ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব আটান্ন
বিছানায় শুয়ে আরণ্যকের মনে হল শুধু শুধু সময় নষ্ট করা কেন একবার ললন্তিকাকে ফোন করে জেনে নেওয়া যাক ওরা রেডি আছে কি না । পাণ্ডুলিপিটা যে তাঁর প্রাণ ভোমরা । যদি না ফেরত পাওয়া যায় তবে তো তাঁর মান-সম্মান, যশ, প্রতিপত্তি সবেতেই টানাটানি শুরু হয়ে যাবে !
কল করলেন ললন্তিকাকে । ফোন তুলে অরবিন্দ বলল - আপনি কি এসে গেছেন ?
- না রে ছোঁড়া ! এই সকাল বেলা এত ফোন কেন ? টাকার জন্য তর সইছে না ?
অরবিন্দ হে হে করে হাসল ।
- বুঝতেই তো পারছেন টাকা পয়সা না হলে মানুষ মানুষকে কোন সম্মান দেয় না । ভিখিরি ভাবে ।
- এতদিনে বুদ্ধি খুলেছে তোর ! নে তবে কনকাঞ্জলী তোর হাতেই তুলে দিই। আমার তো বয়স হোল। তোর বাপের টাকায় আর পাপের ভাগী হই কেন ; যার জিনিস তাকেই ফিরিয়ে দি ।
অরবিন্দ বলল - আমরা মুখ্যুসুখ্যু লোক । ও সবে লোভ নেই । আমদের চাই ক্যাশ - বুঝলেন - নগদরাশি। সাগর কি এগিয়েছে নাকি ? ওকে বলুন আমি নিজে ট্রায়াল দেব । ললন্তিকাও থাকবে সঙ্গে । আপনিও আসতে পারেন । ললন্তিকাকে ভুলিয়ে রাজী করে নিতে পারেন। আমি ছেড়ে দেব । ক্যাশ পেলে কত ললন্তিকা জুটে যাবে ।
আরণ্যক বসুরায় কেমন যেন হয়ে গেলেন । অরবিন্দকে যেমন চিনতেন এ তো তেমন কথা বলছে না! নিজের বৌকে বিক্রি করে দিতে চাইছে । মনে হচ্ছে টাকা পেলেই ও সরে যাবে ।
বললেন - পাণ্ডুলিপি বাবদ পঞ্চাশ আর ললন্তিকার বিনিময়ে আরও পঞ্চাশ - মোট এক কোটি দিলে তুই খুশি?
অরবিন্দ যেন স্বপ্ন দেখছে। বলল - খুশি মানে ? আমার পক্ষে এর বেশী চাওয়া পাপ হবে । না না, আরও একটু বেশি পেলে ভালো হোত; যাক গে , আপনি নিজের মুখে যা বলে দিয়েছেন আমি তাতেই রাজী ।
- বেশ তাহলে ওই কথাই রইল । আজ রাত দশটা - অজয়ের ঘাটে , ওদিক থেকে তুই আর ললন্তিকা, এদিক থেকে আমি আর সাগর । এই চারজন ছাড়া কেউ না কিন্তু।
- ঠিক আছে ঠিক আছে । আমি কথা দিলাম শুধু আমি আর ললন্তিকা যাব আর ওদিক থেকে আসনি এবং সাগর । পুলিশকে জানিয়েছেন তো ?
- এর মধ্যে আবার পুলিশ আসছে কোত্থেকে ! আমি পুলিশকে ফুলিশই ভাবি । ওসব চিন্তা করবি না ।
- বেশ বেশ । তাহলে আপনি ও সাগর শুধু আসছেন ?
- হ্যাঁ ।
- এদিকে আমি আর ললন্তিকা । ব্যস ! হয়ে গেল ।
আরণ্যক বললেন - আর পাণ্ডুলিপি ?
অরবিন্দ হাসল ।
- আরে স্যার, পাণ্ডুলিপির তো জান প্রাণ হাত পা নেই । ওটাও থাকবে সঙ্গে । কথা যখন দিয়েছি ধরে নিন জাত দিয়ে দিলাম ।
- এ্যাই অরবিন্দ ! শোন না । ললন্তিকাকে একবার ফোন দে না! কল যখন করলাম ওর সাথেও কথা বলে নিই।
অরবিন্দ বলল - ও এখনও আশ্রম থেকে--
বলে চুপ করে গেল । সত্যি কথাটা ফস করে বেরিয়ে গেছল আর কি !
বলল - ও এখন বিশ্রাম ঘরে । আসতে পারবে না । আর কয়েকঘন্টা পর তো বামাল সামনে পেয়ে যাবেন; এত চিন্তা কিসের ?
- সেটাই তো রে ! তোকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। দ্যাখ ! আমার সঙ্গে চু কিতকিত খেলছিস না তো ?
- আরে স্যার ! এ কথাটা তো আমারও মনে হচ্ছে ! আপনিও কি দড়ি টানাটানি খেলতে জানেন ?
- দ্যাখ বাপু ! কথার মারপ্যাঁচে ফেলিস না । বিশ্বাস হল অন্তরের জিনিস। আর দু পক্ষকেই এই বিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে ।
- আমিও তো তাই বলি স্যার । বিশ্বাস হল ঠুনকো কাঁচ । একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না ।
- তুই কি বলছিস রে ! মানেটা কি ? পাণ্ডুলিপিটা দিবি তো ?
- দূর পাণ্ডুলিপি ! বলি ললন্তিকাকেই যখন ছেড়ে দিচ্ছি ; পাণ্ডুলিপি নিয়ে কি করব ? ওটা আপনারই রইল । তবে কি জানেন বাপটা আমার এর জন্যই মরেছে স্যার । ওটা অপয়া । আমি ওটা রাখব না ।
আরণ্যক যেন শান্তি পেলেন । অরবিন্দকে বললেন - এখন রাখি রে ! একটা ফোন আসছে । রাতে দেখা হবে ।
বলে ফোন কেটে দিতেই অফিস থেকে ফোন এল ।
আরণ্যক বললেন - কি হয়েছে ?
ফিসফিসিয়ে একজন বলল - স্যার। পুলিশ অফিসটার দখল নিয়েছে। একদল আপনার বাসায় গেছে ।
আরণ্যক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন । পুলিশ আসছে মানে তো রুদ্রর ডায়েরীর জন্য ! তিনি চটপট টাকাভর্তি ব্যাগ, কিছু জামাকাপড় নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে অডিতে গিয়ে বসলেন । গাড়ি নিয়ে পাড়ি দিলেন রাণীগঞ্জের উদ্দেশ্যে ।
পুলিশ আরণ্যকের বাড়ি ঘিরে ফেলল । দরজায় তালা দেখে বুঝে নিল পাখি পালিয়েছে । সব চেক পোস্ট , টোল প্লাজায় খবর দিয়ে দেওয়া হল একটা আরবান ব্লু অডি গাড়ি এই তার নাম্বার দেখতে পেলে যেন আটক করা হয় ।
আরণ্যক রাজারহাট চৌমাথায় এসে গাড়ি থেকে নেমে আসানশোলগামী একটা ভলভোতে উঠে পড়ল । কি ইচ্ছে হল ; পানাগড়ে বাস থেকে নেমে দার্জিলিং মোড়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে দুবরাজপুরের দিকে যাত্রা করলেন ।
ড্রাইভারকে বললেন যত শীঘ্র সম্ভব তাঁকে ভীমগড় বলে জায়গায় পৌঁছে দিতে ।
তারপর ভীমগড়ে নেমে গাড়িটা ছেড়ে দিলেন । নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে চোখ দিতে দেখেন বিকেল চারটে ।
অরবিন্দ যে সময় দিয়েছিল তা তো রাত দশটা। অনেক দেরী । ফোন করলেন অরবিন্দকে । বললেন - তিনি নির্দিষ্ট স্থানে এসে গেছেন । সে যেন এখনই ললন্তিকাকে নিয়ে চলে আসে ।
অরবিন্দ তাঁর ফোন পেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল । এখন তো তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় ।
ললন্তিকাকে বলল কথাগুলো। ললন্তিকা চমকে উঠল - সত্যি আরণ্যক এসেছে ?
- হাঁ, এই দেখ ফোন করেথে এখুনি।
ললন্তিকা বলল - কি করবে ?
- ভেবে পাচ্ছি না । ওই জানোয়ারটাকে একদম বিশ্বাস করা যায় না । ফোন করে জানিয়ে দিল একটা বিশেষ কাজে আমরা রাণীগঞ্জে আছি। পৌঁছাতে দেরী হবে কারণ রাত দশটার এখন অনেক দেরী ! আপনি ওয়েট করুন ।
- আরে বাবা তোমরা রাণীগঞ্জের কোথায় আছো ? এখান থেকে রাণীগঞ্জ বেশী দূরে নয় । ঘন্টাখানেকের ভেতরে চলে এস । আমি অপেক্ষা করছি ।
- না স্যার, আমরা একটা কাজে ব্যস্ত আছি। এখন বেরোনো সম্ভব নয় । আপনি এক কাজ করুন একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসুন মেজিয়া ব্রীজে । ওখান থেকে পণ্য বিনিময় করে নেব ।
আরণ্যক বললেন - দেখছি। এখানে তো ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না । নদীপারে দেখি যদি কোন বাস পেয়ে যাই। আরণ্যক দাঁড়িয়ে আছেন । রাস্তা দিয়ে কয়েকশ গাড়ি, ট্রাক, বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সি পেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ একটু সময়ের জন্যও দাঁড়াচ্ছেনা । হাত দেখিয়েও লাভ নেই। কারণ জায়গাটা শুনশান। এমন জায়গায় কেউ সর্বস্ব খোয়াতে দাঁড়াবে না । এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে । তিনি হেঁটে হেঁটে ভীমগড় বাজারে এলেন ।সেখানে একটা বাসে চাপলেন । ফোন আসছে। আননোন নাম্বার । আবার কিছু থানার নাম্বার । সুইচ অফ করে দিলেন। পুলিশ নিশ্চয় জেনে গেছে তিনি এখন বীরভূমের মাটিতে ।
( ক্রমশ )
