ঢেউ
ঢেউ
সমুদ্রের ঢেউ গুলো ক্রমাগত একের পর এক আছড়ে পড়ছে রুক্ষ পাথরের ওপর। অনবরত একঘেঁয়ে ঢেউ ভাঙ্গার আওয়াজ। সামনের দিক থেকে কিছু লোকের কথা বাত্রার আওয়াজ লোকটার কানে যায়, মনে হয় দ্রুত ওরা এদিকে এগিয়ে আসছে । তাড়াতাড়ি বামপাশে সরে ও এগিয়ে আসা লোকেদের যাবার রাস্তা করতে গিয়ে নুড়ি আর বালি মেশানো সরু পায়ে চলা পথে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় ।
"আরে সাবধানে! লাগে নি তো?" অচেনা এক মহিলা কণ্ঠস্বর, তাকে পড়ে যেতে দেখে উনি হয়তো ছুটে এসেছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ।
লোকটা শুনেও উত্তর দেয় না, কারণ ও সঠিক জানে না কার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলা। যদিও মহিলার কন্ঠস্বর তার কেমন যেন চেনা চেনা লাগে । ও বরং উঠে দাঁড়াবার চেষ্টায় মন দেয়।
সহসা অনুভব করে ওই মহিলার নরম হাতই পর মুহুর্ত্তে ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করছে । লোকটা উঠে দাঁড়াতেই উনি কোনও সময় নষ্ট না করে লেগে পড়েন ওর জামা কাপড়ে লেগে থাকা শুকনো বালির দানা গুলো ঝেড়ে দিতে ।
"আপনি ঠিক আছেন তো?" মহিলা আবার জিজ্ঞেস করেন।
"হ্যাঁ," ওর চাপা সংক্ষিপ্ত উত্তর।
"এখানে বালির তলায় লুকিয়ে থাকা নুড়ি পাথরগুলো একটু অন্য মনস্ক হলেই বেতাল করে দেয়।" মহিলা আবার বলেন।
"ধন্যবাদ! সেকথা আমি জানি। গত ছ বছর ধরে এখানে আসছি ।"
কেন জানি না লোকটারও মনে হলো প্রতিদিন ওর মত এই মহিলাও সমুদ্রতটে হাঁটতে আসেন । একবার মনে হল জিজ্ঞেস করতে, আমি কি আপনাকে চিনি? প্রশ্নটা করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে চুপ করে থাকে। এই তো কদিন আগেই এই মহিলাই বোধহয় পাশকাটিয়ে যাবার সময় গা ঘেঁষে যেতে বলেছিলেন "সরি " সেটাই প্রথম কোনো শব্দ উনি লোকটার উদ্দেশ্যে বলেছেন। কিন্তু এ নতুন কি কথা? দয়া দেখানো কথা হামেশাই লোকেটি শুনতে অভ্যস্ত । লোকটি এমনই একজন যাকে এই ছোট্ট সমুদ্র সৈকত শহরে সকলে চেনে কিন্তু তবুও ওর কোনও বন্ধু নেই ।
এতো লোক থাকতে এই মহিলার প্রতিই ওর এত আকর্ষণ কেন? কখন যে মহিলার কণ্ঠস্বর ওর মনে গেঁথে গেছে তাও ওর ঠিক জানা নেই ।
"আপনি ঠিক আছেন তো?" আবার মহিলা প্রশ্ন করেন। এবার ও বোঝে মহিলা এখনও ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সে মানবতার খাতিরে বা দয়া দেখাতে, কে জানে?
"আপনার কি মনে হচ্ছে আমি ঠিক নেই?" অভদ্রতা করতে না চাইলেও অজান্তে কথাগুলো ওর মুখ থেকে বেরিয়ে যায়। আসলে সর্বত্র, সবসময় মানুষের মেকি দয়া প্রদর্শনে ও আজ যেন ক্লান্ত।
"এদিকটা আজ এক্কেবারে ফাঁকা, আপনাকে সাহায্য করার কেউ জন্য নেই, তাই দাঁড়িয়ে পড়লাম, "
বসন্তের একটু গরমের সকালে সাধারণতঃ অনেক লোকজন থাকে এদিকটায় কিন্তু আজ আবহাওয়া অন্যরকম। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার সূচ ওর মুখমন্ডল এমনিতেই অসাড় করে দিচ্ছে। আজ চারিপাশে লোকজনের কথাবার্ত্রাও তেমন নেই । শুধু কিছু দূরে সমুদ্রর একনাগাড়ে গর্জন করে যাচ্ছে ।
"আজ আর কারোর সঙ্গে ধাক্কা লাগবার ভয় নেই বলছেন?" লোকটি রসিকতা করে বলে।
মহিলা হেঁসে বলেন, "কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ, এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে, এই উপযুক্ত সময় এখন থেকে চলে যাবার নচেৎ হিম ঠান্ডা বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। এমন ঠান্ডায় এক কাপ কফি আমার এখন খুব প্রয়োজন চলুন আজ আমাদের প্রথম আলাপে এক কাপ গরম কফি হয়ে যাক।"
"প্রিন্স কাফে তে?"
"হাঁ আমি ওই দিকেই যাচ্ছিলাম " মহিলা বলেন
"আমিও"
বসন্তে প্রথম বৃষ্টির কনকনে এক ফোঁটা জল ততক্ষনে ও নিজের গালে অনুভব করে ।
পাস্ থেকে অন্য একজন মহিলা তাড়া দেয়, "তাড়াতাড়ি পা চালাও, বৃষ্ট এই এলো বলে,"
এতক্ষন কেউ যে ওদেরই পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল লোকটা বুঝতেই পারে নি। একটু চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে "উনি কে?"
"মাপ করবেন পরিচয় করিয়ে দিই নি বলে। আমার বন্ধু এলিস। "
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বালির রাস্তাটা পার করে ওরা পৌঁছয় প্রায় যানহীন রাস্তায়। ওরা দ্রুত চলতে থাকে, কিন্তু ততক্ষনে হাল্কা ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে । লোকটি মহিলার উষ্ণ হাতের স্পর্শ অনুভব করে। অনুভব করে দুজনের একসঙ্গে পাশাপাশি হাঁটা, মনে হয় যেন আজ পথটা বড়ই সংক্ষিপ্ত প্রিন্স ক্যাফেতে কত তাড়াতাড়ি ওদের পৌঁছে দিল।
প্রিন্স ক্যাফের ভিতরের উষ্ণতা, কফির সুবাস, লোকজনের কথাবার্তা। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি আর ঠান্ডা হওয়ার থেকে যেমন রেহাই তেমনই উষ্ণ কফির সঙ্গে আড্ডা দেবার সুন্দর পরিবেশ। কাঁচের জানলার পাশে একটা গোল টেবিলে বৃত্তাকারে ওরা বসে। বৃষ্টির ঝাপটায় জানলার বাইরেটা ঝাপসা দেখাচ্ছে।
মহিলা তার বান্ধবীর দিকে চেয়ে বলেন, "জানো এলিস, এখানেই আমার জীবনের ভালোবাসার মানুষটাকে হঠাৎ একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম,"
"ওহ তাই নাকি?" এলিস বলে।
"হ্যাঁ"
"এখন তিনি কোথায়?" লোকটি জিজ্ঞেস করেন।
"জানি না।" মহিলা একটু আনমনা হয়ে বলেন, "বোধহয় আমাদের সেদিন দেখাই হয়েছিল হারিয়ে যাবার জন্য! কে জানে হয়তো আবার তাকে খুঁজে পাব কোনদিন, সেই আশায় এখানে প্রতিবছর এইসময় আসি, প্রতিবারেই ভাবি এই বার সেও আসবে ।" মহিলার ব্যথিত কণ্ঠস্বর প্রায় রুদ্ধ হয়ে আসে, নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে বলেন, "ছাড়ুন আমার কথা, এখন আপনার কথা কিছু বলুন?"
আমার জীবনের আলো তো ছ বছর আগে নিভে গেছে। এখন ওই একটাই আশা, পুরোনো স্মৃতির সঙ্গে একবার অন্তত মোলাকাৎ হোক," অত্যন্ত আবেগে নমনীয় স্বরে লোকটি বলে।
মহিলা বলতে থাকেন, "সে বছর কলেজের বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসেছিলাম এই ছোট্ট শহরে। ভাবি নি এখানে এসে আমার জীবনের গতি পাল্টে যাবে, এলিস তুমি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সেবার আসতে পারো নি। সে দিনটাও ছিল এমনই ঠান্ডা, বৃষ্টি, কফির অর্ডার দিয়ে খেয়াল হলো তাড়াহুড়োতে পয়সার ব্যাগটাই আনতে ভুলে গেছি। এদিকে বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ভাবছি এখন কি করবো। ও আমাকে লক্ষ্য করছিলো অনেক্ষন ধরে। নিজেই এগিয়ে এসে বললো 'এই কফিটা আমার তরফে, কালকে না হয় আপনি শোধ করে দেবেন।' এভাবেই শুরু তারপর কখন যে মন দেয়া নেয়া হয়েছিল বুঝতেই পারি নি । কলেজের সঙ্গীদের সাথে না ফিরে আমি এক সপ্তাহ এখানেই রয়ে গেলাম ওর সঙ্গে। দুজনে একসাথে সমুদ্রতটে হাঁটতাম, কত গল্প আর রোজ এখানে আসতাম। ওযে কফি খুব ভালোবাসতো।"
"তুমি এই সবই আমাকে চিঠিতে লিখেছিলে।" এলিস বলে।
"ধন্যবাদ এলিস চিঠি গুলো রাখার জন্য, পাঁচ বছর পর ওই চিঠি গুলোই আমার স্মৃতির অনেক জট খুলতে সাহায্য করেছে। তখনতো আনন্দে ভাসছি বাড়ি ফিরেই কখন সকলকে জানাবো আমার মনের মানুষকে খুঁজে পেয়েছি। ও নিজের বাড়িতেও জানাবে আমার কথা। বিয়েটা দুজনে তাড়াতাড়ি সেরে ফেলব। সেদিন কাক ভোরে আমরা এয়ারপোর্টে যাচ্ছিলাম ওর গাড়িতে । চারিদিক তখনও অন্ধকার, রাস্তা যানহীন, ওর বলিষ্ট এক হাতে ধরা আমার হাত। নিশ্চিত এক সম্পূর্ণতার অনুভব, অজান্তে কখন নিজের ঠোঁট ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলাম ও উত্তর দিতে এগিয়ে এলো। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটে গেলো দুর্ঘটনাটা । জ্ঞান হল হাসপাতালের বেডে, মাথায়, হাতে ব্যাণ্ডেজ । কোথায়? কি হয়েছে? কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমি যেন এক মহাশুন্যে। জীবনের স্মৃতির অনেকটাই মুছে গিয়েছিল । বা-মা কেও চিনতে পারছিলাম না প্রথম দিকে । দীর্ঘ পাঁচ বছর লেগে গেল একটু একটু করে স্মৃতি ফিরতে। "
"আচ্ছা আপনার নাম কি?" লোকটি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।
"ডোরোথি লারসন,"
নামটা শুনেই লোকটির হাত ফস্কে হাঁটার লাঠিটা মাটিতে পরে গেল।
ডরোথি নিচু হয়ে সেটা তুলছে, উত্তেজিত লোকটি কাঁপা স্বরে বলে, "আচ্ছা ওই ছেলেটির নাম কি বেঞ্জামিন?"
"হাঁ, কিন্তু আপনি কি করে জানলেন? "
"ডরোথি তোমার বেঞ্জি তোমার সামনেই যে বসা, চিনতে পারছো না?"
"কোথায়?" ডরোথি এদিক সেদিক তাকায়।
"আমিই তোমার বেঞ্জি ডরোথি,"
"মোটেই নয়, আপনাকে মোটেই আমার বেঞ্জির মতো দেখতে নয়!"
এলিস হতবাক কথোপকথনের এই আকস্মিক দিকপরিবর্তনে।
বেঞ্জামিন বলে, "ওই দুর্ঘটনায় আমার মূলত আঘাত লেগেছিলো মুখে, এক্কেবারে থেঁতলে গিয়েছিলো। ওই দিনই আমার পৃথিবী তলিয়ে যায় ঘোর অন্ধকারে। অনেক পরীক্ষার পরে ডাক্তাররা জানায় ওরা নিরুপায়, জন্মের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি । অত্যন্ত সংকটপূর্ণ অবস্থার জন্য আমাকে স্থানান্তরিত করতে হয় অন্য এক হাসপাতালে। মুখ এতো ক্ষতবিক্ষত ছিল যে ডাক্তারকে বেশ কয়েকবার অপারেশন করতে হয়। সকলে বলে আমার বর্তমান মুখের চেহারা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। কি জানেন আমিতো নিজেকে দেখতেও পারি না। "
ডরোথি কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে বেঞ্জামিনকে পর্যবেক্ষণ করে। ততক্ষনে পকেট থেকে রুমাল বার করে কালো চশমা খুলে বেঞ্জামিন নিজের চোখ মুছছে । চশমা খুলতেই বেঞ্জামিনের মুখ যেন আরো বীভৎস লাগে। দু চোখের কোলে পরোটার পাটের মত চামড়ার স্তরের জন্য চোখ দুটো কুতকুতে দেখায়, নাকটাও কেমন একটা দলা মাংসের পিন্ডের মধ্যে দুটো ছিদ্র। কোথায় বেঞ্জামিনের সেই টিকলো নাক, টানা টানা চোখ? হঠাৎ ডরোথি চেয়ার থেকে উঠে "হা ভগবান " বলে নিজের মাথা দু হাতে ধরে ওই বৃষ্টির মধ্যেই কাফের বাইরে ছুট্টে বেরিয়ে যায়।
আশপাশের টেবিলে বসা কয়েকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, বোঝার চেষ্টা করে আকস্মিৎ কি হল।
এলিসেও উঠে "ডোরোথি দাঁড়াও" বলে তাকে অনুসরণ করার আগে বেঞ্জামিনের হাত ধরে বলে যায়, "ওই ঘটনার পর থেকে, আকস্মিৎ কোনও অপছন্দ কিছুর সম্মুখীন হলেই ওর প্রথম প্রতিক্রিয়া এমনই দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকা, " বলেই এলিস ডরোথির পিছনে চোটে ওই বৃষ্টির মধ্যে।
শোকাহত হতবাক বেঞ্জামিন একা টেবিলে বসে, ওর ইচ্ছে হলেও আজ ও আর আগের মত দৌড়োতে পারে না। প্রতিবছর যেজন্য এখানে আসা সেই বাস্তবের আজ ও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবে, ডরোথি কি কোনোদিন ওর কাছে ফিরে আসবে? ওর চোখ ভিজে যায় ভেবে মানুষের দয়া ভিক্ষা নিয়েই কি ওকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে?