STORYMIRROR

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Classics

4  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Classics

জীবনযাপন ( পর্ব - সাত)

জীবনযাপন ( পর্ব - সাত)

5 mins
413

" কাল রাতে তুমি আসলে না কেন?"

আরতি নীরবে নিজের কাজ করতে থাকে।

" তুমি ভাবছো আমি খালি ভয় দেখাচ্ছি? যার গরবে গরবিনী, তোমার এই সংসার করা কিন্তু আমি ঘুচিয়ে দিতে পারি যে কোনো মূহুর্তে। "

আরতি কোনো কথার উত্তর না দিয়ে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলো দেখে বিল্টু শক্ত করে ওর হাতটা ধরে ফেলে।

আরতি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে "আহ্ কি হচ্ছে? হাতটা ছাড়ো। "

" ছাড়ার জন্য হাতটা ধরিনি, বাড়ি ফাঁকা, আমার যা চাই আমি মিটিয়ে নেবো " বলে আরতির উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যায়। আরতি প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য।

এমন সময় দরজার কাছে একটা শব্দ পেয়ে দেখে সুজিত এসে দাঁড়িয়েছে এবং বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে। এই সময় বিল্টুর হাত শিথিল হয়ে যাওয়াতে আরতি বিল্টুকে ধাক্কা দিকে সরিয়ে স্বামীর দিকে ছুটে যায়।

সুজিত দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কেবলমাত্র আরতির দিকে। আরতি ভয়ে শঙ্কায় ভাষা হারিয়েছে। তবে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা অবিশ্বাসের ছায়া ওর দৃষ্টিতে এড়ায় না।

বিল্টু এগিয়ে এসে সুজিতের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, "আরে দাদা চমকে উঠেছেন বুঝি, চমকাবেন না। আমি নতুন নই আরতির কাছে। আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম, আপনিই তো বিশ্বাস করেন নি।"

আরতি স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো অনুনয়ের চোখে। সুজিত আরতিকে কিছু বললো না, বিল্টুর হাত ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়ে বললো "আপনাকে এদিকে যেন আর কোনো দিনও না দেখি, যদি দেখি খুন করে জেলে যাবো।"

বিল্টু তার সেই গা জ্বালা হাসি হেসে চিৎকার করে বললো "নিজের পরিবারকে শাসন করতে পারে না, অন্যকে বলতে আসে।"

সুজিত স্ত্রীর কাছে এসে দেখে আরতি তখন তেমনি করেই বসে রয়েছে, সামনে এসে বসে স্ত্রীর কাঁধে বললো "ওই লোকটিকে আমি চিনিনা, কি বললো আমি বিশ্বাস করিনা। শুধু তুমি এতোটুকু বলে দাও ও যা বলছিল সেটা ঠিক না ভুল।"

আরতি খালি স্বামীর মুখের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে রইলো।

" কি হলো চুপ করে আছো কেন? আমি সত্যিটা জানতে চাই। তোমার মুখ থেকে জানতে চাই।"

আরতি নিজের মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো।

আরতিকে বুকে টেনে নিয়ে সুজিত বললো " আমি জানি সব মিথ্যা, তুমি এমন কিছু করতেই পারো না। তাছাড়া আমাকে স্পর্শ করে বসে তুমি মিথ্যা বলবেই না কখনো। "

আরতি হঠাৎ কান্না থামিয়ে চুপ করে গেল, তারপর স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল।

সুজিত আরতির এই ব্যবহারে শক খেলো, আরতির এই ব্যবহারকে বিশ্বাস করতে পারলো না। এমন করে কতক্ষণ বসে রয়েছে সে কে জানে। ছেলে মেয়েদের চিৎকারে বাইরে এসে দেখে সদর দরজার সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে আরতি। ছেলে মেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে মাকে পড়ে থাকতে দেখে ছুটে আসে। সুজিত কি করবে বুঝতে পারে না। কেমন একটা সংকোচ ওকে ঘিরে ধরে। অয়ন সুজিতের কাছে ছুটে এসে হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলে " বাবা মা কি মরে গেল।"

" এই কি বলছিস তুই? না না তা হয় নাকি?" সুজিত ছুটে গেল স্ত্রীর কাছে, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।

সুজিত আরতিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো, কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল চয়ন একজনের হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে এসেছে, সুজিত দেখলো, তিনি আর কেউ নন কবিরাজ মশাই।

" আরে কবিরাজ মশাই আপনি? "

" হ্যাঁ বাবা তোমার ছেলে নিয়ে এলো আমায়।"

" তা ভালো সময় এসে পড়েছেন আপনি, দেখুন না ওর মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এই নিয়ে দুই দিনে তিনবার জ্ঞান হারিয়েছে ও।"

" তাই নাকি? আচ্ছা দেখি সরে বস তো দাদু দিদিরা।"

কবিরাজি আরতিকে পরীক্ষা করতে বসে গেল।

সুজিত চয়নক কাছে ডেকে বললো " উনাকে পেলি কোথায় বাবা?"

" স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখেছিলাম উনাকে কর্মকার কর্তার বাড়িতে আসতে। মাকে ওমন করে পড়ে থাকতে দেখে ওর বাড়িতে ছুটে যাই। উনার ততক্ষণে কাজ শেষ। উনার বাড়ি থেকেই নিয়ে আসি আমাদের বাড়িতে। "

" তা ভালো করেছিস বাবা। খুব ভালো করেছিস।"

নয়ন চুপ করে মায়ের পাশে একটা হাত ধরে বসে রয়। অয়ন স্ত্রী দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

কিসব পাতা মূল শুকানোর পরে ধীরে ধীরে চোখ খোলে আরতি। তারপর তাড়াতাড়ি উঠতে যায় দেখে কবিরাজ মশাই বলে "আহ্ আহ্, কি করছো মা। এসময় তো একটু সাবধানে থাকতে হয় মা, তা তো তুমি জানো। তুমি তো নিজেও ছেলে মেয়ের জন্ম দিয়েছ, ভয় পেয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।"

আরতি কিছু না বলে চুপ করে শুয়ে রইলো। চোখ দিয়ে গরম জল বয়ে যেতে লাগল, সে তো মরতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন যে সেটাও করতে পারবে না।

নয়ন এসে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিলো। চয়ন, অয়ন জড়িয়ে ধরলো মাকে।

কবিরাজ মশাই সবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন "মায়ের খেয়াল রাখতে হবে যে তোমাদের। " বলে বাইরে এসে দেখে সুজিত দাঁড়িয়ে রয়েছে "কবিরাজ মশাই কেমন দেখলেন?"

" তোমার পরিবারে নতুন অতিথি আসছে। "

সুজিত কেবলমাত্র "ও " বলে উত্তর দিলো।

" কি খুশি হওনি?"

" না না তা নয়, আগেও তো মা হয়েছে, এমন তো অসুস্থ হতে দেখিনি। তাই..."

" তা ঠিক, তা ঠিক, আসলে তোমার স্ত্রী খুব দূর্বল। আমাদের প্রতিটি বাড়িতেই মায়েদের একই রকম অবস্থা। নিজেদের কথা ভাবেই না। স্বামী সন্তানকে খাইয়ে যদি কিছু বেঁচে থাকে তবে মুখে দেয়। আর ব্রত পালনের জন্য বছরে ৩০০ দিনই কোনো না কোনো বেলা না খেয়েই কাটিয়ে দেয়। তাছাড়া আমার মনে হয় তোমার স্ত্রীও বুঝতে পারেনি এই সন্তান আগমনের বিষয়টা। মনে হচ্ছে সপ্তাহ তিনেক কি মাসখানেক হবে। আচ্ছা এখন আসি, বেলা পড়ে আসলে ফিরতে অসুবিধা হবে। তবে একটু যত্নে রেখো স্ত্রীকে, কাল গিয়ে কিছু ওষুধ দেবো নিয়ে এসো সময় করে। "

সুজিত মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। তারপর কবিরাজ মশাইকে এগিয়ে দিয়ে ঘরে এসে ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো "যা পোশাক বদলে নে সবাই। আমি ভাত বেড়ে দিচ্ছি।"

সবাই যেতে না চাইলে সুজিত ধমক দিয়ে উঠলো সবাইকে, আজ পর্যন্ত কোনো দিনও সুজিত তার কোনো সন্তানকে বকা তো দূর, জোরে কথা বলে নি। আরতিও চমকে উঠলো। ছেলে মেয়েরা চুপচাপ উঠে চলে গেল।

আরতি উঠে রান্না ঘরে গেল খাবার দিতে। সুজিত কোথা থেকে এসে ওর হাত থেকে থালাটা প্রায় কেঁড়ে নিয়ে বললো "তুমি বিশ্রাম করো। আমি ওদের খেতে দিতে পারবো। " আরতি মাথা নিচু করে নিজের ঘরে চলে এসে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করলো। বিল্টু যা চেয়েছিল, তা সফল করতে পেরেছে। এমন করে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তা জানেনা। বাইরে বেড়িয়ে দেখে সন্ধ্যা লেগে গিয়েছে। বাড়িতে কেউ নেই। আরতি বুঝতে পারলো ছেলে মেয়েরা পড়তে চলে গিয়েছে।

আরতি হাত মুখ ধুয়ে পোশাক বদলে সন্ধ্যা দেওয়ার জন্য ঘরে এসে প্রদীপ জ্বালিয়ে সব ঘরে আরতি দিয়ে শঙখ বাজিয়ে তুলসী মঞ্চে প্রণাম করে পেছন ঘুরতেই দেখে আলো আঁধারীর মাঝে সুজিত দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরতি প্রথমে চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে শঙ্খটা ঠাকুর ঘরে রাখার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে সুজিত ডেকে বলে "আজকে সন্ধ্যা দিয়েছ, ঠিক আছে। এরপর থেকে ঠাকুর ঘরে তুমি ঢুকবে না। আমি পারি দেবো নইলে দেবো না।"

বলে সুজিত যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনই নীরবে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে যায়।

আরতি সেখানেই বসে পড়ে। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে।


চলবে...



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics