Ananya Podder

Classics

4  

Ananya Podder

Classics

জলের আরেক নাম জীবন

জলের আরেক নাম জীবন

10 mins
1.1K


ঋজুর কলেজে ক্যাম্পাস কলিং ছিল | ঋজু বর্তমানে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ছে | ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে এসে দেখছি, ঋজু কিছুটা আপসেট | অথচ বছরে আট লাখ টাকার প্যাকেজে চাকরি পেয়েছে ও | মাইনের অঙ্কটা তো খুব একটা কম নয় !! তাহলে কী হোলো??


রাতে খাবার টেবিলে বসে অনিকেতের সাথে গল্প জমালো বটে ঋজু , তবে সে গল্পের তাল যেন ঠিক ভাবে বাজছিলো না |


ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হোলো না আমার| তাই ভাবলাম, শুতে যাবার আগে ওর সাথে একটু গল্প করি |


দরজা খুলে ঋজুর ঘরে ঢুকতে যাব, এমন সময় দেখলাম, ও সায়নকে ফোনে বলছে, "ঐশী, এত ভালো প্যাকেজ পেলো কী করে??... কলেজের সবচেয়ে ভালো চাকরিটা তো ওই লুফে নিল!! ... শালা, মেয়ে বলেই কি বাগাতে পেরেছে এটা!! ইন্টারভিউ রুমে চারজনের মধ্যে তিনজনই তো পুরুষ ছিল | পটে গেছে বোধহয় সব !!....


সবচেয়ে গা কোথায় জ্বলছে জানিস??.... ঐশীটা আবার আমারই গার্লফ্রেন্ড !! .... গলা জড়িয়ে ধরে যখন আমায় বলল, " এবার চাকরিতে জয়েন করেই বাড়িতে জানাবো আমরা, আমাদের সম্পর্কের কথা| ".... তখন মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল ||...


কী বলবো বাড়িতে?? আমার বউ আমার চেয়ে বেশি ট্যালেন্টেড, নাকি ফস্টিনস্টি করে কলেজের সবচেয়ে সেরা চাকরিটা বাগিয়ে নিয়েছে |....


সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হোলো, যে, আমাকে ওর এই এচিভমেন্টের সামনে হাসি হাসি মুখ করে থাকতে হচ্ছে | অসহ্য লাগছে আমার | আমি আমার প্রেমিকার সামনে এভাবে হেরে গেলাম!! "


আমি এতক্ষনে ঋজুর ফাস্ট্রেশনটাকে বুঝতে পারলাম| পুরুষ তো, তাই নিজের থেকে বেশি সফল প্রেমিকাকে মেনে নিতে পারছে না | আমি আর সেই মুহূর্তে ঋজুকে বিরক্ত করলাম না| চুপচাপ ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম |


প্রায় সপ্তাহ খানেক বাদে আমি একদিন ঐশীকে ফোন লাগালাম, অবশ্যই ঋজুর অজান্তে ও বিনা অনুমতিতে | বলতে দ্বিধা বা লজ্জা নেই, যে, ঋজুর ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট থেকে আমি একপ্রকার চুরি করেই ঐশীর নম্বরটা নিয়েছি | কাউকে না জানিয়ে, তার অনুমতি না নিয়ে তার ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে নেওয়াটাকে তো চুরি করাই বলে, তাই না??


সে যাই হোক, ঐশীর নম্বর নিয়ে একদিন ঐশীকে ফোন করে বসলাম | নিজের পরিচয় দিলাম | ঐশী আমার পরিচয় পেয়ে আমার সাথে নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে ভালো ব্যবহার করলো | আমি হবু শাশুড়ি বলে কথা !! এটুকু তো করতেই হবে ওকে | এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ছেলের মায়ের দেমাকটা যে একটু বেশিই থাকে |


আমি ঐশীকে এক শনিবারে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করি দুপুরে খাওয়ার জন্য | আমার নিমন্ত্রণে ও একটু অস্বস্তি বোধ করলে আমি বলি, " তোমার কোনো চিন্তা নেই | তুমি নিশ্চিন্তে আসতে পারো আমাদের বাড়িতে | অনিকেত মানে ঋজুর বাবা দিন পাঁচেকের জন্য শিলিগুড়ি যাচ্ছে, অফিসের একটা কাজে | আর ঋজুর ঠাকুমা আপাতত তাঁর মেয়ের বাড়িতে আছেন, বেড়াতে গিয়েছেন| তাই আপাতত আগামী শনিবার বাড়িতে ঋজু, আমি আর আমার সবসময়ে থাকা মেয়ে কৃষ্ণা ছাড়া আর কেউ থাকবে না| তুমি নিশ্চিন্তে আসতে পারো | তবে একটা অনুরোধ তোমার কাছে, তুমি আমাদের মধ্যেকার এই আলাপের কথা ঋজুকে জানাবে না, এমনকি নিমন্ত্রণের কথাও না | ঋজুকে বেশ একটা সারপ্রাইস দেওয়া যাবে !! ও বোধহয় ভাবতেও পারবে না, যে, আমরা ওর অজান্তেই বন্ধু হয়ে গিয়েছি !! "


আমার কথায় ঐশী আর বিশেষ কোনো আপত্তি করলো না | রাজী হয়ে সঙ্গ দিলো আমার পরিকল্পনায়|


নির্দিষ্ট দিন উপস্থিত হোলো | আমি বিরিয়ানি আর মটন কষা রান্না করলাম | ঐশীর ফেসবুকের পেজে যে এই ভালোবাসার কথা বারবার স্বীকার করেছে ঐশী | সাথে রাখলাম ফিস কবিরাজী, আনারসের চাটনি, রসগোল্লা আর দই |


আমার রান্নার প্রস্তুতি দেখে ঋজু বেশ অবাক হোলো | " হঠাৎ এত রান্না কেন , মা??... বাড়িতে কোনো গেস্ট আসছে নাকি?? "


আমি জবাব দিলাম, " হ্যাঁ, আমার এক বিশেষ বন্ধু আসছে| "


" এই বয়সে আবার তোমার বিশেষ বন্ধু ?? "... হেসে হেসে প্রশ্ন ছুঁড়লো ঋজু |


আমিও হেসে জবাব দিলাম, " হ্যাঁ রে, বিশেষ বন্ধুই বটে | আর বিশেষ বন্ধু বানাতে আবার বয়স লাগে নাকি রে??... ও তো যখন খুশি বানানো যায়?? "


"আমি কিছু হেল্প করবো নাকি তোমায়??.... "


" না রে, লাগবে না| "


"করিই না হেল্প, তোমার বিশেষ বন্ধুও জানুক যে, তোমার ছেলে একজন বেশ ভালো শেফ !! "


" তুই শেফ হিসেবে যে ভালো, সেটা মানতে দ্বিধা নেই| তবে আমার বন্ধু তোর চেয়েও ভালো শেফ |"


"বাব্বা, এত প্রশংসা!! .... তাহলে তো দেখতেই হচ্ছে তোমার বন্ধুকে| তাহলে, কখন আসছেন তোমার বন্ধু?? "


" চলে আসবে| সময় হলেই আসবে| "


বেলা একটা নাগাদ ঐশী আমাদের বাড়িতে আসে | ডোর বেল বাজলে আমি কৃষ্ণার বদলে ঋজুকে দরজাটা খুলতে বলি| ঋজু দরজা খুলে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে | বলা বাহুল্য, ঐশীকে এভাবে দরজার দোরগোড়ায় দেখে প্রথমে থতমত খেলেও পরে পুরো ব্যাপারটাতে একটু বিরক্ত বোধ করে সে | তবে, আমার ছেলে ভালো রাঁধুনি হওয়ার সাথে সাথে একজন ভালো অভিনেতাও | তাই মনের বিরক্তিকে বাইরে প্রকাশ করলো না | কিন্তু , আমি তো মা, তাই আমি সবই বুঝতে পারলাম |


প্রাথমিক গল্প গুজবের পরে আমি ঐশীকে খাবার টেবিলে বসতে নিমন্ত্রণ দিই | খাবার টেবিলে বসে ঐশী ওর সবকটা পছন্দের খাবার দেখে আপ্লুত হয়ে ওঠে |


ঐশীর আনন্দের জবাবে ঋজু বলে, " আমার মা ব্যাঙ্কের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার | সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে স্ক্রুটিনি করা আমার মায়ের কাজ| তাই, তোর ফেসবুকটাও বেশ ভালো করে স্ক্রুটিনি করেছে, বুঝতে পারছিস নিশ্চয়ই | "


ছেলের ব্যঙ্গের সামনে নিচু না হয়ে আমি হেসে বললাম, " একদিনই তো খাওয়াবো | এরপরে কোনোদিন যদি আর সুযোগ না পাই | তাই আজ, ওর পছন্দটাকেই বেশি দাম দিলাম| "


খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে ঋজু ঐশীকে নিজের ঘরে ডাকে | বলে, " আয়, আমার ঘরটা দেখ | একদিন তো তুইও ভাগ বসাবি এই ঘরে | "


ঋজুর কথায় ঐশী বেশ লজ্জা লজ্জা মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে |


আমি ঐশীকে বলি, " একটু দাঁড়াও ঐশী | ঋজুর ঘরে যাওয়ার আগে তুমি আমার ঘরে আসো | তুইও আয় ঋজু | "


ঋজু আর ঐশী আমার ঘরে এলে আমি ওদের দুজনকে মুখোমুখি বসতে দিই | দু এক কথার পরে আমিই প্রসঙ্গটা তুলে ঐশীকে প্রশ্ন করি, " তারপর ঐশী, কলেজ ক্যাম্পাসিংয়ে সবচেয়ে দামী প্যাকেজের চাকরি পেয়ে কেমন লাগছে?? "


ঐশী হেসে বলল, " দারুণ লাগছে আন্টি | হোটেল ম্যানেজমেন্ট আমি ভালোবেসে পড়তে এসেছিলাম | আমার জ্যাম্মা দারুন রান্না করেন ||জ্যাম্মার রান্না করা দেখতে দেখতেই রান্না করাটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলি | আমি ক্লাস নাইনে পড়তে প্রথম বিরিয়ানি রান্না করা শিখেছিলাম | আমার বাবা বলতেন, "যেটা খেতে তোর ভালো লাগবে রুমকি, সেটা নিজে বানাতে শেখ| কাউকে বানিয়ে দেবার জন্য বায়না করবি না| ".... আমিও অবাধ স্বাধীনতায় নতুন নতুন এক্সপেরিমেন্ট করতাম বিভিন্ন ডিস্ নিয়ে| তখন থেকেই ভেবেছিলাম, শেফ হবো আমি| ভারতের তাবড় তাবড় শেফদের নামের পাশে আমার নামও বসবে| তাই, নিজের যোগ্যতায় এমন একটা সাফল্য অর্জন করতে পেরে আমি সত্যিই খুশি, খুব খুশি !! "


"তুমি কী মনে করো, যে, তোমার যোগ্যতা দিয়ে তুমি এই চাকরি পেয়েছো?? "


"ডেফিনেটলি| "


"কিন্তু আমি তো অন্য কথা শুনলাম | ইন্টারভিউ বোর্ডের তিনজন পুরুষ থাকায় তুমি মেয়ে হওয়ার সুযোগটা এপলাই করেছো, আর তাতেই তোমার এই সাফল্য !! "


"আন্টি, এমন নোংরা কথা আপনি আমার সম্পর্কে ভাবলেন কী করে ??... এভাবে অপমান করতেই কী আপনি আমাকে বাড়িতে ডেকে এনেছেন ?? "


"এমন মানসিকতা আমার নয়, ঐশী | আর এই কথাটাও আমার নয় | এই মানসিকতা আর বক্তব্য দুটোই তোমার বন্ধু ঋজুর|...


ঋজু মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, যে, তুমি যেহেতু একটি মেয়ে, তাই তোমার সব সাফল্যের পিছনেই তোমার বুদ্ধি ও তোমার প্রতিভার থেকে তোমার শরীরের অবদানই বেশি | এবং, ঋজু শুধু এটা নিজেই বিশ্বাস করে, তাই না, ঋজু তার বন্ধু বান্ধবদের মধ্যেও সে কথা বলে বেড়ায় | তুমি কি সেটা জানো ??


আমার কথায় ঋজু বেশ ঘাবড়ে যায় | ঘাবড়িয়ে গিয়ে বলে, " না রে, ঐশী, আমি সেরকম কিছু মনেই করি না| মা তোর সাথে মজা করছে | "


"তোমার কি মনে হয়, ঐশী, আমি তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার সম্মান, তোমার প্রতিভা নিয়ে মজা করছি | আমি যদি মিথ্যেই হই, তবে সায়নকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো, এই কথাগুলি ঋজু সায়নকে বলেছে কি না | "


আমার কথায় ঐশী কেঁদে ফেলে| আমি বুঝতে পারি, মর্মে আঘাত এলে এই বেদনাটাই হয় | তারপরে সে বেদনা যদি কাছের মানুষের কাছ থেকে আসে, তবে সেটা আরও বিদ্ধ করে হৃদয়কে|


এবার ঋজু ঐশীর হাত দুটো ধরে বলে, " আমায় ক্ষমা করে দে, ঐশী | আমি সেদিন খুব ফ্রাস্ট্রেটেড ছিলাম | আমি একসেপ্ট করতে পারিনি, তুই এত সহজে এত ভালো একটা চাকরি পেয়ে যাবি!!.... তাই মেল ইগোই বল বা অন্য কিছু, আমি রাগে এমন ভুল করে ফেলেছি| "


ঐশী মাথা নিচু করেই বলে, " তোর কোনো দ্বন্দ্ব থাকলে তুই আমায় জিজ্ঞেস করতে পারতিস ?? সায়নের কাছে আমার মান সম্মানটা এভাবে না ডুবলেও তো পারতিস, ঋজু !!.... ফিরিয়ে আনতে পারবি আমার হারিয়ে যাওয়া সম্মান ?? "


"আমি সব ঠিক করে দেবো, তুই দেখে নিস্ ঐশী| "


ঐশী কোনো জবাব দেয় না, শুধু মাথা নিচু করে বসে থাকে |


এবার আমি আবার মুখ খুলি, "কি ভাবলে ঐশী??.... তুমি কি ঋজুকে ক্ষমা করে দিলে ?? "


ঐশী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে | আমি ওর পাশে গিয়ে বসি | ওর হাত দুটো ধরে বলি, "খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না ঐশী??.... তাহলে, এই কষ্টের ভার লাঘব করতে ঋজুকে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দাও | "


"কিন্তু ঋজুকে যে আমি ভীষণ ভালোবাসি!!.... ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না আন্টি | "


"নিজের আত্মসম্মানের চেয়েও বেশি ভালোবাসো বুঝি??.... যদি সেটাই ভালোবাসো, তবে বলবো, বেসো না এত ভালো | সবার আগে নিজেকে ভালোবাসতে শেখো, নিজেকে সম্মান করতে শেখো | তুমি যদি নিজেই নিজেকে সম্মান করতে না পারো, তবে, আর কেউ তোমাকে সম্মান করবে কেন?? "


"তুই কেন এরকম করলি ঋজু??.... কেন আমার মান সম্মান নিয়ে খেলা করলি?? ".... কাঁদতে কাঁদতে ঐশী প্রশ্ন ছুঁড়লো ঋজুর দিকে|


ঋজু চুপ করে থাকল |


আমি বললাম," এই আচরণে ঋজুর কোনো দোষ নেই ঐশী | এই মানসিকতার শিক্ষা ঋজুর পরিবারগত ও পরিবেশগত | আমার যখন বিয়ে হয়, তখন আমি ব্যাঙ্কের একজন সামান্য ক্লার্ক ছিলাম | তারপর, নিজের যোগ্যতায় একটু একটু করে আজ অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়েছি | কিন্তু, প্রতিটা প্রমোশনেই আমার শাশুড়ি, ননদ, আমার অন্য জায়েরা আমার দিকে নোংরা সন্দেহ ছুঁড়ে রাখতেন| মহিলা বলেই নাকি আমি আমার বসেদের সাথে নোংরামি করে নিজের প্রমোশন গুলি পেয়েছি| অনিকেত অবশ্য এবিষয়ে কোনোদিন কিছু বলেনি, তবে প্রতিবাদও কখনো করেনি | হয়তো, ঋজুর মতো অনিকেতও সেরকমই কিছু ভাবে, কিন্তু আমার সামনে প্রকাশ করেনি, যেমন, ঋজু জানতে দেয়নি তোমায় যে, ওর মনে তোমার সম্পর্কে কতটা বিষ আছে !!....


আজ আবেগের তোড়ে ঋজুর দেওয়া এই অপমান হয়তো ভুলে যাবে তুমি, কিন্তু বিবাহিত জীবনের প্রতিটা সাফল্যের মুহূর্তে তুমি যখন বারবার প্রশ্নের মুখে পড়বে, তখন, ঘেন্না আসবে নিজের সিদ্ধান্তের উপরে, নিজের বিবাহিত সম্পর্কের উপরে| তখন ভালোবাসা গলার ফাঁস হয়ে তোমায় মারতে চাইবে, কিন্তু তুমি মরতেও পারবে না, কারণ, তোমার মাতৃত্ব তোমার পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখবে | এমন ভালোবাসায় সুখ খুঁজে পাবে কি তুমি, ঐশী?? "


ঐশী বলে, " আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি আপনাকে দেখে আন্টি !! .... ছেলের মা এরকমও হয় বুঝি?? "


এবার আমি কেঁদে ফেলি| চোখের জল মুছতে মুছতে বলি, " বিশ্বাস করো ঐশী, আমি ছেলের মা হতে চাইনি| আমি একজন মানুষের মা হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু, আমার দেওয়া শিক্ষা ঋজুর পরিবারগত শিক্ষার কাছে হেরে গেল| ছোটবেলা থেকে আমার ছেলেকে আমি মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু দেখলাম, বড়ো হয়ে ঋজু কখন যেন পুরুষ হয়ে গেছে, মানুষ হওয়ার বদলে !! ঋজু যখন তোমার সাফল্যকে সন্দেহের চোখে দেখে, তখন আমার জীবনে আসা সব সাফল্যের মধ্যেও নিশ্চয়ই কলঙ্কই খুঁজে পেয়েছে??.... নিজের ভাবী স্ত্রীকে যখন সম্মান করতে জানে না, তখন নিজের মাকেও তো সম্মান করতে শেখেনি ও!!.... তোমার সাথে যেমন অভিনয় করছে, ঠিক তেমনি, আমার সাথেও বোধহয় অভিনয়ই করে এসছে এতদিন !!"


এবার ঋজু আমার কাছে ছুটে আসে| আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে, " আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও মা | আমি তোমার দেওয়া শিক্ষার অপমান করেছি | ঐশীর সাথে যা করেছি, অন্যায় করেছি | কথা দিচ্ছি, মা, ঐশীকে আর কোনোদিন অপমান করবো না | ঐশীর দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়বো না | ঐশীকে আমি খুব ভালো রাখবো মা, তুমি দেখে নিও | আমি কোনোদিন ওর অমর্যাদা হতে দেবো না|.... আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, মা, পুরুষ না, মানুষ হয়ে দেখাবো তোমায়| তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও মা| প্লিজ মা, প্লিজ!!....


ঐশী তুই বল না, একবার মাকে , আমায় ক্ষমা করে দিতে | আমি তোকেও কথা দিচ্ছি, প্রাণ দিয়ে তোর সম্মান রক্ষা করবো আজীবন | আমায় ছেড়ে চলে যাস না তুই, প্লিজ | "


এবার, ঐশী আমার সামনে ঋজুর মতো করেই হাঁটু গেড়ে বসে| আমার হাত দুটো ধরে বলে, "ঋজুকে ক্ষমা করে দাও আন্টি | ঋজু তোমার ছেলে, তাই পরিবারগত শিক্ষা কখনোই ওর কাছে প্রধান হয়ে উঠবে না| তুমি আমাকে তোমার ছেলে - বউ না করতে চাও, না করো| কিন্তু ঋজুকে এভাবে দূরে ঠেলে দিও না | "


ঋজু এবার কেঁদে ওঠে, "না মা, আমি ঐশীকে ছাড়া বাঁচবো না| সেদিন কেন যে ওরকম অমানুষ হয়ে গিয়েছিলাম, কে জানে??.... "


আমি বুঝলাম, আমার অপত্য আত্মগ্লানির আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে| আমি এবার ওদের দুজনকেই উঠিয়ে আমার পাশে বসাই, তারপরে বলি, "প্রেমটা ক্ষনিকের, কিন্তু বন্ধুত্বটা সারাজীবন থাকবে, আমরণ থাকবে তোদের মধ্যে | একে অপরের সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব নিবি দুজনেই | দুজনেই আগুন হয়ে জ্বলে উঠবি, যখন দেখবি, অন্য কেউ তোর জীবনসাথীকে অপমান করছে | আমাদের সমাজ মেয়েদের সাফল্যকে মানতে পারে না, তাই তার নামে কলঙ্ক চাপিয়ে তার প্রতিভাকে ছোটো করতে চায়| যদি কোনো সময়, ঐশী তোর চেয়ে বেশি সাফল্য পায়, তবে সেই সাফল্যকে মর্যাদা দিবি, কারণ, ওর সাফল্য তোরও সাফল্য | তোর সাফল্যে যদি ঐশী আনন্দ পায়, খুশি হয়, তবে, তুই বা হবি না কেন??.... ভালোবাসাটা যে দু তরফ থেকেই আছে|....


দিনবদল হচ্ছে ঋজু| সেই দিনবদলে পুরুষ না হয়ে মানুষ রূপে গা ভাসিয়ে দে | আর যদি সত্যিই পুরুষ হয়েই বাঁচতে চাস, তবে জানবি, আসল পৌরুষ, নারীর সম্মান রক্ষায়| "


ঋজু আমার হাতে হাত রেখে বলে, " কথা দিচ্ছি মা, আর ভুল ভাববো না কোনোদিন| আর তার সাথে এটাও কথা দিচ্ছি, ঐশীকে খুব খুব ভালো রাখবো, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত | "


এবার আমি হেসে বললাম, " যাও ঐশী, ঋজুর সাথে গিয়ে নিজের ঘর দেখে এসো | "


ওরা দুজন আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, আমি একটা পরিতৃপ্তির হাসি দিই নিজের মনে মনেই| মা হয়ে ছেলেকে এই শিক্ষাটা যে দিতেই হতো আমাকে| এখন তো আর বকা ঝকা করার দিন নেই, তাই একটু অন্য ভাবে শেখালাম | আমাদের মেয়েদের সবাই জলের মতো ব্যবহার করে - ডাল ভাতের সাথেও চলে, আবার সুরার সাথেও চলে | কিন্তু যোগ্য দাম দিতে হয় না বলে, আমাদের গুরুত্ব চিরকালই সমাজে ভীষণ কম | কিন্তু জল ছাড়া কি জীবন চলে??.... চলে না| তাই ঋজুর জীবনে একটু জলের অভাব ঘটিয়ে ওকে বোঝাতে চাইলাম, যে, জলের আরেক নাম জীবন!!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics