়ের নাম কি ?
- আজ্ঞে আমার পিতৃপ্রদত্ত নাম প্রশান্ত মোহন সরখেল। পিতা স্বর্গত অনন্ত মোহন সরখেল । মাতা জগত্তারিণী দেবী। নিবাস ছিল পাঁচড়া ।
- পাঁচড়া ? মানে পাণ্ডবেশ্বর অজয় পেরিয়ে ভীমগড় ; তারপরই পাঁচড়া ! তাই তো ?
- আজ্ঞে হ্যাঁ ।
- বিয়ে থা' করেছ ?
- আজ্ঞে। এই মন্দিরেই একজনের সাথে কন্ঠীবদল হয়েছে।
- কোথায় তিনি ?
- আজ্ঞে দেশের বাড়িতে।
- বেশ । একটা ডায়েরীর মত বই দেখে বললেন - বই পড়ার অভ্যেস আছে বুঝি ? কি বই পড় দেখি তো !
বলে সেটা হাতে নিয়ে দেখলেন । হাতে লেখা একটা উপন্যাস । নাম - কেউটের ছোবল। লেখক অনন্ত মোহন সরখেল।
- তোমার বাবা কি লেখক ছিলেন ?
- আজ্ঞে।
- লেখা তো বেশ উঁচু মানের ; ছাপানো হয়নি।
- আজ্ঞে না ।
- কেন ?
- তেমন আর্থিক সঙ্গতি ছিল না।
- ও । ঠিক আছে। আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি। আমার একজন প্রকাশকের সঙ্গে ভালো পরিচয় আছে। ওঁকে বলে ছাপাবার ব্যবস্থা করে দেব ।
অরবিন্দ হাঁ বা না কিছু বলতে পারল না । এই সাহেবের সাথে আরণ্যকের পরিচয় থাকলেও থাকতে পারে আর পাণ্ডুলিপি যদি তার হাতে চলে যায় তা'হলে আর কিছু করা যাবে না। সাহস করে বলল - বাবা এটা ছাপাতে নিষেধ করেছিলেন।
- কেন ?
- এটার জন্যই তিনি খুন হয়েছিলেন। মরার আগে আমার হাতে ধরে বলেছিলেন এই বই কোনদিন ছাপতে দিবি না ; এটা অপয়া ।
- স্ট্রেঞ্জ ! এত সুন্দর লেখা বই ছাপানো হবে না ? যাক আমি এটা নিয়ে চললাম। আগামীকাল থানা থেকে নিয়ে আসবে ।
বলে পাতা উল্টাতে গিয়ে দেখেন একটা চিরকুটে লেখা আছে - আমি আরণ্যকের সাথে চললাম। বৃথা আমার খোঁজ করবে না ।
শেষে লেখা ললন্তিকা ।
পুলিশ অফিসারটি ইউরেকা ইউরেকা বলে লাফাতে লাগলেন । সুযোগ বুঝে অরবিন্দ গভীর জঙ্গলে ঘেরা নিকস্থ কয়লা খাদানে লুকিয়ে রইল ।
পুলিশ অফিসার আফশোষ করতে লাগলেন । এভাবে বেমক্কা গা ঢাকা দেবে ভাবতেই পারেননি ।
তিনি পুলিশকে এলার্ট করে দিলেন। সকলে মিলে আবার তল্লাশি শুরু করল। এবার অফিসারটি মোহান্তকে বললেন সব ঘটনা । মোহান্ত সবিস্ময়ে বললেন - রাধামাধব।
অফিসার বললেন - মোহান্তজী এবার বলুন ও কে ?
- হুজুর আমি এর বিন্দুবিসর্গ জানি না। মাস দুই আগে তিলক কেটে আশ্রমে এসে গান গেয়েছিল। কি সুন্দর গলা ! আশ্রয় চাইল। তাই থাকতে দিলাম।
- জানেন কি ও একটা বিশাল ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে হচ্ছে । যাক গে , আপনাকে আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে । চলুন ।
মোহান্ত রাধামাধবকে স্মরণ করতে লাগলেন।
থানায় এসে অফিসারটি সব বিবরণ জমা দিলেন বিধাননগর এবং কলেজ স্ট্রীট থানায় ।
পুলিশ কমিশনারকে অবহিত করা হল । তিনি আরণ্যক বসুরায়ের সব ব্যাঙ্ক একাউন্ট সীল করে দেবার নির্দেশ দিলেন । পাসপোর্ট ইন-একটিভ করে দেওয়া হল । পুলিশ কমিশনার প্রেস বিবৃতি দিলেন । আরণ্যক বসুরায়
নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে পলাতক বড় অক্ষরে ছাপা হল ' সাহিত্যিক এবং প্রকাশক আরণ্যক বসুরায় ফেরার । '।
পরের দিন খবরের কাগজে প্রথম পাতায় বড়
কাগজ পড়ে কেউ বিস্মিত হলেন; কেউ দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিলেন । মিঃ বসুরায় অন্তরালে থেকে সব দেখলেন । তিনি চুল, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি গোঁফ সব কামিয়ে ফেললেন । কাগজে তাঁর ছবিও ছাপা হয়েছিল । তড়িঘড়ি একটি নার্সিং হোমে গিয়ে নিজেও প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে মুখমণ্ডল বদলে দিলেন যাতে কেউ তাঁকে চিনতে না পারে ।
এভাবে আর কতদিন চলে ! টাকা পয়সায় টানাটানি পড়ে যায় । এমন অবস্থায় তিনি ললন্তিকাকে ফিরে যেতে বলেন ।
ললন্তিকা সম্মত হয় না । বলে - তোমাকে ছেড়ে এ অবস্থায় আমি ফিরে যেতে পারব না ।
- এখানে না খেয়ে থাকতে হবে । স্টেশন চত্বরে রাত কাটাতে হবে । অত সোজা নয় ; তার চেয়ে ফিরে যাও। পুলিশ তোমার আগেকার ছবিটা দিয়েছে। সুতরাং তোমার আশঙ্কা খুব কম ।
- তুমিও তো চেহারাটাই বদলে দিয়েছ !
- সে আপাতত নিজেকে নিরাপদ রাখতে। আমার কোনমতে একবেলা জুটলেই হবে । তুমি অত ধকল নিতে পারবে না । তুমি চলে যাও।
ললন্তিকাকে রাজী করাতে না পেরে আরণ্যক বসুরায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন ।
কাগজের একটা বিজ্ঞাপনে তাঁর নজর এল । বড় অদ্ভুত সে বিজ্ঞাপন । তিনি দেখলেন এবং কাগজের ওই অংশটা কেটে পকেটে রেখে দিলেন । এদিকে তাঁর পকেটেও টান পড়তে লাগল। হোটেলের টাকা মেটাতে গেলে তিনি নি:স্ব হয়ে পড়বেন । তাই ললন্তিকাকে সেখানে রেখে বাইরে গেলেন কাজের দোহাই দিয়ে ।
যোগাযোগ করলেন বিজ্ঞাপনের মালিকের সঙ্গে। ললন্তিকার ছবি দেখালেন । লোকটির খুব পছন্দ হল । পাঁচ লক্ষ টাকায় চুক্তিপত্রে সাইন করলেন । টাকা নগদে দেয়া হবে মেয়ে জমা রাখার পর ।
ফিরে এলেন হোটেলে । ললন্তিকাকে বললেন - এখানে থাকার টাকা নেই। চল কম টাকায় একটা ব্যবস্থা করেছি , আমরা সেখানে গিয়ে উঠি।
ললন্তিকার আবস্থাও ন যযৌ ন তস্থৌ । বাধ্য হল যেতে । প্রথম দিকে দু' তিনদিন আরণ্যক সঙ্গে ছিলেন। চতুর্থ দিনে ললন্তিকাকে বললেন - এই ভদ্রলোক আমার আগেকার পরিচিত । হঠাৎ পথে দেখা । নিয়ে গিয়েছিলেন ওঁর বাড়িতে । তখনই ম্যানেজ করে নিলাম। উনি বলেছেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন - তাই আজ আমি ইন্টারভিউ দিতে যাব। তুমি একটু সাবধানে থাকবে । আমি ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই ফিরে আসব ।
ললন্তিকা বাধা দিতে পারল না । ঝাড়া হাত পা হয়ে আরণ্যক বসুরায় অন্যত্র চলে গেলেন ।
ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও ললন্তিকা যখন দেখল আরণ্যক ফিরৈ এল না, বাড়ির মালিক সজ্জন সিং কে জিজ্ঞেস করল - মিঃ বসুরায় কোথায় গেছেন ?
সজ্জন সিং লোকটা এমনি খারাপ নন । ললন্তিকাকে নিজের ঘরে এনে বসালেন । তারপর খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বললেন - তুমকো বেচা গয়া হ্যায় । পাঁচ লাখ রুপৈয়া লেকে ও আদমী ভাগ গয়া । লেকিন ডরো মত ; ম্যায় তুমকো মেরা পত্নিকি দরওয়াজা দুঙ্গা। আজ সে তুম মেরী হো ; সির্ফ মেরি।
ললন্তিকা কপালের দোষ দিল না । বড় অদ্ভুত ভাবে মানিয়ে নিল নিজেকে । কিন্তু সজ্জন সিং কেও সন্দেহের উর্ধে রাখতে পারল না । তার কারণ এমন কিম্ভুতকিমাকার বিজ্ঞাপন ।
কি আছে সেই বিজ্ঞাপনে ? ললন্তিকা খুঁটিয়ে পড়তে লাঘল । ইংরাজিতে বিজ্ঞাপন। সে তো বাংলা নিয়ে পড়েছে ; ক্লাস টেন পর্য্যন্ত !
( ক্রমশ )
