ঝুলন পুতুল
ঝুলন পুতুল
ঝুলন মানেই উঠোনে, সিড়ির নীচে, বারান্দার এক কোণে কাদা মাটির পাহাড় সাজিয়ে সৈন্য জড়ো করে কিংবা গুহা রাঙিয়ে সেখানে সিংহ-বাঘকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ছেলেবেলায় ঝুলনে মেতেছেন অনেকেই। সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ছুটেছে কল্পনার উড়ান।

ঝুলন যাত্রা বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম বড় উত্সব রাধা কৃষ্ণের প্রেমের উদযাপন হয় এই উত্সবের মধ্যে দিয়ে। ছোট ছোট পুতুল দিয়ে এদিন বাচ্চারা ঝুলন সাজায়। বিভিন্ন আচার ও সাবেক প্রথা জড়িয়ে আছে বাঙালি সমাজের এই উত্সবটির সঙ্গে।বাঙালির যেমন ঝুলন, তেমনি অবাঙালি মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মাষ্টমী তে এই পুতুল সাজিয়ে নবজাতক কৃষ্ণের জন্মোৎসব পালন দেখা যায়। তবে এখন পুতুলের পসরা কমে গেছে। দুবছর আগেও প্রচুর বেনারসের কাঠের পুতুল, রাজস্থানী লোক শিল্পের পুতুল আসতো। সেই সাথে কৃষ্ণনগর থেকে কৃষ্ণলীলা র বিভিন্ন মডেল।

অনেক হয়তো এখন ছেলে বেলার কথা মনে পরবে। একটা ধর্মীয় উৎসব কিন্তু পুতুল শিল্প চাঙ্গা করে তুলতে পারে। ঝুলন শুধু উৎসব নয় নিছক। ধর্ম আসলে সমাজ বিজ্ঞান। ঝুলন সাজানো সাথে সাথেই আমরা বুঝতে পারতাম বাস্তুতন্ত্র। অর্থাৎ যে সব পশুপাখি আজকাল বিপন্ন হচ্ছে। তাই হতো না আজকে যদি ঝুলনের মতো উৎসব দিয়ে বাস্তুতন্ত্র খেলার ছলেই বুঝতে পেরে যেতো ছোটরা।

এই পুতুলগুলি দুইভাবে তৈরি করা হয়। কখনও ছাঁচে আলাদাভাবে দুই খোলে বানিয়ে জোড়া দিয়ে, আবার কখনো হাতের আঙুলে টিপে টিপে। পুতুল বানাতে ব্যবহার করা হয় মজে যাওয়া এঁটেল মাটি ও বেলে মাটি। কাঁচা মাটির পুতুল রোদে শুকিয়ে তারপরে দেওয়া হয় রঙের প্রলেপ। রং করতে এলামাটি বা খড়িমাটির সঙ্গে মেশানো হয় গুঁড়ো রং এবং গদের আঁঠা। এইভাবেই মাটির পুতুলগুলি আস্তে আস্তে রঙিন হয়ে ওঠে। মাছ-ধরা পুতুল, সৈন্য পুতুল, হরেক রকমের পুতুল।

ঝুলনে সৈন্য, ঘোড়া, গরু, সব্জি, মাছ বিক্রেতা— এ ধরনের পুতুলের চল বেশি। কিন্তু আগের মতো পুতুল বিক্রি হয় না।চাহিদা না থাকায় বাড়েনি পুতুলের দামও। তবে ঘর সাজানোর জন্যে পুতুল বিক্রি হলেও ঝুলনের জন্য আলাদা করে পুতুলের চাহিদা নেই। আসলে বোধহয় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ইঁদুর দৌড়ে ব্যাস্ত। তবে যৌথ পরিবার গুলো ভেঙে গেছে। এখন সব ফ্ল্যাট বাড়ি, ঝুলন বা কোথায় করবো আমরা । ঝুলন পুতুল তাই হয়তো হারিয়ে যাবে একদিন।