Sanghamitra Roychowdhury

Classics

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Classics

জাপানি বৌয়ের কথা

জাপানি বৌয়ের কথা

9 mins
1.1K


আলবেলা নামের মেয়েটির বাড়িতে তার দাদা কল্যাণ, বাবা-মা আর বৃদ্ধা ঠাকুমা। ভারী ছিমছাম সাজানো গোছানো শিক্ষিত ভদ্র পরিবার। কল্যাণের গানের গলা খুব সুন্দর। আসলে বাড়িতে ওদের এক গানবাজনার পরিবেশ আছে, সেই ঠাকুর্দার আমল থেকেই। আলবেলা আর কল্যাণের ঠাকুর্দা শহরের নাম করা সঙ্গীত শিল্পী.... সঙ্গীতের শিক্ষক.... সঙ্গীতাচার্য্য পণ্ডিত চন্দ্রশেখর মৈত্র। সঙ্গীত তাঁর নেশা, সঙ্গীতই তাঁর পেশা। নিজের জীবনে তিনি লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সহাবস্থান করিয়েছিলেন।


নিজের ছেলের গলায় সুর তাল নেই, ছেলে তার মামারবাড়ির বিরাট বড় ব্যবসার উত্তরাধিকারী। সঙ্গীতাচার্য্যের সব আশা তাই নাতি কল্যাণ আর নাতনি আলবেলাকে ঘিরে। নামকরণও তিনি নিজেই করেছিলেন। আর নাতি নাতনিকে বড়ো যত্নে তিনি নিজেই গানও শিখিয়েছেন। ঠাকুর্দার অন্যতম শখ ছিলো ভারতীয় মার্গ ও লোকসঙ্গীতের সাথে এশিয়ার এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের লোকসঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটানো। জীবদ্দশায় তিনি এই কাজ করে যেতে পারেন নি। দৈনন্দিন কাজের এবং সাংসারিক চাপ ও শারীরিক সমস্যা এই সাধু প্রচেষ্টার রূপায়নে বাদ সেধেছিলো। অবশেষে তাঁর মৃত্যুর পর নাতি কল্যাণ ঠাকুর্দার এই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার সংকল্পবদ্ধ। বেশ কিছুদিন ধরেই সে এশিয়ার দেশগুলি.... জাভা, সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, থাইল্যান্ড ইত্যাদি ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করছে অশ্রুতপূর্ব সঙ্গীতের সম্ভার। এই সঙ্গীত সংগ্রহ পরিক্রমায় এরপর কল্যাণ জাপানে এসে পৌঁছেছে।


কল্যাণ আপ্লুত জাপানি সঙ্গীত জগতের আপ্যায়ন ও সহযোগিতায়। কল্যাণকে সর্বক্ষণের জন্য সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য জাপানের লোকসঙ্গীত একাডেমি থেকে নিয়োজিত করা হয়েছে ফুকিয়ে গেইশাকে। অসাধারণ গান গায় ফুকিয়ে। তার আঙুলের ছোঁয়ায় সুরতরঙ্গ তোলে শামিসেন নামের বাদ্যযন্ত্রটিতে। কল্যাণের সাথে ফুকিয়ের গানে সুরে তালে ভারী মিল হয়েছে। ভাষার দূরত্বকে একপাশে সরিয়ে রেখে। ভাঙা ইংরেজিতে আদান-প্রদান হয়, ভাব যেখানে প্রধান, ভাষা কী সেখানে বাধা হয়?


দেখতে দেখতে কল্যাণের ছ'মাস পেরিয়েছে জাপানে, দেশে ফেরার তাগিদ তার তেমন নেই।

জাপানের গান সংগ্রহ সেরে অন্য কোনো দেশে অন্যান্য গান খুঁজতে যাবার আগ্রহও কল্যাণ হারিয়েছে। এখন কল্যাণের সব গান তান সুর তাল আবর্তিত হয় ফুকিয়েতে.... জাপানি লোকসঙ্গীত ও শামিসেন শিল্পী ফুকিয়ে গেইশাকে ঘিরে। কল্যাণ আর ফুকিয়ে আজকাল পরস্পর পরস্পরকে নিজেদের মাতৃভাষা শেখায়। অর্থাৎ কল্যাণ ফুকিয়েকে বাংলায় কথা বলতে শেখায়, আর ফুকিয়ে কল্যাণকে শেখায় জাপানি কথ্যভাষা।


মাঝে একদিন কল্যাণ ফোনে আলবেলাকে খুলে বলে ফুকিয়ের কথা। পরিচয়ও করিয়ে দেয়। আলবেলা ভাবে কী সুন্দর গলার স্বর, যেন চঞ্চল ঝর্ণাধারা।


জাপানি মেয়েরা এমনিতেই দেখতে খুব সুন্দর হয়। চেহারায় ঠিক যেন পুতুল পুতুল একটা ভাব। ওদেশে প্রচলিত কথা, জাপানি মেয়েরা পৃথিবীর সেরা এবং তারা গৃহবধূ হিসেবেও অতুলনীয়া। কল্যাণ আর ফুকিয়ের প্রেম তখন বেশ জমাট, পেরিয়েছে কল্যাণের পুরো একটি বছর জাপানে। যে কাজ নিয়ে কল্যাণের জাপানে যাওয়া, ফুকিয়ের সহায়তায় তা সুচারুভাবেই সমাধা হয়েছে। এবার দেশে ফেরার পালা। কল্যাণের সঙ্গে আসছে ফুকিয়েও। আলবেলাকে সব খুলে জানিয়েছে কল্যাণ। রক্ষণশীল মা-বাবা এবং ঠাকুমাকে কল্যাণের সাথে ফুকিয়ের সম্, ও তাদের পরিকল্পনা জানানোর, ও বোঝানোর গুরুদায়িত্ব পড়েছে আলবেলার কাঁধে। কল্যাণের অগাধ ভরসা বোন আলবেলার বুদ্ধি বিবেচনা এবং যে কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করে কাউকে বোঝানোর ক্ষমতার আত্মবিশ্বাসের উপর। দেশ থেকে আলবেলার ফোন পাবার পরে কল্যাণ ফুকিয়েকে নিয়ে তার ভারতে ফেরার তোড়জোড় শুরু করলো।


আজ আলবেলার ব্যস্ততা তুঙ্গে, কল্যাণ আর ফুকিয়ে এসে পৌঁছচ্ছে। ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ন'টার সময় ওদের প্লেন কোলকাতায় ল্যাণ্ড করবে।


বাড়ির বড়ো গাড়িটা নিয়ে ন'টার আগেই আলবেলা এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌঁছে গেছে। ভারী খুশী আজ আলবেলা। বারবার ঘড়ি দেখছে আলবেলা, খুব ঘন ঘন। সময়ের কাঁটা হুহু করে ছুটছে। সব নির্দিষ্ট বিধিনিয়মের বেড়া টপকে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জের কাঁচের দরজা ঠেলে বেরোলো কল্যাণ, পিছনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ফুকিয়ে। আলবেলা কথা হারিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মনে করছে কল্যাণের পাঠানো ফুকিয়ের ছবিটা। ফুকিয়েকে দেখে আলবেলার মনে হোলো, ঐ ছবিটা তোলার সময় নির্ঘাত কল্যাণের ক্যামেরা খারাপ ছিলো, অথবা কল্যাণ ফোকাসিং ঠিক করে করতে পারে নি, বা হাত কেঁপে গিয়েছিলো।


আলবেলা তখন ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, এবার থেকে ও নিজেও সাজেপোশাকে ওর জাপানি বৌদি ফুকিয়েকেই অনুসরণ অনুকরণ করবে। আলবেলা বুঝলো কল্যাণের ফুকিয়ের প্রেমে পড়ার যুক্তিসঙ্গত কারণটা। ফুকিয়ে এগিয়ে আসছে হাসিমুখে। আলবেলা দেখছে ফুকিয়ের টকটকে রাঙা চেরীর মতো দুই ঠোঁটের মাঝে সাদা মুক্তোর মতো দাঁতের সারি, মুক্তোর ওপর পড়ে পিছলে যাওয়া ঠিকরোনো আলোর মতো গায়ের রঙ, টেপা নাক, চেরা চোখ, কানের পাতলা লতিতে হীরের দুলের দ্যুতি, সরু সরু এমন আঙুলকেই বুঝি চাঁপার কলির মতো আঙুল বলে। মাথার কুচকুচে কালো চুল কপাল থেকে টেনে তুলে মাঝখানে ফাঁপিয়ে চূড়ো করে খোঁপা বাঁধা, তাতে গোঁজা কাজ করা কাঠের বাহারি কাঁটা-ক্লিপ। ছোট্টোখাট্টো স্লিম শরীরে পরনে ফুলেল ছাপের ওদেশের পোশাক কিমোনো।


আলবেলার একেবারে সামনে এসে ফুকিয়ে যখন ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আধো বাংলায় বললো, "আলবেলা, আমার ছোট্ট বোন, ভালো আছো তো?" তখন আলবেলার মনে হোলো, "ফুকিয়েকে ভালো না বেসে থাকা অসম্ভব! দাদা তো কোন ছাড়, প্রথম সাক্ষাতেই আমি নিজেই তো ফুকিয়ের প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছি!" তারপর হৈহৈ করে গল্প করতে করতেই আলবেলা দাদা বৌদিকে নিয়ে বাড়িতে এসে পৌঁছলো। ফুকিয়ের মুখে বাংলা শুনে, ওর নম্র ব্যবহারে, ওর আন্তরিকতায়, ওর গানে, ওর বাজানো শামিসেনের সুরে তখন সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত চন্দ্রশেখর মৈত্রের বাড়িতে সত্যিকারের বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার।


আলবেলার বাবা-মা, ঠাকুমা সব্বাই খুব সহজেই ফুকিয়েকে আপন করে নিলো আর খুব তাড়াতাড়ি। আর ফুকিয়েও নিজগুণেই পরিবারের সকলের মন জয় করে নিলো।


এর কয়েক মাস পরে আলবেলার বিয়ে হোলো এক দক্ষিণী গানপাগল ছেলের সাথে। আলবেলা হেসে কেঁদে নিজের সংসারে চললো কার্ণাটিক সঙ্গীত শিল্পী জীবনসঙ্গীর সাথে, আর তার নিজের গান সঙ্গী হয়ে তো আছেই সাথে। যাবার বেলায় পরিবার পরিজন বাবা-মা দাদাকে ছেড়ে যাবার কষ্ট ছাপিয়ে আলবেলা বুকে করে নিয়ে গেলো বৌদি ফুকিয়েকে ছেড়ে দূরে যাবার বেদনা।

এরপরে কালের নিয়মেই কয়েকবছর অতিক্রান্ত।

আলবেলার কোল আলো করে এসেছে আহির আর বাহার। মেয়েদের নিয়ে, স্বামী সংসার নিয়ে, গান নিয়ে হিমসিম আলবেলা। কোলকাতায় এসে একবার সবার সাথে দেখা করে ক'দিন থেকে যাবে, তেমন অবকাশও বার করতে পারে না আলবেলা। ফোনেই কথা হয় বাড়ির সবার সাথে, প্রিয় বৌদি ফুকিয়ের সাথে। মাঝে একবার কল্যাণ আর ফুকিয়ে এসে বেঙ্গালুরুতে আহির বাহারকে অনেক উপহার সামগ্রী দিয়ে দেখে গেছে। আলবেলা আর ওর বর বন্দিশ ফুকিয়ের সাথে হাসি মজা চটুল রসিকতা করেছে, বলেছে সৌন্দর্য্য কমে যাবার ভয়ে, দাদার কাছে আকর্ষণ হারাবার ভয়েই ফুকিয়ে তাদের জন্য আরেকটা ছোট্ট সুন্দর ফুকিয়ে আনছে না হয়তো। একথায় ফুকিয়ের লালচে গাল আরও লাল হয়েছে, হাসিতে চেরাচোখ প্রায় বুজেই গেছে।


বেঙ্গালুরু থেকে ঘুরে যাবার অল্প কিছুদিন পরেই কল্যাণ আর ফুকিয়ে বিদেশে পাড়ি জমালো। এবার দু'জনেই একসাথে, ইউরোপীয় লোকসঙ্গীতের আর বিশুদ্ধ সঙ্গীতের সন্ধানে, ভারতীয় সঙ্গীতের সাথে ফিউশনের সুযোগ খুঁজতে, গান নিয়ে আরও নতুন ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে, ঠাকুর্দার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আরেক ধাপ এগোতে। প্রায় সাত বছর হতে চললো, কল্যাণ আর ফুকিয়ের বিয়ের। আলবেলার সাথে প্রায়ই ফুকিয়ের ফোনে কথা হয়। ফ্রান্সে ওরা যখন, আলবেলাকে অনেকবার করে আসতে বলে ফুকিয়ে, ইউরোপ ঘুরে দেখে যেতে। ইতিমধ্যেই এর অব্যবহিত পরেই কোলকাতায় ঠাকুমা মারা গেছেন, সেসময় ফুকিয়ের শরীরটা খারাপ ছিলো বলে ওরা আসতে পারে নি, ইউরোপেই ফুকিয়ের চিকিৎসা চলছিলো।


যাই হোক, এর ঠিক দু'বছর পরে এক শান্ত স্নিগ্ধ সকালে কোলকাতা থেকে মায়ের ফোন পেলো আলবেলা, কল্যাণ দেশে ফিরে এসেছে, একা। কল্যাণের সাথে ফুকিয়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে।

হৃদয়বিদারক এখবর শুনে আলবেলা খুঁজতে বসলো, দাদা কল্যাণের ও জাপানি বৌদি ফুকিয়ের মধ্যে কখনও টুকিটাকি ঝগড়ার কথাও তো তারা অন্ততঃ শোনে নি। ফুকিয়ে বৌদি এতোই ভালো ছিলো যে, ওদের বাবা-মা, ঠাকুমা পর্যন্ত তাদের বিদেশী বউয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো। বাঙালি সমাজ সংসারে একজন অত্যন্ত ভালো বাঙালি বৌয়েরই যেখানে নিন্দা মন্দ দুর্নাম করা পরিবারের লোকজনের স্বভাব, সেখানে একজন বিদেশিনী কতখানি ভালো হলে তবেই বৌ হিসেবে সবার অকুন্ঠ প্রশংসা পায়!



সুতরাং এই ডিভোর্সের ঘটনায় আলবেলা খুবই অবাক হোলো। আলবেলা মানতে পারে নি কিছুতেই। আলবেলা দাদার কাছে বারবার জানতে চেয়েছে, কিন্তু কল্যাণ চুপ করে থেকেছে কিছুক্ষণ, তারপর জলভরা চোখে মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে গেছে সামনে থেকে। আলবেলা ওদের ডিভোর্সের খবর শোনার পরই কয়েকদিনের জন্য কোলকাতায় এসেছিলো। বারবার যোগাযোগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে বৌদি ফুকিয়ের সাথে।



হাল ছাড়ে নি আলবেলা, দাদা বৌদির ডিভোর্সের আসল কারণটা জানতে। অনেকদিন ধরে চেষ্টার পরে শুনেছিলো আলবেলা, তার দাদা আর বৌদির ডিভোর্সের কারণ! ওরা দু'জনেই দু'জনের বুকভাঙা কষ্ট আর পাহাড়প্রমাণ হতাশা সহ্য করতে পারছিলো না, তাই দু'জনেই আলাদা হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।এ সবকিছুর কারণ শুনে কেঁপে উঠেছিলো আলবেলা.... ক্ষোভে, দুঃখে, হতাশায়!


ওদের দু'জনেরই রক্তে নাকি কী একটা সমস্যা আছে, যার ফলে ওদের কখনোই সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চা হওয়া সম্ভব নয়। একটি বাচ্চা হয়েছিলো, দুরারোগ্য রক্তের এক অসুখ নিয়ে, ইউরোপের অত্যাধুনিক চিকিৎসাতেও তার নাকি নিরাময় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। কারণ সে অসুখের নাকি কোনো চিকিৎসাই আবিষ্কার হয় নি। সন্তান জন্মের পরে এই দুঃসহ দুর্বিপাকে ওরা মানসিক সন্তুলন হারিয়ে বসলো। এতো আগ্রহের, এতো ভালোবাসার সন্তান, সে মাত্র কিছুবছরের, কিছুমাসের বা কিছুদিনেরই অতিথি! কল্যাণ আর ফুকিয়ে মানতেই পারে নি, এই কঠিন সত্য। আপ্রাণ বিশ্বাস করতে চেষ্টা করেছে, হয়তোবা কোথাও ভুল হচ্ছে। টাকার তো অভাব ছিলো না, যথাসাধ্য চিকিৎসা করিয়েছে তাদের ছেলে নিচিচন্দ্রের। কত সাধ করে নাম দিয়েছিলো ছেলের.... জাপানি ভাষায় নিচি মানে সূর্য আর কল্যাণ-আলবেলার ঠাকুর্দার নামের প্রথমাংশ চন্দ্র...... মিলিয়ে নিচিচন্দ্র! ছেলে জন্মানোর সাথে সাথেই ছেলের এই দুরারোগ্য মারণব্যাধির খবর পেয়ে দুর্বিষহ অভিঘাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দম্পতি, এক অসহায় পিতা-মাতা কাউকে তাদের সন্তান জন্মের খবর পর্যন্ত দিতে পারে নি। যেকটা দিন সময় আছে হাতে দু'জনেই বুক দিয়ে আগলে রেখেছে সন্তানকে। ওদের নিজেদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কেন অবোধ শিশু নিচিচন্দ্র করবে? তাদের জীবনের বিনিময়েও যদি নিচিচন্দ্রের জীবন ভিক্ষায় পাওয়া যেতো ঈশ্বরের দরবার থেকে। তবু শেষরক্ষা হোলো না, আসলে তো রক্ষা হবার কথাই ছিলো না! মাত্র ন'মাস বয়সে মা-বাবার বুক খালি করে নিচিচন্দ্র ফিরে গেলো হয়তো অমৃতলোকে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা, বাবা-মায়ের বাজি লাগানো লড়াই, সব ব্যর্থ করে দিয়ে নিচিচন্দ্র মারা গেলো রক্তের জিনঘটিত দুরারোগ্য মারণ ব্যাধি মেজর "বিটা থ্যালাসেমিয়ার" করাল থাবায়।



বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করালে তাদের জীবনে এই দুর্ঘটনা ঘটতো না। বিয়েতে এটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি বিষয়। জানা অবশ্যই প্রয়োজনীয় যে পাত্র বা পাত্রী থ্যালাসেমিয়া মাইনর আক্রান্ত অথবা ক্যারিয়ার কিনা! এর উপরেই আগামী বংশধরদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে যে! পাত্রীর আগে বয়ফ্রেন্ড ছিলো কিনা, পাত্রের চরিত্রে কোন দোষ ত্রুটি আছে কিনা, জানার থেকেও বেশী দরকারী বিয়ের কথা পাকা করার আগে, একটি রক্তপরীক্ষা। যাতে জানা যাবে রক্তে এমন কোন উপাদান উপস্থিত আছে কিনা যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভয়ঙ্করভাবে এফেক্ট করতে পারে। এই দুঃসহ দুঃসংবাদে আলবেলা এবং তাদের পুরো পরিবার বাকরুদ্ধ।


এবার আলবেলার মনে উঠে এলো যুক্তিসঙ্গত কিছু বক্তব্য, সকলের জন্য, বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছেলে মেয়ে এবং ছেলেমেয়েদের বিয়ে করাতে ইচ্ছুক বাবা-মা ও তাদের পরিবার পরিজনদের জন্য...... "আধুনিক প্রযুক্তি এখন যথেষ্ট সুলভ, সুতরাং এর ব্যবহার করতে ক্ষতি কী? এতে লজ্জা পাবার বা এতে এতো ইমোশনাল হবার মতো কিছু তো নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার খাতিরে আমাদের প্র্যাকটিকাল হতে শিখতে হবে। একটি দুরারোগ্য বা নিরাময়-অযোগ্য ব্যাধি, যার নির্দিষ্ট চিকিৎসা হয়তো নেই, তবে এই রোগ সন্তানের হতে পারে কিনা, তার আগাম আভাস কিন্তু পাওয়া সম্ভব কেবল একটি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে। জানা সম্ভব, রক্ত জিন ঘটিত থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক অথবা মাইনর আক্রান্ত কিনা? জেনে নেওয়া সম্ভব, দরকার শুধু সামান্য সচেতন সদিচ্ছা। একটি রোগ যার চিকিৎসা নেই, কিন্তু প্রতিরোধ সম্ভব, বিয়ের আগেই পাত্র পাত্রীর রক্তের নমুনার বিশেষ একটি পরীক্ষায়, সম্ভব ডাক্তারের মতামত ও সহযোগিতা নেওয়া।"


এই বিষয়ে আলবেলা নিজের মতো করে নিজে চেনা পরিচিত গণ্ডীতে ছড়াতে শুরু করলো "থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা।" দাদা কল্যাণ, স্বামী বন্দিশ, পুরো পরিবার, বন্ধু বান্ধব সবাইকে পাশে পেয়েছে আলবেলা। এমনকি আলবেলা আজকাল গানের শো বা প্রোগ্রাম থেকে পাওয়া টাকার বড়ো অংশও দেশের "থ্যালাসেমিয়া ফাইটার" সংগঠনে দান করে দেয়, অনুষ্ঠান শেষে সুযোগ খুঁজে তার শ্রোতা দর্শকদের জানায় "থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা" সম্পর্কে।

বেশ ক'বছর ধরে চলছে আলবেলার এই কর্মকাণ্ড।


এবার আলবেলা দক্ষিণ এশীয় একটি দেশের আমন্ত্রণে সেদেশে গেছে গানের প্রোগ্রাম করতে, কারণ অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রির পুরো টাকাই যাবে "থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধের সহায়তা করার কাজে নিয়োজিত একটি বিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তহবিলে"।

সেদেশে, অর্থাৎ বাংলাদেশে পৌঁছে মঞ্চে ওঠার আগে থমকে দাঁড়ালো, তাদের গানের দলগুলিকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে ঐ থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার। আলবেলাকে দেখেছে, ফুকিয়ে, ফুকিয়ে গেইশা, তার জাপানি বৌদি। সংক্ষেপে জানলো আলবেলা, নিজের জীবনে এই দুর্বিপাকের পরে ডিভোর্স দিয়ে ফুকিয়ে এক অন্যকাজে যুক্ত হয়েছে, নিজের দেশ ছেড়ে, দক্ষিণ এশীয় সব দেশে যেখানে যেখানে থ্যালাসেমিয়া সচেতনতা নেই, সর্বত্র ঝাঁপিয়ে পড়েছে ফুকিয়ে, দুরুহ কঠিন কাজ। তবু হার স্বীকার করে নি ফুকিয়ে, নিজের সব সম্পত্তি একাজে দেবার পরও অর্থ সংগ্রহ করে চলেছে আক্রান্তদের সাহায্যের জন্য, বহু মানুষ এগিয়ে এসেছে, ফুকিয়ে জনসমর্থন পেয়েছে, হয়তো পর্যাপ্ত নয়, তবুও।


আলবেলার গ্রুপ ছাড়াও আরো অনেক গ্রুপ এসেছে অনুষ্ঠান করতে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার ফুকিয়ে গেইশা মঞ্চে উঠে শিল্পী শ্রোতা দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলো, পরিষ্কার বাংলায়, "সবচেয়ে বড় কথা হোলো, সেইসব মা বাবার মনের অবস্থাটা একটু চিন্তা করুন, যাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত! আসুন আমরা সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলি থ্যালাসেমিয়ার বিরুদ্ধে। সচেতন থাকলে আমরা হয়তো একদিন থ্যালাসেমিয়ামুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে পারবো। আসুন প্রার্থণা করি পৃথিবীর সকল শিশুর জীবন হোক সুন্দর, প্রতিটি শিশু জন্মাক সুস্থ শরীর নিয়ে, প্রত্যেক মা-বাবার মুখের হাসি থাকুক অটুট, অমলিন!" ফুকিয়ের গলা কাঁপছে, চোখের কোণ চিকচিক করছে। আলবেলার চোখও ঝাপসা তখন, ফুকিয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে! দু'জনেই ভাবছে আজ কল্যাণেরও এখানে উপস্থিত থাকা প্রয়োজন ছিলো


(বিষয়: ভুল সংশোধন)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics