ললন্তিকা ধারাবাহিক অন্তিম পর্ব
ললন্তিকা ধারাবাহিক অন্তিম পর্ব
পর্ব একশত ছয়
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ যতই তোড়জোড় করুক না কেন ; আদালত পুলিশের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন । বিচারক আরণ্যক বসুরায়ের তদন্ত বিষয়ক কাজটি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ থেকে সি বি আইয়ের উপর ন্যস্ত করলেন । নির্দেশ দিলেন আরণ্যক বসুরায় সমর্কিত সব মামলা , কাগজপত্র সি বি আইকে হস্তান্তর করতে এবং প্রয়োজন মত সি বি আইকে তদন্তে সাহায্য করতে।
এদিকে মিঃ বসুরায় যে বাংলাদেশে পালিয়েছেন পুলিশ অনাবশ্যক রূপে তা' জাহির করতে গিয়ে মামলা হাতছাড়া করে ফেলল ।
যদিও সি বি আই ইতিমধ্যে ইন্টারপোলে আবর দিয়েছে , তারাও তেমন কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না । চলছে চলবে করে হময় গড়িয়ে যায় । আরণ্যকের প্রতিপত্তি উগ্রপন্থীদের উপর প্রভাব ফেলে । তাঁর হিন্দু বিদ্বেষী মনোভাবে মৌলবাদী দলগুলিও বেশ সন্তুষ্ট হয়। তাঁকে নিরাপত্তার বেড়াজালে ভরে দেওয়া হয় ।
এতে আরণ্যক তথা বাছিরুদ্দিন বাড়তি সুবিধা পেয়ে যান। নিজেকে ভি ভি আই পি ভাবতে থাকেন । আরণ্যককে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী সিম এবং নতুন নতুন মোবাইল দেওয়া হয় । এমনকি স্যাটেলাইট ফোনও প্রোভাইড করা হয় ।
কারণে অকারণে তাহেরপুরে আন্দোলন শুরু করেন । জনজীবন অস্থির করে তোলেন । মূলত হিন্দুবিদ্বেষ ছড়ানোর জন্যই এই প্রচেষ্টা । তাহেরপুরের সংখ্যালঘু হিন্দু সমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়লে মিঃ দেবেন্দ্র ভৌমিক আর চুপ করে থাকতে পারলেন না ।
কড়া নোট পাঠালেন ঢাকার সচিবালয়ে । স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে সাবধান করেন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি নিয়ে । নড়েচড়ে বসে প্রশাসন । বাংলাদেশ রাইফেলসের বেশ কয়েকটি প্ল্যাটুন তাহেরপুরে রুট মার্চ করে । তাঁরা হিন্দুদের ঘরে ঘরে গিয়ে ভরসা জোগান ।
বাছিরুদ্দিনের প্রতিশোধস্পৃহা তখন তুঙ্গে । তাঁর একমাঊ লক্ষ্য ভৌমিক বাড়ির দিকে । আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত করেন তিনি। অযথা পুলিশি সংঘর্ষ পছন্দ নয় তাঁর। কিন্তু যাদের তিনি উস্কানি দিয়ে মাথায় তুলেছেন ; তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে । ' বাছির মিঞা মুর্দাবাদ ' ধ্বণিতে তাহেরপুরের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে । মিঃ ভৌমিকের মনে বিদ্যুৎ খেলে যায় । কে এই বাছির মিঞা?
হঠাৎ করে তার উত্থান হল কি করে ?
খবর সংগ্রহ করতে লাগলেন তিনি । ভি আই পি মর্য্যাদা পেয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যান তিনি । লোকেরা বিশেষত যারা অশান্তি এড়িয়ে যেতে চান তাঁরা ভৌমিক সাহেবের বদান্যতায় আনন্দিত হয়ে উঠে পড়ে লাগেন বাছির মিঞার খবর জোগাড় করতে ।
জনতার রোষানলের শিকার হয় আলমগীর হোসেইন । আধমরা অবস্থায় সবার সামনে আলম স্বীকার করে নেয় সে-ই বাছিরকে দলে ঢুকিয়েছিল । তাকে ধরে নিয়ে আসা হয় মিঃ ভৌমিকের সামনে ।
জোড় হাত করে আলম প্রাণভিক্ষা চায় । মিঃ ভৌমিক বলেন - বাছির মিঞার আসল নাম কি ?
আলম বলে - বাছিরুদ্দিন।
- সে কোথাকার লোক ?
- সঠিক বলেনি স্যার । কখনো বলে নোয়াখালী, কখনও নবাবগঞ্জ আবার কখনো বলে ঢাকার নাখোদা মসজিদ।
খবর নিলেন মিঃ ভৌমিক নাখোদা মসজিদে। ওঁরা বললেন কোনও ইমামকে কখনোই তাহেরপুরে পাঠানো হয়নি । আর বাছির নামে কাউকে তাঁরা চেনেন না।
মিঃ ভৌমিক বললেন - বাছির বা বশীর কোন নামের কেউ ইমাম আছেন নাকি ?
তাঁরা বলে দিলেন - ওই একই হল । বাছির বশীর বলে কেউ নেই ।
ভৌমিকের সন্দেহ বেড়ে গেল । তিনি বি ডি আরের হাতে আলমকে অর্পণ করে বললেন - এদের সম্বন্ধে রিপোর্ট দিন গোয়েন্দা দপ্তরে । আমিও কথা বলে নিচ্ছি।
তারপর তিনি আলমকে ফের প্রশ্ন করেন - তাহেরপুরে কি ঘটানোর পরিকল্পনা তোমাদের ছিল ?
আলম প্রথম দিকে বলতে চায়নি । চাপে পড়ে বলল - স্যার, ওর লক্ষ্য ছিল ভৌমিক বাড়িতে খুন খারাবি করে পালাতে।
এবার ভৌমিক সাহেবের সন্দেহ দৃঢ় হল । তিনি বললেন - বাছিরের ধর্ম কি ?
- স্যার বলেছে কট্টর মৌলবাদী এবং ইসলামী। তবে বাড়িতে সেদিন বীফ খেতে অস্বীকার করে বলেছিলেন কখনও খাইনি তো ! দাও।
মিঃ ভৌমিক বললেন - খেয়েছিল ?
- হাঁ স্যার, চেটেপুটে খেয়েছিল । বলেছিল বাঙালি মুসলমানের রান্নার স্বাদই আলাদা।
ভৌমিক সাহেব বললেন - তুমি কি কনফার্ম সে মুসলমান ছিল ?
- কথাবার্তায় তেমন কিছু পাইনি স্যার । তবে একদিন ঘুমের ঘোরে ভুল বকেছিলেন। চেঁচিয়ে বলেছিলেন - বনলতা ! কনক তো সধবার বেশে মরেছে । তোমাকে আমি বিধবা করে মারব ।
মিঃ ভৌমিক প্রমাদ গণলেন । এ যে আরণ্যক বসুরায় । ভারত থেকেই তাঁদের পিছু নিয়েছে।
তিনি পুলিশ, সি বি আই, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, এবং ইন্টারপোলকে সব অবগত করলেন ।ঢাকার স্বরাষ্ট্র দপ্তরে মেইল করে জানালেন। তাঁর নিরাপত্তা নিয়েও কথা বললেন ।
আলমকে বি ডি আর গ্রেপ্তার করল । তাহেরপুরের ওই মৌলবাদী সংগঠনের ঝাঁপ বন্ধ করা হল । সদস্যদের অনেকেই গ্রেপ্তার হল ঠিকই কিন্তু আরণ্যকের টিকিটিও পাওয়া গেল না ।
মিঃ ভৌমিক বাড়ির সকল অভ্যাগতদের জানালেন অনির্দিষ্টকালের জন্য আপনারা কেউ ভারতে যেতে পারবেন না । কারণ আমার ধারণা আরণ্যক ভারতে পালিয়ে গেছে । ওখানে গেলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
অনিচ্ছাসত্বেও সবাই সেই নির্দেশ মেনে নিলেন । এখানের নিরাপত্তা ফের বাড়িয়ে দেওয়া হল ।
মনখারাপী নিয়ে অতিথিরা বাংলাদেশেই থেকে গেলেন ।
কয়েকদিন পর জানা গেল বাছিরুদ্দিনই মিঃ আরণ্যক বসুরায় এবং তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না ।
অভয়ঙ্করবাবুই প্রথম কথা বললেন ।
- বেয়াই মশাই! ভুল সময়ে আমরা এসে পড়লাম। আপনার জন্য আশঙ্কা হচ্ছে । এখন তো আর ফিরে যেতে পারব না । তবে আপনি যদি সাহায্য করেন ; তবে কয়েকদিনের ভেতর যেতে পারব আশা করি।
মিঃ ভৌমিক বললেন - ইচ্ছে করলে কালই যেতে পারেন। আমি নিষেধ করছি এই কারণে যে এখানে নিরাপত্তা বেশ আঁটোসাঁটো । দেখতেই পাচ্ছেন মাছিটিও গলতে পারছে না ।
সজ্জন সিং বললেন - লেকিন সাহাব, কবতক য়হাঁ রহনা হোগা ?
মিঃ ভৌমিক বললেন - এখানে তো আপনাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয় না । আমি চাইছি আরণ্যকের অবস্থান স্পষ্ট হলেই আপনাদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে ।
- দ্যাটস অ্যান ইণ্ডেফিনাইট পিরিয়ড।
হঠাৎ বাগানের দিকে বুমমম্ করে একটা বিকট আওয়াজ হল। প্রথমে মনে হল ল্যাণ্ডমাইন বিস্ফোরণ । সকলে তরতরিয়ে নীচে নেমে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন।
আরণ্যক বসুরায় ডিনামাইট ফাটিয়ে ভেতরে ঢোকার রাস্তা করে নিলেন । ওই তো দেখা যাচ্ছে মৌলভীর মত দেখতে একজন ঢুকে পড়ল ভেতরে । এলোমেলো গুলি ছুঁড়তে দেখা গেল । সিকিউরিটি বাড়িটা ঘিরে ফেললন। বাসিন্দাদের সকলকে বাইরে রাজপথে এনে গাড়িতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল । নিরাপত্তা রক্ষীরাও গুলি ছুঁড়তে লাগল । ছাদ থেকে লাফ দিলেন আরণ্যক বসুরায়। একে ৪৭ ধরে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাগান পেরিয়ে যেতেই ভৌমিক সাহেবের গুলি তাঁর বুক ভেদ করে বেরিয়ে গেল। তিনি পড়ে গেলেন। মিঃ ভৌমিক তাঁর মাথায় আরও দুটো গুলি করলেন । একটি অধ্যায় শেষ হল।
ললন্তিকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল । তাকে থামানো যায় না। সজ্জনও কিছু করতে না পেরে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে পড়লেন গাড়ির সীটে ।
মেয়েরা সকলে ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছেন । এমনকি রেঞ্জার সাহেবের মত লোকও বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন ।
সাহস করে কল্যাণী বোতল থেকে জল নিয়ে ললন্তিকার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল । ললন্তিকা এতক্ষণ যেন কোন ভিন গ্রহে ছিল । চেতনা ফিরে পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল ।
আরণ্যককে শেষ করে মিঃ ভৌমিক বীরদর্পে এগিয়ে এসে বললেন - এবার যে কোনদিন আপনারা ভারতে যেতে পারেন অথবা ইচ্ছে করলে কিছুদিন থেকেও যেতে পারেন । আমি নিজের হাতে আরণ্যককে শেষ করে দিয়েছি এবং প্রমাণস্বরূপ এই এটা এনেছি।
বলে আরণ্যকের কাটা পুরুষাঙ্গটি ললন্তিকা ও সকলকে দেখালেন ।
ললন্তিকা সনাক্ত করল এটা আরণ্যকেরই।
( সমাপ্ত )
