জীবনযাপন( পর্ব - চার)
জীবনযাপন( পর্ব - চার)
আরতি সবে এঁটো পরিস্কার করে, রান্নাঘর মুছে বাসন ধুতে বসেছে। এমন সময় পেছন থেকে একটা স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখে চয়ন আর নয়ন দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুইজনই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। নয়ন সবে ভর্তি হয়েছে আর চয়ন চতুর্থ শ্রেণিতে। এবার পাশ হাইস্কুলে যাবে দাদা অয়নের সাথে। নয়নের আগেই ছুটি হয়ে যায়, খেলার লোভে এতোক্ষণ স্কুলে থাকে সে। তারপর দাদার হাত ধরে বাড়ি আসে। প্রতিদিন আরতিকে স্কুলের পোশাক কেচে ধুয়ে দিতে হয়। ধুলো মাটি মেখে ভুত হয়ে আসে। আরতি শাসন করে বটে, তবে সুজিতের জন্য মেয়েকে বেশী বকতে পারেনা। প্রচণ্ড মেয়ে সোহাগি সুজিত , পারলে মাথায় তুলে রাখে। আর দাদা দুইজনও তাই, বোন যাই করে যাক, সামান্য মারতে বা বকতে দেবে না,নিজের পিঠ এগিয়ে দেবে ওকে বাঁচাতে। এটা ঠিক আরতিও মেয়েকে খুব ভালোবাসে, শুধু মেয়েকে না ওর প্রতিটি সন্তান ওর কাছে সমান। কিন্তু মা হয়ে শাসন না করলে কি করে চলবে? এই বয়সে তো ঠিক আর ভুল বোঝার ক্ষমতা থাকে না।
আরতি বললো "ও তোরা? "
নয়ন এতো দুষ্টু, বললো "দেখছিস দাদা,দেখছিস দাদা মা ভয় পেয়ে গিয়েছে। "
আরতি ওর দিয়ে তাকিয়ে নয়নের একটা হাত ধরে বলল " খুব দুষ্টুমি হচ্ছে তাই না, আর কি অবস্থা!! আজও ধুলো মেখে এসেছিস। একজন জ্বরে ভুগছে। এখন একে স্নান করালে এ না জ্বরে পড়ে। আবার না করিয়ে রাখি কি করে? " তারপর চয়নের দিকে তাকিয়ে বললো " কি রে তুই বোনের খেয়াল রাখতে পারিস না, প্রতিদিন ধুলো দিয়ে স্নান করে ফেরে। "
চয়ন কাচুমাচু হয়ে বললো "আমি কি করব শুনি, আমার তো ক্লাস চলে, ওর কখন ছুটি হয়ে যায়।ওতো খেলে খেলে বেড়ায়।"
মেয়েকে হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো "কি রে নয়ন স্কুল ছুটি হলে বাড়ি চলে আসতে পারিস না, এমন ধুলো মাখিস কেন শুনি?"
নয়ন দেখলো মা খেপেছে, তাই সে পরিত্রাহি চিৎকার করতে শুরু করলো, যেন আরতি কত মেরেছে। আরতি মেয়েকে ধমক দিয়ে চুপ করাতে যাবে, দেখে সুজিত ছুটে এসে বললো "কি হয়েছে, কি হয়ে,আমার মামনিকে মারছো, বকছো কেন?"
আরতি বুঝতে পারলো,বাবাকে আসতে দেখে নয়ন কান্না জুড়েছে। সে রাগ করে বললো " আমি তোমার মেয়েকে মারা তো দূর বকিনি পর্যন্ত। এমন করে ছুটে আসতে হবে না। "
তারপর মেয়ের হাত বাবার হাতে তুলে দিয়ে বললো "সামলাও তোমার মেয়েকে, আমি পারবো না। দেখেছ কেমন ভুত হয়ে এসেছে। একটা দিন তোমার পোশাক না কাঁচলে পরের দিন পরানো যায়না। স্কুলটাও তেমন, স্কুলের পোশাক না পড়িয়ে পাঠালে স্কুলে ঢুকতে পর্যন্ত দেয়না। আর না হয় সে কথা ছাড়লাম প্রতিটি দিন স্কুল থেকে আসার পরে ওকে স্নান করালে ও বাঁচবে? একজন তো অসুস্থ হয়ে রয়েছে, এখন এ..." বলে কথাটা শেষ না করে বাকি বাসনগুলো মাজতে বসে গেল। চয়ন মাকে ক্ষেপতে দেখে স্নানঘরের চৌবাচ্চার জল থেকে চুপচাপ হাত পা ধুয়ে ঘরে চলে গিয়েছে।
সুজিত কি বলবে বুঝতে পারলো না,সত্যি মেয়ে ধুলোয় ভুত হয়ে ফিরেছে। ও মেয়েকে কোলে নিয়ে স্নানঘরে ঢুকে গিয়ে পোশাক বদলিয়ে স্নান করিয়ে দিলো, ভেবেছিল গামছা ভিজিয়ে গা মুছিয়ে দেবে, কিন্তু যা ধুলো বালি তা সম্ভব হলোনা। চৌবাচ্চার জলে না কুলানোতে, জল আনতে হলো কল থেকে। স্নান করাতে করাতে মেয়ে বোঝাচ্ছিল "মামনি এমন করিস কেন মা? দেখছিস তো কত ধুলো বালি। এমন করবে না হ্যাঁ। "
নয়ন বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে বাবার কথার সম্মতি জানালো। অবশ্য সেটা কয় সেকেন্ডের জন্য কে জানে?
আরতি রান্না ঘরে ছেলে মেয়ে দুটোর খাবার তৈরী করছিলো, চয়ন এসে পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলো না। আরতি পেছন ঘুরতে ছেলেকে দেখতে পেয়ে বললো "কি? কিছু বলবি?"
চয়ন মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বললো " মা অনন্ত মাষ্টার মশাই বলছিল দাদা পড়তে যাবে কিনা। কাল যায়নি কিনা। পরীক্ষা সামনে। আর নিহার দাদাও জিজ্ঞেস করছিল কাল থেকে দাদা মাঠে যাচ্ছে না কেন? "
আরতি বুঝতে পারলো না কি করবে, পাঠাবে পড়তে? অয়ন ক্লাস এইটে পড়ে। লেখাপড়ায় মোটামুটি, তবে খেলায় বেশ ভালো। দৌড়ে অনেক পুরস্কারও এনেছে।
" আচ্ছা দেখছি, তুই খাবারটা খেয়ে পড়তে যা।" চয়ন আবার লেখাপড়ায় বেশ ভালো, তবে খেলাধুলায় মন নেই। তবে একা বসে বসে আঁকে। তিন ভাইবোনের মধ্যে চয়নই একটু শান্ত।
চয়ন আর কথা না বাড়িয়ে ওখানেই খেতে বসে গেল। আরতি বাইরে এসে দেখে বাপ বেটিকে কোলে নিয়ে যেখানে বসে রয়েছে, সেখানে তখনও রোদের ঝলক রয়েছে। সে বুঝতে পারলো রোদ তাপানো হচ্ছে মেয়েকে। সবে চারটা বাজে, রোদ বেশ রয়েছে। আরতির ওদের কান্ড দেখে বেশ হাসি পেলো, সে কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। ঘরে গিয়ে দেখে অয়ন উঠে বসে রয়েছে, আরতি কাছে গিয়ে কপালে তাপ নিয়ে দেখতেই, অয়ন বলে উঠলো, "মা তোমার হাত কি ঠান্ডা গো।"
আরতি বুঝতে পারলো এজন্য বেশি গরম মনে হয়েছিল। সে তখন থার্মোমিটার ছেলেকে দিয়ে জ্বর মেপে দেখলো বেশি না, ১০০ এর নীচে জ্বর। তবে জ্বর এখনো রয়েছে। সে ছেলেকে ওষুধ দিয়ে বললো " শুয়ে থাক, এখনো জ্বর যায়নি কিন্তু। "
অয়ন বললো "আজও মাঠে যাবো না মা?"
আরতি ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো, থমকে দাঁড়িয়ে ছেলের দিকে ঘুরে বললো "কোথায় যাবি তুই? কোথায় যেতে চাস তুই? মাঠে?"
অয়ন আমতাআমতা করে বললো "না দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখবো, খেলবো না।"
" কোত্থাও যেতে হবে না শুয়ে থাক, আর খুব যেতে ইচ্ছে করলে সাড়ে পাঁচটায় অনন্ত মাষ্টার মশাইয়ের কাছে পড়তে চলে যাস।"
বলে বেড়িয়ে গেল আরতি। অয়ন ব্যাজার মুখে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ওর খেলতে দৌঁড়াতে যতটা ভালো লাগে, পড়তে লাগে নাকি ছাই।
বাইরে বেড়িয়ে দেখে একইভাবে বাপ-বেটিতে বসে রয়েছে।
" অমন করে বাবার কোলে বসে রইলেই হবে? খেতে হবেনা বুঝি?"
নয়ন বাবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে তখনও বসে রইলো।
" কি হলো কথা কানে গেল না? এদিকে আয়।" সুজিত ইশারায় মেয়েকে মায়ের কাছে যেতে বললো।
" তোমার কি গোরুগুলোকে মাঠ থেকে আনতে হবে না নাকি? যাও নিয়ে এসো বেলা পড়ে গেল বলে।"
সুজিত বেড়িয়ে গেল, এদিকে ও বিল্টুর উপর দোকান ছেড়ে এসেছে এটা শুনলে আরতি যে আরও ক্ষেপে উঠবে,তাই এই কথাটা আর বললো না আরতিকে। লোকের উপর সহজে বিশ্বাস করে নেওয়া বিষয়টা আরতি একদমই পছন্দ করে না, এজন্য কম লোকসান হয়নি সুজিতের। তবুও বিশ্বাস না করে সে থাকতে পারে না। ছেলে মেয়েকে স্কুল থেকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে ও এসেছিল। সুজিতের দোকানটা বাড়ি থেকে একটু দূরে, বাড়ি থেকে দোকান দেখা যায় কিন্তু আসার সময় ঘুরে আসতে হয়। কারণ মাঝে একটা পুকুর।
আরতি মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে রুটি আর দুধ চটকে মেখে খাইয়ে দিলো। অন্য সময় হলে খাবার নিয়ে বায়না করতো, আজ মা রেগে আছে জেনে চুপচাপ খেয়ে নিলো নয়ন।
চয়ন ততক্ষণে বই নিয়ে বসে গিয়েছে, বসে বসে বাড়িতে যে অনকগুলো করতে দিয়েছিল, সেগুলো কষছে। আরতিও প্রতিদিন পড়া দেখিয়ে দেয়। সুজিতের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ নেই, অনেক চেষ্টায় মাধ্যমিকের গণ্ডী টপকে লেখাপড়া স্থগিত করেছে সে। আজকে নয়ন দাদার পাশে চুপচাপ শ্লেট নিয়ে বসে এক দুই বানান করে লিখতে বসে গিয়েছে। আরতি উঠোন ঝাড় দিতে দিতে মেয়ের কাণ্ড লক্ষ্য করে মনে মনে হেসে ফেললো। অন্য সময় হলে লেখা তো দূর, সারাবাড়ি দস্যিপনা করে বেড়াতো। মনে মনে বললো "মাঝে মাঝে রাগ দেখানোও ভালো। "
আরতি তখন সন্ধ্যা দিচ্ছে, তিনটি বাচ্চাই পড়তে গিয়েছে, ভাইবোন পড়তে যাচ্ছে দেখে অনয়ও একা থাকতে রাজি হয়নি। যাওয়ার সময় আরতি দেখছিল জ্বর নেই অয়নের তখন। তাই বাধা দেয়নি সে।
আরতি মনে মনে নিশ্চিন্তই ছিল, দুপুর থেকে দেখেনি বিল্টুকে। ভেবেছিল সে চলে গিয়েছে। দুপুরে অমন পরিস্থিতি দেখে বিল্টু আর থাকার সাহস পায়নি। এজন্য ঠাকুরকে মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছিলো সে।তুলসী তলায় প্রদীপ দিয়ে শঙ্খ ধ্বনি দিয়ে ঘাড়ে আঁচল দিয়ে প্রণাম সেরে মুখ তুলেই সামনে বিল্টুকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে আরতি৷ অস্ফুটে চিৎকার করে উঠে। বিল্টু ওর দিকে এগিয়ে এসে আরতির গায়ের সুবাস নিয়ে, মুখ বিকৃত করে বললো "এখন তোমাকে কিছু বলছি না, রাতে সবাইকে লুকিয়ে আমার কাছে চলে এসো,কোথায় জেনে যাবে, নইলে.." বলে একটা গা ঘিনঘিন করা হাসি হেসে বলল " বাকিটা তুমি জানো.." বলে শিষ দিতে দিতে বেড়িয়ে গেল বিল্টু।
আরতির মাথাটা আবার ঘুরে যাচ্ছিল, সে নিজেকে কোনো মতে সামলে নিয়ে সামনের বারান্দা ধপ করে বসে পড়লো...
চলবে...
গল্পটা কেমন লাগছে আমাকে অবশ্যই জানাবেন...
