ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব ছিয়াশি
সজ্জন সিং কোটিপতি লোক । নয়ডা ফিরে যাবার আগে তাঁর গাড়িটি পটকাকে দান করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন । এই পরিবারের আতিথ্যে তিনি এতই মুগ্ধ যে গাড়ি দান ছাড়া দেবার মত আর কিছু ছিল না ।
অভয়ঙ্করবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন ।
- মিঃ সিং কি প্রতিদান হিসেবে গাড়ি দিচ্ছেন ?
সজ্জন মা কালীর মত জিভ বের করে বললেন - আমাদের সখ্যতার নিদর্শণস্বরূপ আমি এটা হেডস্যারকে দিলাম । উনি এই গাড়ি নিয়ে স্কুলে বা যেখানে খুশি যেতে আসতে পারবেন ।
এ বিষয়ে আসানশোল কোর্টে দানপত্র লিখে দিলেন । পটকা তো ভীষণ খুশি। প্রতিদান স্বরূপ দিল্লীর বিমানের টিকিট কেটে দিল ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - আপনারা নিশ্চিন্তে আসুন । আর কোন ভয় নেই । পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ থেকে আপনাদের নিরাপত্তার দায় নিয়েছে নয়ডা পুলিশ।
ললন্তিকারা চলে গেল । অরবিন্দ আনমনে তাদের যাওয়া দেখল । কিছুই বলল না এমনকি গুডবাইইও না ।
সেই দেখে গোপালকৃষ্ণ বাবুও বললেন - এবার আমরাও আসি । আশা করি আরণ্যক এখন বাংলায় ফিরতে সাহস করবে না । পরের দিন তাঁরাও চলে গেলেন ।
ওদিকে আরণ্যক বসুরায় ফোনের পর ফোন করে চলেছে গুগুনকে। পুলিশ তাঁর লোকেশন খুঁজে পেয়েছে।
লাড্ডু সিং বলতে বাধ্য হয়েছে তাঁর পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছে রাণীগঞ্জ পুলিশ । সুতরাং সব জেনে এই নাম্বারটাও পাল্টে দিয়ে বরফে সিমটা ঢেকে দিলেন তিনি আরণ্যক বসুরায়।
ঠিক করলেন আর এখানে নয় । এবার তাঁকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে । হিমালয়ের দুর্গম থেকে দুর্গমতর স্থানে লুকিয়ে গেলেন তিনি । আর ফোনও সেখানে কাজ করছে না ।
ধৈর্য্য হারালেন না । কিছুদিন পর যখন পরিস্থিতি এখটু থিতু হয়ে এল তিনি চলে এলেন শিবনগরীর উত্তর কাশীতে কোন এক অজানা স্থানে ।
পুলিশ তল্লাশি চালিয়ে কুমায়ূণ বা গাড়োয়ালে কোথাও কোন খবর পেল না । পুলিশের এই অভিযানও ব্যর্থ হল ।
পরিযায়ীর মত যাযাবর জীবন কাটাতে লাগলেন আরণ্যক বসুরায় । বরুণ পর্বতে বরুণা এবং অসি নদীর সঙ্গমস্থলে এক আশ্রমে এসে উঠলেন। পরণে গৈরিক বস্ত্র , জটাজুট নকল চুল, গোঁফ এবং লম্বা দাড়িতে তাকে প্রকৃতই সন্ন্যাসীর মত দেখাচ্ছে । আশ্রমে অনেক সন্ন্যাসী রয়েছেন । কেউ কারোর সম্পর্কে উৎসাহী বা কৌতূহলী নন। সেহেতু তাঁকে নতুন দেখেও কেউ কিছু প্রশ্ন করলেন না ।
বেশ সুখেই কাটছিল জীবন । কিন্তু যে চির অসুখী তিনি শান্তি পাবেন কেন ? তাঁর এই সনাতনী সভ্যতা একদম পছন্দের নয় । সুতরাং উচ্চিংড়ির মত স্বভাব নিয়ে লাফাতে লাগলেন । বেশী কসরত দেখাতে গিয়ে তাঁর নকল জটা মাথা থেকে খসে পড়ল ।
সাধু সন্ন্যাসীরা তাঁর সেই দশা দেখে কা কা রবে ডাকতে শুরু করলেন । এই কা কা শব্দের মধ্য দিয়ে অন্যান্য সন্ন্যাসীদের বোঝাতে চাইলেন লোকটা আদপেই কোন সন্ন্যাসী নয় । হতে পারে কোন সাধারণ মানুষ; অথবা চোর-তস্কর ।
আরণ্যক জটা পড়ে যাওয়ার পর এবং কা কা ডাক শুনে দৌড়াতে লাগলেন । নদীর তীরে একটা নৌকায় উঠে মাঝিকে বললেন - যত টাকা চাই দেব; তুমি ওপারে যত জলদি পারো পৌঁছে দাও ।
মাঝির সামনে চারটে পাঁচশ টাকার নোট মেলে কাজ হাসিল করলেন বটে তবে মাঝিকে একটা মাত্র একশ টাকার নোট দিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিলেন ।
সজ্জন সিং বাড়িতে ফিরলেন । প্রদ্যুম্ন ঘোষাল খোঁজ খবর নিয়ে আরণ্যক বসুরায় সম্বন্ধে তথ্য নিতে গিয়ে জানতে পারলেন সে কলকাতার বাসিন্দা। লোক ঠকানো তার পেশা । সর্বোপরি এক বা একাধিক দুর্বৃত্তদলের পাণ্ডা ।ঘোষাল সাহেবকে যেমন ঠকিয়েছে তেমনি সজ্জনেরাও তার হতভাগ্য শিকার ।
ঘোষাল সাহেব সন্ত্রস্ত হলেন এবং লজ্জিতও। লজ্জা পাবার কারণ তিনি বাঙালি - বড় বড়াই করেন বাঙালিদের নিয়ে । আবার আর এক বাঙালি আরণ্যক - সে কিনা বাটপাড়ি করে বেড়ায় !
সজ্জন হয়তো বুঝতে পেরেছেন ঘোষাল সাহেবের মানসিকতা । বললেন - নেতাজী সুভাষচন্দ্রের দেশের লোকেরা বেশ মার্জিত রুচিসম্পন্ন এবং অতিথিবৎসল । আরণ্যককে বাদ দিলে ওখানের লোকজন খুবই সহানুভূতিশীল। আপ ঘবড়াইয়ে মত । আপকে প্রতি হমারা শ্রদ্ধা বঢ় গয়া জী ।
ঘোষালের চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল । বললেন - আপ লোগ আ গয়ে তো মেরা কোই চিন্তা নেহি রহা । ডর মে থা; কুছ না হো যায়ে ।
সজ্জন হাসতে হাসতে বলেন - বহুত বড়িয়া জায়গা হ্যায় বঙ্গাল ।
গোপালকৃষ্ণ বাবু দীর্ঘ একমাস ঘর ছাড়া । ঘরে ঢুকে দেখেন ময়েশ্চারে বিছানাপত্র, ফ্রিজ , ইত্যাদিতে ছাতা পড়ে গেছে। গোছগাছ করতে অনেক সময় লাগল। রুদ্র লাঞ্চের অর্ডার করে দিল ।পলা এবং বিল্টুর ঐশীর ছেলের জন্য মন খারাপ । ওদিকে রুক্মিণী ও শৈলদেবীর মনেও অস্বস্তি । শুধু পটকা আর অভয়ঙ্করবাবু দুজনেই নিরুত্তাপ ।
সজ্জন সিং এবং ললন্তিকা দু'জনেই ঠিক করে নিলেন কারও মোবাইল অন করে রাখবেন না । বাড়িতে এবং অফিসে ল্যাণ্ডফোন আছে যখন ; তখন অসুবিধা হলেও ফোনের সুইচ অফ রাখবেন । দিনে একবার শুধু ইনকামিং কলের লিস্টটায় চোখ বুলিয়ে নিলেই চলবে তারপর মোবাইল আবার অফ করে রাখা হবে ।
রাণীগঞ্জে ল্যাণ্ড ফোনের নাম্বার দেওয়া হয়েছে । তবু তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিলেন এই কথা।
আরণ্যক বসুরায় ললন্তিকার মোবাইল নং জানেন এমনকি সজ্জন সিং এরও নাম্বার পেয়ে গেছেন ; কিন্তু ল্যাণ্ড নাম্বার জানেন না । এটা একটা প্লাস পয়েন্ট ।
অভয়ঙ্করবাবু ল্যাণ্ডফোনেই যোগাযোগ করবেন বলে দিয়েছেন। আর সজ্জনের কোন আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই । সুতরাং এ নিয়ে কোন চিন্তা করারও প্রয়োজন নেই ।
এভাবেই চলল কিছুদিন । আরণ্যক আর ফোন করেন না। এমনকি খবর নিয়েছেন অরবিন্দকেও নাকি করেননি ।
মিঃ আরণ্যক বসুরায় নৌকা থেকে নেমে অন্ধকারে মিশে গেলেন । পাহাড়ি এলাকা । যদিও ডিসেম্বর মাস ; সাপখোপের ভয় খুব একটা নেই, কিন্তু বুনো শুয়োর বা হায়েনার ভয় তো থাকবেই। তথাপি যতটা সম্ভব নিজেকে সাবধানে রেখে তিনি একটা লম্বা পাথরের চাতালে শুয়ে পড়লেন একটা কম্বল ভাগ্যিস ছিল । না হলে নিউমোনিয়ায় ভুগতেন অবশ্যই। মাঝরাতে নাকা চেকিং শুরু করল পুলিশ । জায়গাটা ঘিরে সার্চলাইট দিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশ ।
একটা বুনো শুয়োর পেরিয়ে গেল । হাজার হাজার চামচিকে উড়ে বেড়াতে লাগল । পুলিশ আর এগোল না । ফিরে গেল । পরে সেখানকার কোন সাধু পুলিশকে বলেছিলেন যে তিনি নাকি পুলিশদের ঈশারা করেছিলেন বুনো শুয়োরটার দিকে । ওটা শুয়োর ছিল না । এক জলজ্যান্ত মানুষ শুয়োরের মত ঢাল বেয়ে তরতরিয়ে উপরের দিকে চলে গেছে।
উত্তরকাশী ছেড়ে আরণ্যক ফিরলেন কানপুরে । কি ভাবে ফিরলেন তা শুধু তিনিই জানেন ।
এদিকে তাঁর টাকা পয়সা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তিনি কানপুরে রাধাকৃষ্ণ জিউয়ের মন্দিরে এসে বসলেন । পরণে হাঁটু অব্দি ধুতি আর হাফশার্ট । মন্দিরে প্রণাম জানিয়ে পূজারীর কাছে নিবেদন করলেন পকেটমারির গল্প । সজ্জন দেখে পূজারীর মায়া হল । প্রসাদী খাইয়ে পূজারী হিন্দিতে বললেন - কাহাঁ কে রহনেবালা হ্যায় আপ?
- লক্ষ্ণৌ কে মহারাজ । কানপুর আয়া থা কুছ কাম কে লিয়ে । বিলকুল বেকার হুঁ । কামধান্দা কুছ নেহি হ্যায় । তো ইধার আয়া থা কাম খোঁজ নে কে লিয়ে। বাসমে লুট গয়া সবকুছ । অগর কোই কাম দিলবা দে তো বহুত মেহেরবানী হোগা ।
পূজারী হাসলেন । তিনি নিজে সেবাইতের কাজ করে সংসার চালান । কি কাজ তিনি জোগাড় করে দেবেন। কিন্তু লোকটি এমন করুণ মুখে রয়েছে যে তিনি হাঁ বা না কিছু বলতে পারছেন না ।
আগন্তুক বললেন - কোই ভি কাম । দুকান কা করমচারী ইয়া মন্দির মে কুছ কাম হ্যায় তো ---
পূজারী এক লহমা ভেবে নিয়ে বললেন - পূজা করনে জানতে হ্যায় আপ ? মন্ত্র পড়নে মে তকলিফ তো নেহি হ্যায় ?
আরণ্যক তখন স্পষ্ট উচ্চারণ করে প্রণাম মন্ত্র বললেন - হে কৃষ্ণ ! করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপতে,
গোপেশ গোপীকাকান্ত রাধাকান্ত নমোহস্তুতে।
পূজারী বললেন - উপবীত হ্যায় তো ?
আরণ্যক কাঁধের পৈতে টেনে দেখিয়ে দিলেন।
- সচ্চা ব্রাহ্মণ হুঁ ম্যায় জী !
পূজারী অনেক দিন থেকে একজনের খোঁজে ছিলেন। রাধাকৃষ্ণ আজ তা এনে দিলেন ।
বললেন - রোকড়া কিতনা লোগে ভাইয়া ?
- যো মর্জি দিজিয়েগা । লেকিন খানা ঔর রহনে কা জাইগা দিজিয়ে গা জরুর ।
পূজারী মন্দিরের মালিককে জানিয়ে তাঁকে রেখে দিলেন । মন্দির সংলগ্ন পাকশালায় থাকা এবং খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিলেন ।
( ক্রমশ )
-
