জামাই আদর
জামাই আদর
আমাদের বাংলা দেশ আদর আপ্যায়নের জন্য প্রসিদ্ধ। আগেকার দিনে কোন তৃষ্ণার্ত মানুষ যদি এক গ্লাস জলও চাইত কোন গৃহস্থ বাড়িতে, তখন তাঁকে শুধু জল নয় - জলের সাথে মিষ্টিও দেওয়া হত। কারণ আমাদের পূর্বপুরুষেরা অতিথিকে দেবতা নারায়ণ হিসাবে মানত। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে মজার ছিল শালা শালীদের সাথে জামাইবাবুদের সম্পর্ক। এক কথায় যাকে বলে অম্ল - মধুর সম্পর্ক। বিশেষত শালীর সাথে জামাইবাবুর সম্পর্ক। আসলে একটি বিয়ে তো শুধুই দুটি ব্যক্তির মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ক নয়, এটা আসলে মূলত দুটি পরিবারের মধ্যেকার সম্পর্ক। একে অন্যের সুখে দুঃখে, বিপদে সম্পদে থাকার সম্পর্ক। তাই দুই পরিবারের ভিতর একটা একে অন্যের বাড়ি যাতায়াতের ব্যাপার থেকেই যায় এবং এর ফলে নৈকট্য বাড়ে - সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়।
এক গ্রামে অনেক দিন জামাই শ্বশুরবাড়ি আসে না। সেই জন্য সেই বাড়ীর কর্তা অর্থাৎ শ্বশুরের বড় নিন্দা। গাঁয়ের লোকেরা বলে, তোমাদের বাড়ি জামাই আসে না কেন? নিশ্চয়ই এর মধ্যে একটা গোপন কারণ আছে।
কারণ যা আছে, শ্বশুর তো তা ভালোই জানেন। শ্বশুরবাড়িতে জামাইর শালা নাই, শালি নাই। ইয়ারকি-ঠাট্টা করিবার কেহ নাই। সেই জন্যই তো জামাই আর শ্বশুরবাড়িতে আসে না। কিন্তু এই লোক নিন্দেও তো আর সহ্য করা যায় না।
অনেক ভেবে - চিন্তে শ্বশুর ঠিক করলেন, এবার যেমন করেই হোক, জামাইকে আনতে হবেই । যদি প্রয়োজন হয় না হয় শ্বশুর হয়েও জামাইর সঙ্গে একটু ঠাট্টা-ইয়ারকি করবেন। তাছাড়া বাড়িতে অন্য লোক নাই। কেউ তো আর দেখতে আসবে না।
একদিন হাটের মধ্যে জামাইর সঙ্গে শ্বশুরের দেখা হইল। শ্বশুর জামাইকে বলিলেন, ‘তা বাবাজি, আমাদের ওমুখো যে হন-ই না, আজ চলুন আমাদের ওখানে।’ জামাই উত্তর করিল, ‘আপনাদের ওখানে কি আর যাব! শালা নাই, শালী নাই, কাহার সঙ্গে বসে দু দন্ড কথাবার্তা বলব ?’ একথা শুনে শ্বশুর বুঝলেন জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ী যাবার কোন আগ্রহ নাই। তখন শ্বশুর মিথ্যা করিয়া বলিলেন, ‘তা এবার কলকাতা হইতে আমার এক ভাইজি আসিয়াছে। কলেজে পড়ে। সম্পর্কে তোমার শালী, তাহার সঙ্গে অনেক হাসি-তামাশা করিতে পারিবে।’ জামাই শুনে ভাবল কলকাতা শহরের মেয়ে - রঙ্গ রসিকতায় পটু হইবে নিশ্চয়ই। অতএব জামাই রাজি হইয়া শ্বশুরবাড়িতে আসিল। আসিয়া দেখে, কলকাতা হইতে কেহই আসে নাই। শ্বশুর তাহাকে ফাঁকি দিয়াছেন। জামাই ভাবিল, আজকের দিনটি মাটি হইল।
শ্বশুর যাহা ভাবিয়াছিলেন, তাহা তো তাহার মনেই আছে!
আহারের সময় হইল। শ্বশুরবাড়ি আসিয়া জামাইরা শালা-শালী লইয়া এক থালায় ভাত খায়। শ্বশুর তাঁহার স্ত্রীকে বলিলেন, ‘দেখো, বড় থালাখানায় আজ আমাদের ভাত দাও। আমি আর জামাই এক থালায় ভাত খাইব।’
শ্বশুর আর জামাই একসঙ্গে এক থালায় ভাত খাইতে বসিলেন। নানা রকম তরকারি দিয়া খাওয়া চলিতে লাগিল। শ্বশুর ভাবিলেন, চালাকি করিয়া জামাইকে ক্ষীর খাইতে দিব না।
তিনি জামাইকে বলিলেন, ‘জামাই খাওয়া তো হইয়াছে, এবার হাত ধোও।’
জামাই দেখিল, শ্বশুর তাহাকে ক্ষীর না খাওয়াইয়া ঠকাইবার মতলব করিয়াছেন। জামাই তখন এক গল্প ফাঁদিয়া বলিল, ‘হাত আর ধুইব কি? আপনাদের বাড়িতে আসিবার সময় সামনে পড়িল এক প্রকাণ্ড সাপ। কহিলে বিশ্বাস করিবেন না, আমাকে না দেখিয়া, ওই যে শিকার ওপরে ক্ষীরের হাঁড়িটা ঝুলিতেছে না? ওই অত উঁচু একটা ফণা মেলিয়া ধরিল সাপটা আমার দিকে।’
শ্বশুর দেখিলেন, ধরা পড়িয়াছেন। জামাই ক্ষীরের কথা টের পাইয়াছে। তিনি তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, ‘তাই তো! ক্ষীরের কথা তো একেবারে ভুল হইয়া গিয়াছে। আন আন, ক্ষীর আন।’
শাশুড়ি একটু মুচকি হাসিয়া তাড়াতাড়ি ক্ষীর আনিয়া দিলেন। ক্ষীরের সঙ্গে মাখিয়া খাইবার জন্য কিঞ্চিৎ ভাতও দিলেন।
জামাই ভাবিল, ‘শ্বশুর আমাকে ক্ষীর খাওয়া হইতে বঞ্চিত করিতেছিলেন, এবার আমি তাঁহাকে ক্ষীরই খাইতে দিব না।’ জামাই শ্বশুরের সঙ্গে গল্প আরম্ভ করিল, ‘এখনকার কলিকালের কথা আর কি বলিব? বউরা স্বামীকে মানিতে চাহে না। এই আপনাদের মেয়ে, যাহাকে আমি বিবাহ করিয়াছি; আমি যদি তাহাকে বলি এদিক থাকো, সে চলিয়া যায় ওদিকে।’ বলিবার সঙ্গে সঙ্গেই তাহা দেখাইয়া দিবার অজুহাতে জামাই পাতের ক্ষীরটুকু নিজের দিকে টানিয়া লইয়া ভাতগুলি শ্বশুরের দিকে ঠেলিয়া দিল।
শ্বশুর দেখিলেন, ‘ঠকাইবার মতলবে জামাই আমাকে ক্ষীর খাইতে দিবে না। আচ্ছা দেখাইতেছি!’
উপদেশের ছলে শ্বশুর জামাইকে বলিলেন, ‘তা বাবাজি! তোমরা ছেলেছোকরা মানুষ। মিলমিশ হইয়া থাকো, মিলমিশ হইয়া থাকো।’
বলিতে বলিতে তাহা দেখাইয়া দিবার অজুহাতে ক্ষীর ও ভাত একসঙ্গে মাখিয়া ফেলিলেন।
নীতি :বুদ্ধি হলো- পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ।
