ঝরে পড়া শিউলি
ঝরে পড়া শিউলি
নিজের পাঁচতলা ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকের একটা পুরানো আমলের বাড়ির বিশাল বাগানের শিউলি গাছের নীচে একরাশ ঝরে পড়া শিউলি ফুলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো মৌমিতা, কতো ভালো ছিলো ছোট্টবেলার সেই দিনগুলো।যখন পুজোর আগে শিউলি ফুল নেবার জন্য ও আর ওর বোন সেই কোন ভোরবেলা থেকে উঠে বসে থাকতো।আর তারপর যখন শিউলি গাছের নীচে ঝরে পড়া একরাশ শিউলি ফুল নিজেদের ফ্রকের মধ্যে নিয়ে বাড়িতে ফিরতো। তখন ওদের মুখে যেন বিজয়িনীর হাসি লেগে থাকতো।আর তারপর সেই ফুল ঠাকুমা কে দিতো ওরা নিয়ে গিয়ে ঠাকুর ঘরে।কি সুন্দর করে সাজাতো ঠাকুমা সেই ফুল প্রত্যেক ঠাকুরের সামনে। অথচ এখন? শিউলি ফুল পড়ে থাকলেও কেউ ওঠায় না। মৌমিতার এক এক সময় মনে হয় দৌড়ে গিয়ে সব ঝরে যাওয়া শিউলি ফুল উঠিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নেয়, কে কি ভাববে।
"ব্রেকফাস্ট দাও মৌ ,আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে অফিসে, কাজ আছে।"স্বামীর ডাকে সম্বিত ফিরলো মৌমিতার। তাড়াতাড়ি কিচেনের দিকে পা বাড়ালো।
শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে এই ফ্ল্যাটটা ওরা নিয়েছিলো বছর দুই আগে। আসলে মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা মৌমিতার ছোট থেকেই একটু শান্ত পরিবেশ পছন্দ। আর তাই এখানে ফ্ল্যাট নেওয়া।নীল অফিস বেরোবার আগে মৌমিতাকে ভালো করে দরজা লক করে রাখতে বললো রোজকার মত। যদিও সিকিউরিটি গার্ড আছে, তাও নিজের সাবধানতা নিজের কাছে। নীল বেরিয়ে যেতে মৌমিতা আবার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। কলিং বেলের শব্দে দরজার কাছে গিয়ে কি হোল দিয়ে দেখলো কাজের মেয়েটি এসেছে। ষোলো সতেরো বছর বয়স হবে ওর। আগে ওর মা কাজ করতো। তারপর দুজনের সংসার, কোনো ঝামেলা নেই দেখে, মেয়েটা কে এনেছিলো। মেয়েটির নাম ও শিউলি।কি সুন্দর মায়াবী মুখখানা মেয়েটার। মৌমিতার কাছে এনে ওর মা বলেছিলো, "সব বাড়িতে পাঠাই না বৌদি।মেয়ে বড়ো হয়েছে তো, কার মনে কি আছে। গরীব মানুষের হাজার জ্বালা।"
শিউলি প্রথম যখন এসেছিল এখানে , চুপচাপ,শান্ত থাকতো। তারপর ধীরে ধীরে মৌমিতার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এখন তো যতক্ষণ থাকে বকবক করতেই থাকে। মৌমিতা ও শোনে ওর বকবকানি। একদিন শিউলি মৌমিতাকে জিজ্ঞেস করে, "তুমি অনেক পড়াশোনা করেছো, তাই না গো?"উত্তরে মৌমিতা ওকে বলে, হ্যাঁ তা করেছি।তুই ও কর ।আজকাল তো কতো সুবিধা হয়েছে তোদের ও। স্কুলে যাস না কেন?" শিউলি এবার ম্লান মুখে বললো,"সময় হয় না গো বৌদি। চার চারটে ভাইবোন আমার। বাবা অসুস্থ, মা কাজ করতে বেরিয়ে যায়। মাকে এক দু বাড়ি সাহায্য করে ,যখন সময় পাই, ভাইবোন দের দেখাশোনা, রান্নাবান্না এসব করেই পার হয়ে যায়। নাহলে ইচ্ছা তো করে পড়তে। শিউলি আজ তিনদিন হয়ে গেল কাজ করতে আসছে না।মেয়েটা বাড়িতে এলে সময় কেটে যায় মৌমিতার ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে। মেয়েটা না আসাতে ঘরটা যেন কেমন খালি লাগছে। মেয়েটা সারাক্ষণ বকবক করতো যে। সেদিন মৌমিতা ওর মাকে জিজ্ঞেস করলো, শিউলি কেন আসছে না। শিউলির মা বললো,ওর বিয়ে হয়ে গেছে।তাই ও আর কাজে আসবে না। "বিয়ে দিয়ে দিয়েছো মানে?ওর কতো বয়স? জানো না আঠারো বছরের আগে বিয়ে দেওয়া যায় না।আর এই তো তিন চারদিন আগেই মেয়েটা এলো,এত তাড়াতাড়ি বিয়ে কি করে ঠিক হলো?"অবাক গলায় মৌমিতা শিউলির মাকে জিজ্ঞেস করলো। "আমাদের ঘরে ওসব দেখে না কেউ।মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে মানেই তার বিয়ে দিতে হবে। আর আমাদের বিয়ে কি আর তোমাদের মতো অত দেখেশুনে হয় বৌদি। ভালো ঘর ,বর পেলে তিনদিনেই বিয়ে হয়ে যায়।"মৌমিতা আবার জিজ্ঞেস করলো শিউলির মাকে, "কি করে ছেলে ?" শিউলির মা বললো,"অনেক জমিজমা আছে গো বৌদি। একটা শুধু বাচ্চা,আর কেউ নেই ঘরে।"
"একটা শুধু বাচ্চা ,কার বাচ্চা?"মৌমিতা উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো।
"ছেলের আগের পক্ষের বাচ্চা গো বৌদি।বউটা মরে গেছে, তাই তো আমার শিউলি কে বিয়ে করলো সে। নাহলে এতো ভালো ছেলে আমার শিউলির কপালে লেখা ছিলো নাকি।"মৌমিতা এবার জিজ্ঞেস করলো, বয়স কতো ছেলেটার?
"ছেলেদের আবার বয়স? সোনার আংটি আবার বাঁকা। তোমার ও এক কথা বৌদি। তাও তুমি জিজ্ঞেস করলে যখন বলছি।এই বছর পঁয়ত্রিশ হবে হয়তো। ভালো ঘর, জমিজমা,আর একটা শুধু আগের পক্ষের বাচ্চা। কোনো ঝামেলা নেই বৌদি। শিউলি আমার রাজরানী হয়ে থাকবে ওখানে।" মৌমিতা হতবাক। একটা ষোলো বছরের বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে একটা পঁয়ত্রিশ বছরের লোকের বিয়ে দিয়ে, শিউলির মা বলছে রানী হয়ে থাকবে ওর মেয়ে। পরের আর কিছুই ভাবছে না।
যখন থেকে শুনেছে কথাটা মনটা মৌমিতার, খারাপ হয়েই আছে।কে জানে মেয়েটা কেমন আছে। সেদিন খুব সকালে কাজ করতে এলো শিউলির মা। মৌমিতা জিজ্ঞেস করতে বললো, আজ শিউলি আসবে অষ্টমঙ্গলা করতে। খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে শিউলির মা বললো,"বরের সঙ্গেই আসবে গো বৌদি। তারপর জামাই চলে যাবে, আর শিউলি দুদিন থাকবে আমার কাছে।এখন তো আর আসতে পারবে না তাই।" মৌমিতা বললো, "শিউলিকে নিয়ে এসো একদিন। অনেক দিন দেখিনি মেয়েটাকে।" ওর মা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললো। পরের দিন শিউলির মা এলো না কাজ করতে। মৌমিতা ভাবলো,মেয়েটা এতদিন পর এসেছে, তাই হয়তো এলো না। পরের দিন একটু বেলা করেই এলো শিউলির মা। মুখটা একটু থমথমে। জিজ্ঞেস করতে বললো, শিউলির নাকি শরীর ভালো না, গায়ে জ্বর ও এসেছে। মৌমিতা বললো, ভাইরাল ফিভার, সবার হচ্ছে । শিউলির মা আবার বললো, "না গো বৌদি,সে জ্বর নয়। জামাই কাল দিয়ে গেছে, আর বলে গেছে, ভালো করে চিকিৎসা করিয়ে যেন পাঠাই মেয়েকে। মেয়ের আমার শরীরে ক্ষমতা নেই নাকি ।"মৌমিতা একটু হলেও বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা। জানতে চাইলো ডাক্তার দেখিয়েছো? "না গো বৌদি এসব কথা কোন ডাক্তার কে বলবো বলো তো।" মৌমিতা আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বলে,"শিউলির কাছে নিয়ে চলো আমাকে।"
ওখানে গিয়ে মৌমিতা দেখে, শিউলি বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। সোজা হয়ে শুতে পর্যন্ত পারছে না মেয়েটা। অত সুন্দর মায়াবী, নিষ্পাপ মুখখানা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে গেছে। মৌমিতার খুব কষ্ট হচ্ছিল ওকে দেখে। আর গায়ে তো বেশ জ্বর আছে। মৌমিতা ওকে নিয়ে নিজের পরিচিত এক গাইনোকলজিস্ট এর কাছে গেলো। সমস্ত পরীক্ষার পর দেখা গেল ওর , অভ্যন্তরীণ অঙ্গ বেশ ভালোই আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। ইন্টার্নাল ব্লিডিং ও হচ্ছে সেকারণে।আর গায়ে জ্বর টাও সেই কারণেই এসেছে। ডঃ অনেক রকমের অ্যান্টিবায়োটিক এবং আরো বেশ কিছু ওষুধ দিলেন।সব ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিয়ে, শিউলিকে আর ওর মাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে এলো মৌমিতা। পরের দিন বিকালে শিউলিকে দেখে অনেকটাই সুস্থ মনে হলো। আরও কিছু দিন যাক, মেয়েটা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।
ঘরে ফিরে এসে মৌমিতা ভাবলো, যে ভাবে হোক শিউলির মা কে এটা বোঝাতেই হবে যে , শিউলিকে যেন ওই নর পিশাচ টার কাছে আর না পাঠায়।কি অবস্থা করেছে মেয়েটার। একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে এরকম করবার আগে একবার ভাবলো না লোকটা। শিউলির মা না হয় নিজের অসহায় অবস্থা থেকে এই কাজ করেছে। কিন্তু ওই লোকটা?সে তো জেনেশুনেই সব করেছে। এই অন্যায় মৌমিতা শিউলির সঙ্গে আর হতে দিতে পারে না। যেভাবে হোক শিউলি কেও বোঝাতে হবে ব্যাপারটা।এরপর মৌমিতা শিউলি একটু সুস্থ হতে ওকে বুঝিয়ে লোকাল থানায় গিয়ে শুধু একটা ডায়েরি করে এসেছিল,যে শিউলি এখনও নাবালিকা। আর তাই ওর এই বিয়েটাও আইনসিদ্ধ না। আর তারপরও যদি ওই পিশাচটা শিউলিকে জোর করে নিয়ে যেতে চায়, তখন তো নাবালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে ওকে শাস্তি পেতেই হবে। শিউলির মা কেও বলে দেওয়া হলো থানা থেকে, জোর করে নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে দিলে তার শাস্তি কি হতে পারে। এতেই কাজ হয়েছিল।
পরের দিন ভোরবেলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, উল্টো দিকের শিউলি গাছের দিকে তাকিয়ে, মৌমিতার মনে হলো নাই বা সে এখন আর ঝরে যাওয়া শিউলি ফুল তুলে আনতে পারলো। কিন্তু সমাজের ঝরে যাওয়া একটা শিউলিকে অন্ততঃ সে সযত্নে উঠিয়ে এনে পুজোর থালায় সাজিয়ে রাখতে পেরেছে তো। এটাই তার পরম প্রাপ্তি।