ইচ্ছে ঠাকুর
ইচ্ছে ঠাকুর
"ইচ্ছে ঠাকুরের কাছে কিছু প্রার্থনা করলে তা পাওয়া যায়,"
ঠাম্মার কথায় চোখ বড় হয় জুমনের, "ধুৎ ওই নামে কোনও ঠাকুর আছে নাকি?"
"হ্যাঁ গো আছে," ঠাম্মার উত্তর একেবারে বিশ্বাস না হলেও, মনে ধরে জুমনের।
দক্ষিণ কলকাতার বহুতল আবাসনে ওদের ছোট পরিবারে বাবা, মা, ঠাম্মা আর আট বছরের জুমন। একরকম বাধা জুমনের দিনপঞ্জী, সকাল ছটায়, ইচ্ছে না করলেও, মা বিছানা থেকে তুলে দেয়, শীতকালে কম্বলের উষ্ণতা থেকে কার বেরোতে ইচ্ছে করে?
সাতসকালে ঘুম চোখে নড়তেই অনিচ্ছুক জুমনকে ক্রমাগত মা তাড়া দেয়, "তাড়াতাড়ি কর রে," টয়লেট, দাঁত-মাজা, স্কুলের ড্রেস, টোস্ট দুধ মুখে গুঁজে কাঁটায় কাঁটায় পৌনে সাতটার মধ্যে মায়ের সাথে পৌঁছতে হয় আবাসনের গেটে। একটু দেরি হলেই আবার স্কুলের বাস চলে যাবে, তখন আর এক বিপদ! বাবা কাঁচা ঘুম থেকে উঠে গাড়িতে জুমনকে স্কুলে পৌঁছবে বটে সঙ্গে তার বকুনিও জুমনকে হজম করতে হবে। ঘুম থেকে উঠেই জুমনের প্রতিদিনের প্রার্থনা, "ইচ্ছে ঠাকুর তুমি স্কুল বন্ধ করে দিতে পার না?"
দুপুরে জুমন যখন বাড়ী ফেরে তখন বাবা মা অপিসে, ঠাম্মা নিজের ঘরে বিশ্রাম করছেন। এই ফাঁকে নিজের ট্যাবলেটে একটু খেলতে ইচ্ছে হলেও কমলা মাসীর জ্বালায় তার জো নেই।
"জুমন ট্যাবলেট রাখো, স্নানে যাও," চড়া গলা কমলা মাসীর।
ছোট থেকে জুমন দেখে আসছে স্বাস্থবতী মাঝ বয়সী এই কমলা মাসীকে, বারুইপুর থেকে ট্রেনে করে আসে জুমনদের বাড়িতে । মায়ের অবর্তমানে সেই একরকম বাড়ির কর্তী। রান্না-বান্না, ঘর পরিষ্কার, ওয়াশিং মেশিন চালানো, ঠাম্মাকে খেতে দেওয়া, আর জুমনের ওপর নজর রাখা, মা অপিস থেকে ফেরা পর্যন্ত ।
স্নানের পর জুমনের খাওয়ার সময়ও কমলা মাসীর কড়া নজর যাতে ও ট্যাবলেট নিয়ে না খেলে, একটু অনিয়ম হলেই, "জুমন! খাবার সময় আবার ট্যাবলেট? দাঁড়াও আজ মাকে ঠিক বলে দেব?"
জুমন খুব জানে এই কমলা মাসীর নালিশের কি প্রতিক্রিয়া হয়, বাবা মায়ের বকুনির সঙ্গে এক সপ্তাহের জন্য ট্যাবলেট বন্ধ আলমারিতে। উফফ কি জ্বালা! খাবার পরেই শোয়া, এখানেও মাসী মাঝে মাঝে এসে দেখে জুমন শুয়ে ট্যাবলেট নিয়ে খেলছে না তো? বিরক্ত জুমন প্রার্থনা করে, "ইচ্ছে ঠাকুর প্লিজ তুমি ট্রেন বন্ধ করে দাও, তাহলেই কমলা মাসী...,"
বিকেলে সমবয়সীদের সঙ্গে বাড়ির সামনের পার্কে জুমন খেলে, কিন্তু ঠিক যখন বন্ধুদের সঙ্গে খেলাটা জমে ওঠে তখনই বারান্দা থেকে কমলা মাসীর ডাক, "জুমন! রুমাদিদির আসার সময় হয়ে গেল,"
অগত্যা বিরস বদনে প্রতিদিন খেলা ছেড়ে বাড়ি ফেরার পথে মনে মনে বলে, "ইচ্ছে ঠাকুর যদি বাসটাও বন্ধ করে দিতে পার,"
আসলে রুমা কলেজে পড়া ছাত্রী, কলেজ ফেরৎ বাসে করে জুমনকে পড়াতে আসে ।
ক্রমাগত নিষ্ফল প্রার্থনায় হতাশ জুমন ঠাম্মাকে একদিন বলে, "ইচ্ছা ঠাকুর নেই, থাকলেও সে কিচ্ছু পারে না,"
ঠাম্মা একটা গল্পের বই পড়ছিলেন জুমনের প্রশ্নে একগাল হেসে বলেন, "ইচ্ছা ঠাকুর এক মানুষ, তোমার আগে যারা আছে তাদের কাছে যাবেন তারপরে তো তুমি, কে জানে তোমার লাইন কত জনের পেছনে?"
ক্রমাগত বিফল প্রার্থনায় হতাশ জুমন সেরাতে শুয়ে মনে মনে বলে, "ইচ্ছে ঠাকুর তুমি কিচ্ছু পারো না,"
হঠাৎ সেদিন মাঝরাতে জুমনের ঘুম ভেঙে গেল, চারিদিক নিস্তব্ধ কিন্তু চোখ মেলে দেখে যেন আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। ভালো করে দেখে এতো দিনের আলোর মত নয় যেন এক শুভ্র নীলাভ আলো, মনে হল আকাশের উজ্জ্বল চাঁদটাই নেমে এসেছে তাদের বারান্দায়। আজ যে চমৎকার হয়ে গেল, বারান্দায় হাঁসিমুখে দাঁড়িয়ে শ্বেতশুভ্র বসনে লোকটা কে? ওই তীব্র আলো যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে ওর শরীর থেকে। নিশ্চই ইনি ইচ্ছে ঠাকুর! আশীর্বাদ দেবার মত নিজের ডান হাত তুলে মাথা নেড়ে জুমনকে বোঝাচ্ছে তার কথা তিনি শুনেছেন। পরমুহূর্ত্তে আকাশে উনি মিলিয়ে গেলেন বারান্দায় আবার সেই চাপা রাতের অন্ধকার।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে জুমন শুনলো স্কুল বন্ধ, ট্রেন বাসও বন্ধ। মহা আনন্দ জুমনের স্কুলে যেতে হবে না, কমলা মাসী আর রুমাদিদি আসছে না । কিন্তু বিকেল গড়াতে জুমন জানতে পারলো বন্ধুদের সাথে তার খেলাও বন্ধ। করোনার করুণায় এখন সবাই গৃহ বন্দি। প্রথম কয়েকটা দিন কোন রকমে কাটলেও এখন তার মন ছটফট করছে বন্ধুদের জন্য। কিশোর জুমনের জানা নেই সমাজে সকলেই নিয়ম ও শৃঙ্খলায় বেড়ায় নিয়ন্ত্রিত । বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে করুন মুখে প্রার্থনা করে, "ইচ্ছে ঠাকুর আর ভালো লাগছে না, সব আগের মতই করে দাও,"
কে জানে জুমনের লাইন কতজনের পরে, কবেইচ্ছে ঠাকুর ওর প্রার্থনা শুনবে?