জয়ন্তী মঙ্গলা কালী
জয়ন্তী মঙ্গলা কালী
শিমুলগঞ্জের তালপুকুরের পাড়ে আমাদের বাড়িটা সেসময় ছিল মা দুগ্গার চালচিত্রের মতো।
বহুমানুষের বাস। ওপর তলায় লম্বা বারান্দা জুড়ে সারসার ঘর।
নীচে থাকতো দুটো চাকর, রান্নার ঠাকুর, একটা জমিজমা দেখাশোনা করার মজদুর আর একজন মাস্টার, ইনি আবার সবর অবসরে হোমিওপ্যাথিও করতেন।
উঠোন পেরিয়েই পড়তো ঠাকুরদালান। প্রতিবছর ঐখানেই মা দুগ্গা প্রি-পূজার মেকআপ সেরে নিতেন। সে এক দেখার মতো জিনিস। রথের দিন কাঠামো পুজো দিয়ে শুরু হতো দত্ত বাড়ির মা'দুগ্গার সাজ। তখন অবশ্যি আমাদের জেনারেশনের আবির্ভাব ঘটেনি। সব শোনা বাবা কাকা জ্যেঠুদের থেকে।
আমার প্রপিতামহ চৈতন্য দত্ত তখন সদ্য বিবাহিত। অষ্টমঙ্গলায় স্ত্রী অলকাসুন্দরী নিজের দুশো ভরি গয়না পরেই পিতৃগৃহে গেলেন। এবং ফেরত আসার দিন দুয়েক পরেই ঘটলো একটা ঘটনা। মাঝরাতে মশালের আলোয় আর 'হা রে রে রে' নিনাদে ভরে উঠল চারিদিক। অলকাসুন্দরী বুদ্ধিমতী ছিলেন, সমস্ত গয়না একটা কাপড়ের পুটলিতে বেঁধে ফেলে দিলেন বাড়ির পিছনের পুকুরে।
পুটলিতে গয়নার সাথে আরও একটা জিনিস বেঁধেছিলেন অলকা, একটি অষ্টধাতুর দূর্গামূর্তি, অলকার ঠাকুমার জিনিস।
পুটলি ফেলে সংকল্প করলেন, "সব যদি রক্কে করো মা, তাহলে প্রতি বছর তোমার মৃন্ময়ী মূর্তি ঘরে আনবো। সোনায় ভরিয়ে দেব তোমায়।"
মা দুগ্গা বোধহয় প্রার্থনা শুনেছিলেন।
ডাকাতদের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ সংবাদ প্রেরক যে, সে খবর দিয়েছিল, তালপুকুর পেরিয়ে প্রথম বাড়ি। দত্ত বাড়ির বিপরীতে ছিল ঘোষবাড়ি। প্রেরক দিক বলতে ভুলে গিয়েছিল বোধহয়, তাই ঝড়টা উল্টোদিকের বাড়ির ওপর দিয়েই চলে গিয়েছিল।
মানত মত সেবছর থেকেই শুরু হলো দত্তবাড়ির দূর্গাপুজো।
সালঙ্কারা মা আসতেন পুরো পরিবার নিয়ে। শিব ঠাকুরও বাদ যেতেন না। দত্তবাড়ির দূর্গা সিংহবাহিনী, তবে অসুরনিধনকারিণী নন। শিবের পাশে বসে দুই পাশে ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঘোরতর সংসারী।
--------------------------------
পচা ভাদরের ভ্যাপসা গুমোটের পর যেমন শরতের শিশির আর শিউলি অবধারিত, ঠিক তেমনই শরতের পয়লায় জয়ন্তীর বাপেরবাড়ি আগমনটাও ছিল চিরাচরিত। জামাতা শশীশেখরও আসতেন, তবে তাঁর ছুটির মেয়াদ ছিল দশমী পর্যন্ত। জয়ন্তী একেবারে ভাইফোঁটা কাটিয়ে পুজো ভ্যাকেশন কমপ্লিট করতেন।
সেবছর ভাইফোঁটার আগেরদিন শুরু হয়েছিল জয়ন্তীর ভেদবমি। তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা জয়ন্তী যা খান তার চতুর্গুণ বের করে দেয়। বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
মা দুগ্গার কাছে অনেক মাথা কুটে, অনেক গয়না মানত করেও জয়ন্তীকে ফেরানো গেল না। তার তিন মাস পরেই...!
শশীশেখর উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন।
বেগতিক দেখে চৈতন্য ছোট মেয়ে মঙ্গলার সাথে জামাতার বিবাহ মনস্থির করলেন। মঙ্গলাও আপত্তি করেননি।
কিন্তু জ্যেষ্ঠাকন্যা জয়ন্তীর অকাল প্রয়াণ শোকে অলকা ঠিক করলেন, আর মাতৃপুজা করবেন না।
কিন্তু তিনি স্বপ্ন পেলেন, ডাকের সাজে সুসজ্জিতা হয়ে স্বয়ং মা ছলছল চোখে সদর দরজার বাইরের দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
সেবছর ডাকের সাজেই মা এলেন। তবে অলকাসুন্দরী কিছু স্বর্ণালঙ্কার প্রতিস্থাপন করালেননা। মায়ের নাকে থাকলো সোনার নথ, কোমরে থাকলো সোনার কোমরবন্ধনী, পায়ে থাকলো সোনার নুপুর। বাকি অলঙ্কার সাদা শোলার।
পুজো চললো। কিন্তু সে পুজোয় অলকা নিজে উপস্থিত থাকলেন না। পর্দার আড়ালে থেকে সবকিছুর তত্ত্বাবধান করতেন।
বিয়ের পর থেকে পুজোর সময় বাপের বাড়ি একাই আসতেন মঙ্গলা। শশীশেখর বিজয়ার প্রণাম সারতে আসতেন কেবল। থাকতেন না, চলে যেতেন।
মঙ্গলা একেবারে জগদ্ধাত্রী পুজো কাটিয়ে তবে বাড়ি ফিরতেন।
আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি মঙ্গলিকে( আমি ওই নামেই ডাকি, প্রথম গার্লফ্রেন্ড কিনা!), যাকে বলে একদম সাবেকি রূপে দেখে এসেছি। চওড়া পাড় লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, মাথা ভর্তি সাদা চুলের মাঝখানের সিঁথিতে সবসময় জ্বলজ্বল করতো সিঁদুর, টিকালো নাক, মুখে হাসিটি লেগে থাকতো সবসময়।
আজ পর্যন্ত কোনোদিন কারোর নামে মন্দ কথা বলতে শুনিনি। উপরন্তু গীতার কিছু শ্লোক এমন অবলীলায় বলে দিতেন যে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে হতো। অনেক ভারী ভারী জীবনবোধ গল্পের ছলে আমাদের শুনিয়ে দিতেন।
কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনোদিন আমাদের ওঁর বাড়ি যেতে বলেননি। আমরা 'যাবো' বললে বলতেন, "তোরা কি আর ওখানে গিয়ে থাকতে পারবি?"
বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম, "মঙ্গলিরা কি গরীব? আমাদের বাড়িতে ডাকে না কেন?"
বাবা স্নেহের ধমক দিতেন," ছিঃ! উনি না গুরুজন! ওরকম বলতে নেই, হয়তো ওঁর কোনো অসুবিধে আছে!"
আমি, আমরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ভাগ হতে থাকলো। দত্তবাড়ির সেই 'একান্নবর্তী' তকমাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তবে পুজোর সময় সবাই আবার হাজির হৈহট্টগোল। সেই ঠাকুরদালান সরগরম, বড় হেঁসেলে আমাদের দাদুদের ছয় তরফের গিন্নিদের কলতান, কর্তাদের পায়চারি, ব্যস্ততা আর আমরা কুচোদের, বড় কোনো দাদা কিংবা ছোট কোনো কাকুর কাছে বসে যত্তসব আজগুবি গল্প শোনা।
আমাদের ছোটবেলার পুজোটা শুরু হতো মহালয়ার দিন থেকে। ভোর হতে না হতেই রেডিওতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী দিয়ে শুরু হতো দিন।
আমার মেজদাদু রতিকান্ত দত্ত ওইদিন আমাদের কুচোদের নিয়ে চলতেন গঙ্গায়, তর্পণ করতে। ওঁর উদাত্ত কণ্ঠে "ওঁ জবাকুসুমসংকাশঙ কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম..." শুনলে মনে হতো, সত্যিই যেন গঙ্গার জল ওঁর হাতের করজোড় কমন্ডলু দিয়ে তর্পিত হচ্ছে পূর্বপুরুষের প্রতি। আমরা নদীর পাড়ে বসে অবাক হয়ে দেখতাম, জলের স্রোত যেন হীরের দ্যুতি ছড়াচ্ছে সূর্যের আলো মেখে।
তারপর তালপুকুরের পাড়ে চৈতন্য দত্ত এবং অলকাসুন্দরীর সমাধির বেদীতে বাবু হয়ে বসতাম, এই আমার মত প্রায় ডজনখানেক কচিকাচা। মেজদাদু শোনাতেন মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল।
ও হ্যাঁ, তার আগে অবশ্যি টিভিতে মহালয়া দেখার পাঠ চুকিয়ে নিতাম।
মায়ের বোধনের দিন, যখন বেলতলায় শাঁখ বাজতো, মা দুগ্গা অলোকাসুন্দরীর নির্ধারিত গয়না আর ডাকের সাজে সুসজ্জিতা হয়ে স্বামী ছেলেপুলে সঙ্গে নিয়ে রেডি হয়ে যেতেন আমাদের সঙ্গে ক্লোজআপে, ওমনি খিড়কি দিয়ে 'কই রে কোথায় গেলি সব?' বলে মঙ্গলি হাজির হতেন বাক্সপ্যাটরা নিয়ে।
পলাশ কাকু মানে দিদার ছেলে ছিলেন ভারী রসিক মানুষ। যেকোনো অনুষ্ঠানে মজার কথা শুনিয়ে আর ক্যারিকেচার করে সারা বাড়ি জমিয়ে রাখতে ওস্তাদ।
কাকু জ্যেঠুরা সব্বাই মঙ্গলিকে শাড়ি দিতেন, আর মঙ্গলি আমার মা'র থেকে প্রতিবার চেয়ে নিতেন একজোড়া পেটিকোট আর ব্লাউজ। সঙ্গে সিঁদুর আলতা তো ছিলই। মাও খুশি মনে একটা গরদের শাড়িও দিতেন সঙ্গে, যতই হোক, ছেলের ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড বলে কথা! আর তার বিনিময়ে মঙ্গলি আমার গাল টিপে বাম চোখ মেরে দিতেন।
উঃ! সে যে কী রোমাঞ্চ!
-------------------------------------------------------------
অফিসের বড্ড চাপ যাচ্ছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম পুরো অভ্যেসটাই পাল্টে দিয়েছে। লাঞ্চের সময় ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি আর সন্ধ্যেয় জুটছে লাঞ্চ।
বউ মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে, মেয়ে আমার থোবরাটাই ভুলে গেছে বোধহয়!
মধ্যরাতে যখন ডিনার টেবিলে বসি, মনে হয় কোনো ঘুমের রাজ্যে আমি একাকী বিচরণ করছি জেগে।
আজ হঠাৎ এ ঘটনার ছন্দপতন হলো। খাওয়ার টেবিলে মা বসে। বুকটা ভরে উঠেছিল, বিশ্বাস করুন, চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর সনাতন বাণীটা মনে পড়লো, "বউ হারালে বউ পাওয়া যায় রে পাগলা, মা হারালে...!"
মা পরম স্নেহে তাকালেন, আহারে! কাজ কাজ করে ছেলেটা শুকিয়েই যাচ্ছে!
যাক! এ সংসারে, মা'র ভালোবাসায় তবে ভেজাল মেশেনি। বিগলিত হৃদয় নিয়ে সবে রুটি ছিঁড়ে মুরগির ঝোলে ডুবিয়েছি, মা মিহি সুরে বললো," শিমুলগঞ্জ থেকে খবর এসেছে বাপিন। তোর সময় হবে? বড়জ্যেঠু সব ভাইদের ডেকে পাঠিয়েছেন।"
মনটা উড়ু উড়ু যেমন করে উঠলো, বুকটা দুরু দুরুও করলো সমান তালে। শীতল শৈশবী একটা হাওয়া কানের পাশ দিয়ে বয়ে গেল এবং তৎক্ষণাৎ শিলার হিমশৈলর মতো মুখটা মনের গহীনে উঁকি দিলো। প্ল্যান করা আছে, ষষ্ঠী থেকে টানা পাঁচদিন এবছর রাবাংলা কনফার্ম।
কী করি!
বউ না মা?
বউ না শৈশব?
রুটি চিবানো থামিয়ে বললাম, " হঠাৎ? আবার পুজো শুরু হবে নাকি?"
মা উঠে দাঁড়িয়েছে, "জ্যেঠুরা প্রপার্টির ব্যাপারে একটা আলোচনায় বসতে চান। প্রমোটার ডেকেছেন। তাছাড়া অনেকদিন শিমুলগঞ্জ যাইনি...!"
জিও!
বউয়ের কথা শ্লা থোড়াই শুনবো!
মালকড়ি প্রাপ্তির এমন সম্ভাবনা, ও রাবাংলা পরের বছরে হবে।
কিন্তু, উঃ! এহেন প্রলোভনও যেন শিলার শীতল চাহনি ভুলতে দিচ্ছে না। কী যে করি!
আত্মশ্লাঘা!
ছিঃ! আমি না পুরুষ, পুরুষসিংহ! বউকে এই ভয়!
এইতো! বুকে বল ফেরত আসছে, ইয়েস!
-------------------------------------
ইতিমধ্যে ফোনে, হোয়াটস আপে তুতো দাদা, ভাই, বোনদের সাথে কথা হয়ে গেছে। বহুবছর পর আবার সেই পুরোনো মজলিশ।
ভাবতেই যা লাগছে না!
টু পাইস প্রাপ্তিও তো নাচছে কপালে! দিলটা পুরো গার্ডেন গার্ডেন হয়ে গেছে। বউকে থোড়াই পাত্তা দেব আর! ঘেঁষবোই না কাছে! ফুঁ! হুমহুম বাওবা! ক্যাশের এমনই ক্যারিশমা!
---------------------------
আমরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ভাঙতে শুরু করেছিল। সদস্যরা যে যার সুবিধে মতো চলেও গেল অন্যত্র।
দত্তবাড়ির মৃন্ময়ী পুজোও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কে করবে? তাছাড়া নির্ধারিত গয়নাই বা কোথায় এখন?
তখন আমরা খুব ছোট, নবমীর দিন যথারীতি পুজো শেষে সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে বেড়িয়েছি, বাড়িতে তখন বড়মা, জ্যেঠু আর মঙ্গলি।
ভোরবেলা ক্লান্ত শরীরে ঢুলু ঢুলু চোখে বাড়ি ফিরেই চক্ষু চড়কগাছ। সদর দরজা হাট করে খোলা, মা দুর্গার নথ, কোমরবন্ধনী, নুপুর ভ্যানিশ। ডাকের সাজে মা ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে আছেন যেন।
থানা পুলিশ করেও কোনো লাভ হয়নি। মধ্যিখানে থেকে পুজোটা বন্ধ হয়ে গেল।
বড়রা ছলছল চোখে সান্ত্বনা নিলেন, "বোধহয় মা'র আর ইচ্ছে নেই এবাড়িতে আসার। নাহলে নিজের অলংকার রক্ষা করতে পারতেন না? কম ঘটনাও তো ঘটছে না পুজোকে কেন্দ্র করে!"
মঙ্গলির বাপেরবাড়ি আসাটাও ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। কোনো বড় অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, অন্নপ্রাশন ছাড়া মঙ্গলির আর খোঁজ হতো না।
পারস্পরিকতা কমতে লাগলো, ব্যস্ত জীবন যে সবার!
মঙ্গলিও আমার চোখে এখন অতীত, ভুলেই গেছি ওই নামটা, ওই নামের মানুষটাকে, আমার প্রথম গার্লফ্রেন্ডকে।
বাকিদের, বিজয়া আর পয়লা বৈশাখে হোয়াটস আপে শুভেচ্ছা বিনিময় ছাড়া যোগাযোগের আর সময় কই?
শিমুলগঞ্জের বাড়িটা একমাত্র বড় জ্যেঠু আগলে থেকেছেন এতদিন।
অলকাসুন্দরীর অষ্টধাতুর দুর্গা চারদিন পুরোহিত ডেকে পুজো করিয়ে নেওয়া হয় নমঃ নমঃ করে।
দত্তবাড়ির জৌলুস আর নেই, ইঁট, পলেস্তারা ভাঙছে, লোকাল প্রমোটার রফা করে গেছেন বড় জ্যেঠুর সঙ্গে। পুজোর সময় মোটামুটি সবারই ছুটি থাকে, সেটা ভেবেই সবাইকে এরূপ তলব।
ডিনার সেরে কাজে ফিরলাম। কিন্তু মন বসাতে পারছিনা। ল্যাপটপের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে সিঙ্ঘানিয়ার নতুন রিসোর্টের প্রজেক্ট, আর আমার মোবাইল লকস্ক্রীনের মার্কলাইন,... অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লীপ!
সব কিছু কেমন যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো লাগছে।
একটা আবছা মুখ, কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। 'শিমুলগঞ্জের দুর্গাপুজো' নামটা যতবার ভাবছি, ততবার মুখটা যেন ভেসে উঠছে মনে। কিন্তু কে, কার মুখ?
ধুৎ! এ ভাবে কাজে কনসেন্ট্রেট করা যায়?
ল্যাপটপ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।
শিলা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তার মানে শিমুলগঞ্জের প্ল্যানটা এখনও জানেনা।
থাক বাবা! আজ আর জানানোর প্রয়োজন নেই। মাঝরাতে পুরুষসিংহের বর্ম ছেড়ে খরগোশ হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই, যথেষ্ট পরিশ্রম হয়েছে আজ।
একটা স্বপ্ন দেখলাম।
একজন মহিলা, কোমর ভেঙে গেছে, একমাথা সাদা চুল, সিঁথিতে দগদগে সিঁদুর, লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে আমাদের বাড়ি এসেছেন, মাকে ডাকছেন, "হ্যালা কোথায় গেলি লা? বলি অ বউ! ন'বৌদি নেই বলে কি আর আমি একটা শাড়িও পাবো না?"
মঙ্গলি!
ঘুম ভেঙে দড়াম করে লাফিয়ে বসলাম। হ্যাঁ! মঙ্গলিই তো! কেমন আছে বুড়ি? কেউ কি খোঁজ নেয় তাঁর?
মঙ্গলিকে শেষ দেখেছিলাম খুড়তুতো বোন পাপড়ির বিয়েতে। কিন্তু সেটা অন্য বেশে। ততদিনে পিসিদাদু গত হয়েছেন, মঙ্গলির সেই এয়োস্ত্রী সাজ বদলে চুলের সঙ্গে রংমিলান্তি হয়েছে। সেই ক্ষুরধার দৃষ্টি আর নেই, সেই সুচারু ঠোঁটের হাসিটিও ছিল না। যতদিন পলাশকাকু রেখে গিয়েছিলেন ওবাড়ি, মায়ের খাটে কেবল ঘুমিয়েই কাটিয়েছিলেন।
চিবুক শক্ত করে বদ্ধপরিকর হলাম, বউ চুলোয় যাক, আগে তো গার্লফ্রেন্ড, তার ওপর সে যদি ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড হয়!
------------------------------------------
আমি আর টুটুল চলেছি মঙ্গলির বাড়ি। এর আগে কখনও আসিনি। বাবার থেকে ঠিকানা জেনে নিয়েছিলাম।
পিচরাস্তা পেরিয়ে শুরু হয়েছে ইঁটের রাস্তা। এবছর অসময়ে বৃষ্টি হয়েছে দেদার। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। রাস্তায় একজন মধ্যবয়স্ককে পলাশ কাকুর নাম বলতে বাড়িটা দেখিয়ে দিলেন।
আমি আর টুটুল কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখলাম। আমাদের দত্তবাড়ির দুগ্গার কৈলাশ তবে এটা!
দুই পাশে পুকুর, মাঝখানে ইঁটের সরু রাস্তা, ইঁট বের করা চুন সুরকি খসা দেওয়াল বরাবর কালো ত্রিপল টাঙানো। বহুদিন মেরামত হয়নি। দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে ছোট ছোট পরজীবীর চারা।
দরজার সামনে গিয়ে টোকা দিলাম বেশ কয়েকবার। প্রায় মিনিট পাঁচ পর দরজা খুলল।
মঙ্গলি দাঁড়িয়ে। রোগা জিরজিরে শরীরে হাড়ের ওপর পাতলা মাংসের আস্তরণ। শরীরের ঊর্ধ্বভাগ ব্লাউজবিহীন, একটা ময়লা ধুতি শাড়ির মত জড়ানো। মাথায় পাতলা রুক্ষ্ম চুল, ঠকঠক নড়ছে ঘাড়টা। ঘোলাটে চোখে স্থির তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। চিনতে পারেনি বোধহয়।
পলাশ কাকু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি ফিরলেন। আমাদের দেখে যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, বোধহয় কস্মিনকালেও ভাবেননি আমরা আসতে পারি ওঁর বাড়িতে। শত বারণ সত্বেও মিষ্টি আনালেন, প্লেটে সাজিয়ে এগিয়ে দিলেন আমাদের দিকে," বাবার পেনসনটা আঁটকে আছে রে। টিউশন করে ক'টাকাই বা হয়! এখন তো সব আবার অনলাইন ক্লাস, আমার তো ওসব ঠিক...!"
অহেতুক হাসি দিয়ে নিজেকে লুকোতে চাইছেন পলাশ কাকু," মা'ই বেশ আছে জানিস! সব ভুলে ব্যোম হয়ে আছে। দ্যাখ না দ্যাখ সারাদিন কী ল্যাদটাই না খাচ্ছে!"
-----------------------------------------------------------------
ঠাকুরদালানে চেয়ার পাতা হয়েছে। বাবা কাকু জেঠুরা এসেছেন। বাকি ভাই বোনেরাও জড়ো হয়েছে একে একে।
মঙ্গলি আর পলাশ কাকুকে নিয়ে আমি আর টুটুল সদর দরজায়। কড়া নাড়তে মা এসে দরজা খুলে দিল।
মায়ের বিস্ময় মেশানো দৃষ্টিতে উচ্ছ্বাস, "পিসিমা! আপনি!"
অন্দরের সবাই উঠে দাঁড়িয়েছেন। বোধহয় কেউ ভাবেননি আমি আর টুটুল এরকম কিছু করতে পারি।
মঙ্গলি চারিদিক তাকিয়ে দেখছে, যেন প্রথমবার এসেছে সে এবাড়ি।
বাবার উদ্দেশ্যে বললাম, "মঙ্গলিকে তোমরা বাদ দিতে পারো না। এ বাড়ি বিক্রি হবে না। প্রমোটার ফিরিয়ে দাও। আমরা সবাই মিলে এবাড়ি মেরামতের দায়িত্ব নেব, যথেষ্ট রয়েছে আমাদের!"
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম বড়জ্যেঠুর কাছে," পলাশ কাকুর একটা উপার্জন দরকার। এবাড়িটা নাহয় ভাড়া দিলাম, জ্যেঠু তুমি কি রাগ করবে?"
বড়জ্যেঠুর চোখে আনন্দাশ্রু," কবে এত বড় হয়ে গেলি বাপিন?" বলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই মঙ্গলির গলা, "দুগ্গা পুজো! দুগ্গা পুজো হবে না?"
--------------------------------------------------
দত্তবাড়ির দুর্গাপুজো আবার শুরু হয়েছে। মা এবার সম্পূর্ণ ডাকের সাজে, জগদ্ধাত্রীরূপা।
অসুরদলনী ছাড়াও মা যে আশ্রয়দাত্রী, অন্নপূর্ণা।
আমাদের শৈশব আবার ফিরে এসেছে।
আমি দুচোখ ভরে এবাড়ির আনাচ কানাচের গন্ধ মাখছি।
ঠাকুদলানের সিঁড়িতে বসে রয়েছে মঙ্গলি। হ্যালোজিনের আলো এসে পড়েছে মুখে, এ মুখের দ্যুতি আমার বড্ড চেনা, আমার শৈশবের সম্পদ। কোনো সন্দেহ নেই, সব কিছুই আগে থেকে ঠিক করা থাকে। তাই তো এত ঘটনার ঘনঘটা। মায়ের ডাকের সাজের শ্বেত শুভ্র অবয়ব যেন ধরা পড়েছে মঙ্গলির মুখে। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে আমার।
হঠাৎ অস্তিনে টান। চমচম, আমার পাঁচবছরের কন্যা ডাকছে, "বাবা, মাম্মাম তোমাকে ডাকছে!"
গলাটা শুকিয়ে এলো। প্রথম প্রেম 'মঙ্গলি'র মান রাখতে বউয়ের 'জংলি' আবদার মেটাতে পারিনি। যাই দেখি, আমার হৃদয়ের প্রতিষ্ঠিত শিলাকে সন্তুষ্ট করতে পারি কিনা!
সবাই প্রার্থনা করুন, দুগ্গা দুগ্গা!!
জয় কালী!!!