ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব তিপ্পান্ন
গোপাল বাবুর কৃষ্ণপূরের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আরণ্যাক বসুরায় ভি আই পি রোডে কৃষ্ণপুরস্থিত দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করছিলেন সাগরের দেওয়া নাম্বারে কল করে । রিং হচ্ছে; ফোন ওঠাচ্ছে না । বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালিয়ে যখন কোন উত্তর পেলেন না সরাসরি সাগরকে ফোন করলেন।
সাগর যেন তৈরি হয়েই ছিল ।
বলল - হুঁ স্যার । সাগর বলছি । ললন্তিকার সাথে কথা হল স্যার ?
আরণ্যকের মেজাজ ক্ষিপ্ত ছিল । গোপাল বাবুর বাড়িতে যে কাণ্ডটা বাধিয়ে ফেলেছেন ; মনে মনে অনুতপ্ত হলেন।
সেই ক্ষোভ গিয়ে পড়ল সাগরের উপর ।
- শুয়ারের বাচ্চা ! আমার সঙ্গে ইয়ার্কি ? বারোটা বাজাচ্ছি তোর ।
সাগর খুব ভয় পেয়ে গেল । এতটাই ভয় পেল যে হাত থেকে ফোন নামিয়ে রেখে দিল ।
আরণ্যক পুনরায় ফোন করলেন ।
এ্যাই খানকির বাচ্চা। এতবড় স্পর্ধা তোর আমার ফোন কেটে দিস ! জানিস আমি কে ?
- স্যার আপনি ভুল করছেন , আমি ফোন কেটে দিইনি, এমনি কল ড্রপ হয়ে গেছে।
সাগর কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বলল ।
রেগে আগুন আরণ্যাক বসুরায়।
- হতভাগা ! এটা কার নাম্বার দিয়েছিস; ফোনই তোলে না!
বিনীত ভাবে সাগর বলে - এটা ললন্তিকার ফোন নাম্বার স্যার । খোদ অরবিন্দ দিয়েছে।
আরণ্যকের রাগ আরাও বেড়ে যায় । - ওই জানোয়ারকে পেলে তো কেটে পিস পিস করে দেব। তার আগে তুই বল; ওরা এখন কোথায় আছে?
- আমি সত্যিই জানি না স্যার । অরবিন্দই আমাকে ফোন করে এই নাম্বারটা দিল ।
- তুই অরবিন্দের নাম্বার দে ! আমার ভীষণ দরকার।
- এটাই তো ওর নাম্বার স্যার ।
নিজের অজান্তেই বলে দিল । এটা সত্যিই অরবিন্দের ফোন নাম্বার যা সে ললন্তিকার অজান্তে ফোনে বদলাবদলি করে নিয়েছে। অরবিন্দের ধারণা ললন্তিকা যদি ওর নাম্বার আরণ্যককে দিয়ে দেয় তবে তো আরণ্যকের পক্ষে সুবিধা হয় ওর গতিবিধি জেনে নিতে। একটা বুনো ওল যেন আরণ্যক । তবে সে জানে না অরবিন্দও তেমনই বাঘা তেঁতুল।
- হতভাগা ফোন তোলে না কেন ?
- কি জানি স্যার ! হয়তো এখন ফোন কাছে নেই।
- তুই একবার ফোন করে ওকে বল আজ রাত আটটায় তাকে কল করব । যেন রেডি থাকে। এবারও যদি ফোন না ওঠায় তবে তোর একদিন কি আমার একদিন!
ফোন কেটে দেন আরণ্যক । কৃষ্ণপুরের বাড়িতে এখন কি ধুন্ধুমার কাণ্ড চলছে - দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে। তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে চললেন মিশন বাজারের বাড়িটার দিকে ।
আঁকাবাঁকা পথ । ভীড়ও তেমনই। জোরে গাড়ি চালানো যায় না । আস্তে আস্তে এগিয়ে চললেন - রবীন্দ্রপল্লী, ঘোষপাড়া, বারেয়ারীতলা পেরিয়ে মিশন বাজারের দিকে।
রাস্তায় ফুটপাত বলে কিছু নেই। সব সব্জিওয়ালাদের দখলে। চটের বস্তা পেতে আলু পেঁয়াজ শাকসবজি আর মাঝে মাঝে মাছ মাংসের দোকানে গিজগিজ করছে ভীড় । কোথাও বা মাংসের দোকানে লাইন পড়ে রাস্তায় নেমেছে।
আরণ্যক অত্যন্ত ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছেন । অটোওয়ালাদের জন্য রাস্তা পাচ্ছেন না । প্রায় এসেই পড়েছেন । ওখানেই পথের ধারে একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে গাড়িটা রেখে এগিয়ে গেলেন। তিনতলায় লিফটে উঠলেন । ফ্ল্যাট তালাবন্ধ ।
চিন্তায় পড়লেন আরণ্যক। এরা তাহলে শেষমেষ থানাতেই গেল ! ওকে , কোই বাত নেহি। এখানকার থানা মানে তো সেই বিধাননগর । কমিশনারেটের এ সি এন কে সালভে তাঁর অতি পরিচিত।
ফ্ল্যাট থেকে ফিরে গাড়িতে উঠে তিনি সালভেকে ফোন করলেন । মিঃ সালভে দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা। কিন্তু বেঙ্গল ক্যাডারের আই পি এস । কি করে যে তাঁর সঙ্গে দোস্তি হয়েছিল দমদম এয়ারপোর্টে নিজেই ভাবতে পারেন না ।
বোধ করি কোন ভি আই পি বা মন্ত্রী আমলাকে রিসিভ করতে এসেছিলেন । অসতর্ক মুহূর্তে তাঁর ওয়ারলেস ফোনটি হাত থেকে পড়ে যায়। আরণ্যক সেটি তুলে তাঁর হাতে দিতেই তিনি আরণ্যককে বলেন - হু ইউ প্লীজ ?
মুখ দেখে মনে হল বাংলা জানেন না ।
- অ্যাম আরণ্যক বসুরায় ,দ্য ফেমাস রাইটার অব বেঙ্গল।
- আই সি ! য়ূ আর দ্য গ্রেট নভেলিস্ট। আই হার্ড এ লট এবাউট য়ূ।
- থ্যাঙ্কস।
- য়ূ আর ওয়েলকাম। প্লীজড টু মিট য়ূ এণ্ড হোপ উইল বি মিটিং এগেইন । বাই।
ব্যস ! হয়ে গেল পরিচয় । নিজেকে ধন্য ভাবলেন আরণ্যক। একদিন এও কাজে আসবে। আর আজকেই সেই শুভ দিন ।
রাত আটটায় অরবিন্দকে ফোন করার কথা ছিল আরণ্যকের । অন্তত সাগরকে সেই কথাই দিয়েছিলেন। সাগর অবশ্যই নির্দেশ মত কাজ করেছে। সাগরের নাম্বার দেখে ফোন তুলেছে অরবিন্দ।
সাগর বলল - কোথায় রে তুই? স্যার তোকে কতবার ফোন করেছেন জানিস ! তুই নাকি একবারও ফোন ওঠাসনি!
- ইচ্ছে করেই ওঠাইনি । আমি চাই মিঃ আরণ্যাক বসুরায় আরও রেগে যান । আরও অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ুন ললন্তিকার উপর ।
- সে তো তুই চাইছিস। আমি চাইছি আজ রাত আটটায় স্যার আবার ফোন করবেন বলেছেন; প্লীজ ভাই! দয়া করে এবার ফোন তুলবি, নইলে আমার--
- তোর বারোটা বাজিয়ে দেবেন - এই তো ?
- হাঁ রে, ঠিক ওভাবেই বললেন তো !
- তুই এই ক'টা দিন ফোন সুইচ অফ করে রাখ। দেখে নে কতবার তোকে ফোন করেছেন !
- এ্যাই দেখ ! আমাকে নিয়ে টানাটানি করিস না ভাই। ছেলেপুলে নিয়ে কোন রকমে আছি । আর ঝুটঝামেলা ভালো লাগে না !
- দেখ সাগর ! তোকে রাম হলেও মারবে; রাবণ হলেও মারবে । তার চেয়ে রামের হাতে মরা তোর পক্ষে ভালো নয় কি ? মুক্তি পাবি রে ; মুক্তি পাবি। আর তেমন মুক্তি একমাত্র আমিই তোকে দিতে পারি ।
- হেঁয়ালি করিস না মাদারচোদ ! আমি তোর কেনা গোলাম নই রে শালা ! আমিও খেল দেখাতে জানি। করে খাচ্ছিস খা ! আমাকে ঘাঁটাসনি যেন ।
- ওরে ব্যাটা ! তোর ডানাপাখা গজিয়েছে দেখছি। শোন, আমার কথা মত চললে মালামাল করে দেব ; তা না হলে ডানাপাখা কেটে জীবনভর পঙ্গু করে রাখব। তখন মরণ চাইলেও পাবি না ।
সাগর একটু ভীতু প্রকৃতির ।
- আচ্ছা বাপ ! তোর কথাই শুনব । বল আমায় কি করতে হবে ?
- এখন কিচ্ছু করতে হবে না । শুধু আমার আর বসুরায়ের সঙ্গে মধ্যস্থতা করবি - ব্যস । যে যেমন বলবে তেমনি করবি।
- মানে ? দালালি ? ওটি আমাকে দিয়ে হবে না রে । বলেছি তো আমি কারও খানসামা নই।
- অর্থাৎ তুই দালালি করবি না ? মানে দলাদলি করবি - এইতো ! বেশ , তবে তাই করিস ।
ফোন কেটে দিল অরবিন্দ । একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে সাগর ডুবল অতলে ।
রাত আটটা বেজে গিয়েছে। আরণ্যক ভুল মেরে দিয়েছেন অরবিন্দের কথা । তিনি এখন ব্যস্ত বনলতা দেবীরা যেন থানায় ডায়েরী করতে না পারেন।
তিনি মিঃ সালভেকে ফোন করলেন ।
- হ্যালো সালভে স্যার । আমি আরণ্যক বসুরায় বলছি।
সালভে সাহেব খুশি হয়ে বললেন - ওহ্ মিঃ বসুরায়! হাউ আর য়ূ?
- অ্যাম সো সো ।
- সে , হোয়াট ক্যান আই ডু ?
আরণ্যক বসুরায় নিজের সম্ভাব্য গ্রেপ্তারির প্রসঙ্গ তুলে বানিয়ে বানিয়ে মস্ত এক গল্প খাড়া করলেন । মিঃ সালভে সব শুনে বললেন - ডোন্ট ওয়েরি । পি এস কোই ভি ডায়েরী এগেইনস্ট য়ূ ফাইল আপ করবে না ।
'থ্যাঙ্কস এ লট ' বলে আরণ্যক আত্মতৃপ্ত হলেন । এবার গাড়ি চালিয়ে তিনি চললেন উল্টোডাঙার দিকে । হঠাৎ খেয়ালে এল রাত আটটা এক ঘন্টা আগে পেরিয়ে গেছে। অরবিন্দকে সময় দিয়েছিলেন রাত আটটা। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে রিং করলেন । ফোন বাজছে কিন্তু তুলছে না । আবার চলতে লাগলেন । দক্ষিণ দাঁড়িতে এসে পুনরায় ফোন করলেন । এবারও তুলল না ।
ললন্তিকা একই নাম্বার থেকে ফোন আসছে দেখে পুলিশ
ভেবে ওঠাচ্ছে না ।
অরবিন্দ ফিরে এলে ললন্তিকা ওকে বলল - দেখ তো, এই লোকটা আমাকে জ্বালিয়ে মারলে বারবার ফোন করে।
অরবিন্দ দেখেই বুঝতে পারল কার ফোন । ললন্তিকাকে বলল - তুমি ওঠাওনি তো !
- না । অপরিচিত ফোন তুলি না ।
( ক্রমশ )
