Sangita Duary

Classics

4  

Sangita Duary

Classics

হ্যাপি'জ এন্ডিং

হ্যাপি'জ এন্ডিং

7 mins
256


#হ্যাপি'জ এন্ডিং


হামারি জিন্দেগী ভি ফিলমো কি তারাহ হোতি হ্যায়, আখির মে সব ঠিকই হো জাতি হ্যায়, ওহ কেহতে হে না হ্যাপিজ এন্ডিং..


টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল, সিনেমার দৌলতে হিন্দি ভাষাটাও আর কোনো সাদামাটা নিম্নবিত্ত পরিবারে দুর্বুদ্ধ থাকেনা আজকাল। বস্তির উঠতি ছেলে ছোকরার মুখে গালাগালির পাশাপাশি হিন্দি সিনেমার ডায়লগও অনর্গল চলতে থাকে কচিকাঁচাদের মুখে।


মোবাইল ফোন আর টিভিটাও এখন প্রতিটা বাড়িতে অতিপ্রয়োজনীয়। তা সে পেটে ঠিকঠাক খাবার না জুটলেও সান্ধ্যকালীন সিরিয়াল চাইই চাই।


চোদ্দ ইঞ্চি পুরোনো জাবদা টিভিটার সামনে বসে দুপুরবেলা একমনে সিনেমা গিলছে ফুলকি। আর মাথার মধ্যে গাঁথা হচ্ছে শাহরুখের ডায়লগ; শেষে সব ঠিক হয়ে যায়, হ্যাপি এন্ডিং।


তেলচিটে পড়া দাঁড়াভাঙ্গা চিরুনীতে চুলের বিনুনির লেজটার জট ছাড়িয়ে আঁচল গোছায় শিখা, মেয়ের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলে, "আজ ফিরতে রাত হতে পারে, ব্লাউজগুলো দোকানে জমা দিয়ে বড় বাজারে যাবো, লেস কিনতে হবে। তুই বিকেলে ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে দিবি মনে করে।"


ফুলকি এখন হাঁ করে "ওম শান্তি ওম" এ মশগুল। শিখা কাছে এসে মেয়ের মাথায় চাঁটি কষায় একটা, "কিরে, কি বলছি কানে যাচ্ছে নে? ওই টিভি গিলেই থাকো। সাড়ে চারটেয় জল দেবে, টিভিতে ঢুকে বসে থেকনি যেন, তাড়াতাড়ি না গেলে লাইন শেষে দাঁড়াতে হবে, আর বালতি বসাতে না বসাতেই জল শেষ। ওই তো একটা মাত্র সাপ্লাই জলের কল, তাতে পুরো বস্তি যদি হামলে পড়ে..."


মেয়েকে ছেড়ে এবার পড়শীর মাথা মুড়োতে শুরু করে শিখা।


তক্তপোষের কাছে চটের বস্তার ভিতর বানানো ব্লাউজগুলো গুছিয়ে রাখা রয়েছে। তোষকের তলা থেকে টাকা কটা গুনে নিয়ে আঁচলে বাঁধে শিখা, বেরোনোর আগে আবার মেয়েতে ফেরে, "জল এনে ভাত চাপিয়ে দিস, তোর বাপ ফিরে এলে খেয়ে নিবি দুজনে, আমার জন্য বসে থাকতে হবে নে।"


কি মনে করে মেয়ের চিবুক ছুঁয়ে চুমু খায় শিখা, "সাবধানে থাকিস!"


দিনকাল আজকাল মোটেই ভালো নয়। বাইরে তো দূর ঘরের ভিতরে থেকেও কি আর শান্তি আছে?


যতদিন শিবুর মিল চলছিল, ভালোই ছিল, কাপড়ের মিল, বাঁধা মাইনে ছিল, মালিকের শরিকরা রেষারেষি করে মিল বন্ধ করলো। ব্যাস, শিবু ঘরেই বসে রইলো ছ ছটা মাস। পাড়ার দোকানে গিয়ে গিয়ে শিখা সেলাইয়ের কাজ তুলতো, রাত জেগে সেলাই করলেও প্রতি ব্লাউজ দেড় টাকা দেয়, তাতে কি আর চলে?


শেষে রঙের কাজে বেরোয় শিবু। ভোরে বেরোয়, রাতে ফেরে, শিখাও বেশ কয়েকটা দোকান থেকে কাপড় নিয়ে আসে, নিজে ব্লাউজ বানিয়ে দেয়, আয় টাও বেড়েছে। মেয়েটাও তো বড় হচ্ছে, উঠতি বয়স, কত কিছু খেতে দিতে লাগে, তা বড়লোকদের মত শিখার সংসারে অতো বিলাসিতা কই?


মেয়েটা মুখ ফুটে বলে না কিছু, চায় নাও কিছু। শুধু ওই একটা নেশা, সিনেমা। তা থাক, পাড়ায় পাড়ায় ঢলাঢলি করে গল্প করার থেকে ঘরে বসে সিনেমা গেলা ভালো।


ওম কাপুরের বেডরুম দেখে ফুলকির বুকের ভিতর ফল্গুধারা বইতে শুরু হয়, বাব্বা! বড়লোকদের অমনধারা শোবার ঘর হয়! অমন গোল খাট হয়! ঘুম ভেঙে চাকর বাকর ওমনি করেই জুতো এগিয়ে দেয়! ওরা আবার সকালে দুধ চা দিয়ে শুকনো মুড়ি চিবোয়না, জ্যুস খায়!


ইস্কুলের পাশে ওই যে বড় দোতলা বাড়ি, ওরাও অমনধারা সিনেমার মত করে দিন কাটায়?


ফুলকিরা তো গরীব, মা বলে, "মন দিয়ে লেখাপড়া কর ফুলকি, বড় ঘরে বিয়ে দেব তোর, দেখবি কত সুখে থাকবি!"


সুখে থাকা কাকে বলে?


কোনো কাজ করতে হয়না, ভালোমন্দ খাওয়া জোটে, যা ইচ্ছে তাই কিনতে পারা যায়, অনেক অনেক শাড়ি থাকে, গয়না থাকে; একেই বুঝি সুখে থাকা বলে?


ফুলকির কিশোরী মন স্বপ্ন দেখে, ঠিক সিনেমার নায়িকার মত সাজছে সে, গান গেয়ে নাচছে নায়কের সাথে।


ফুলকির স্কুল থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় আধঘন্টা, হেঁটেই আসে।


সরকার সাইকেল দিয়েছে বিনামূল্যে কিন্তু সে সাইকেলের একবার টায়ার লিক হয়, তো একবার হ্যান্ডেল বেঁকে যায়, রোজ রোজ সাইকেল দোকানে সারাতে নিয়ে যাওয়ার থেকে হেঁটে যাওয়া ঢের ভালো।


কয়েকদিন ধরে একটা ছেলে খুব পিছনে ঘুরছে ফুলকির। মোটর বাইক চড়ে, দেখে খুব দামী মনে হয় বাইকটা।


পম্পা চোখ টিপে বলে, "ওই দেখ ফুলকি, তোর হিরো। ইস আমার যদি একটা থাকতো এরকম!"


পম্পার কথায় ফুলকির শিরদাঁড়া শিরশির করে ওঠে, সুপ্ত একটা বাসনা জেগে ওঠে মনে।


পম্পা বলে, "মালটার পয়সা আছে, ছাড়িস না!"


বেশ কিছুদিন পর, ফুলকিকে একলা পেয়ে পথ আটকায় ছেলেটা, এগিয়ে দেয় লাভ লেটার।


ফুলকি কাঁপা হাতে চিঠি পড়ে, বলে, "বিয়ে করবে?"


ছেলেটা হাহা হাসে, "নাহলে ভালোবেসেছি কেন? তবে তার আগে একটু এনজয় করি! এই তোমার ফিগারটা দারুণ, তুমি ফিল্মে নামবে? আমার এক দাদা আছে....!"


ফুলকির কান বন্ধ হয়ে যায়... ফিল্ম! ঐরকম আরাম, ঐরকম ঘর! ওই রকম জীবন!


সেদিনও শিখা বেরিয়েছিল দোকানে, ব্লাউজ জমা করতে, ফুলকির বাপও রঙের কাজে।


মা জানলে নির্ঘাত তালা ঝোলাবে ঘরে, তাই মাকে না জানিয়ে নিজের জামাকাপড় স্কুলের ব্যাগে ভরে ফুলকি গিয়ে দাঁড়ায় চারমাথা মোড়ে।


বড় হিরোইন হলে তবেই মার সামনে এসে দাঁড়াবে, পাকা ঘর তুলবে, মাকে শাড়ি কিনে দেবে, আর কোনো কাজ করতে দেবেনা বাবাকে। সব অভাব চলে যাবে ওদের। দুচোখে স্বপ্ন মেখে ফুলকি পাড়ি দেয় অজানায়, তার হিরোর হাত ধরে।


বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ফুলকি, নাহ, সে তো এখন চামেলী! পতিতাপল্লীর বাগানে বাহারী একটা ফুল সে এখন, চড়া মেকআপের মতোই চড়া দাম আছে তার। খদ্দের বেশ মোটা টাকা খসিয়েই তাকে হাতে পায়।


সকাল থেকে কোনো কাজ নেই, খাও, ঘুমোও, টিভি দেখো!


বিকেল হলে শুরু হয় তদ্বির, রঙ গন্ধ মেখে ঢুকতে হয় ঘরে।


প্রথম প্রথম কষ্ট হত খুব, এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। বুকের কষ্টটা ওই তরল সুধা নিভিয়ে দেয়, আরও আগ্রাসী করে তোলে চামেলীকে।


ভোর রাতে যখন গন্ধ চলে যায়, রঙ ফিকে হয়ে যায়, তখন নিকোনো উঠোনের ভিজে গন্ধটা, কলতলায় জল আগে নেওয়ার ঝগড়াটা, সস্তা চা ফোটানোর ঘ্রানটা বড্ড মনে পড়ে চামেলীর, আজও।


এত কিছু আছে তার, টাকা, পোশাক, খাবার, ঘর, তবু কি যেন নেই!


মাঝেমাঝে বাপমার মুখটা ভেসে ওঠে, কেউ খোঁজ করেনি না তার?


করেছিল হয়তো, কিন্তু তার বাপের তো টাকার জোর নেই, তাই খোঁজ করাটাও ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।


মা যদি জানতে পারে, ফুলকি এখন চামেলী হয়েছে, কি করবে মা? আগের মত আর চুলের ঝুটি ধরে নাড়া দেবে? সস্তার গন্ধ তেল মাখিয়ে দেবে ঘষে ঘষে? নাহ! মা যে তার ভীষণ অভিমানী।


চোখ বুজলেই যে তেরো বছরের একটি মেয়ের ছবি ভেসে আসে, যার নাম ছিল ফুলকি, যে সিনেমা দেখতে ভালোবাসতো, যে একটা সিনেমার মত জীবন চাইতো।


দুই গাল বেয়ে শুকনো হয়ে যাওয়া নোনতা জলের রেখাটা হাতের তালুতে ঘষে ঘষে মোছে চামেলী।


না, এখনো জীবন শেষ হয়নি তার, সে যে হ্যাপি নয়। নতুন আশায় বুক বাঁধে সে। নিশ্চয়ই জীবন নতুন কোনো এন্ড নিয়ে আসবে যেটা হ্যাপি, ঠিক সিনেমার মত।


সেই কাস্টমারটা আজও এসেছে, শালা, ছোঁয়ই না, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে চামেলীর দিকে। কি যে এত দেখে? বিরক্তি আসে চামেলীর, "মাল দাও, লুটে নাও, এইতো এজেন্ডা বাবু, আমি কি দেওয়ালে টাঙানো ছবি যে হাঁ করে গিলবে, আরে গেলার হলে খাও না বাপু, এই নাও...", নিজের অর্ধন্মুক্ত শরীরটা আরো একটু এগিয়ে দিলে, কাস্টমারটা বলে, "এসব করতে তোমার খারাপ লাগে না চামেলী?"


হাহা হেসে ওঠে চামেলী, "খারাপ লাগলে তোমার ভালোলাগত বুঝি? কেন, আমি কি তোমার বিয়ে করা বউ?"


খপ করে চামেলীর হাতটা ধরে কাস্টমার, "আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, তুমি আর এইসব কাজ করবে না, চলো আমি তোমায় স্বীকৃতি দেব!''


ভোরের আলোর সঙ্গে রোজ পাওয়া উত্তাপটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে চামেলীর। এখনও তো হ্যাপি এন্ডিং আসেনি, তার মানে জীবনটা শেষ হয়নি এখনো।


স্বপ্নালু চোখে চামেলী হাত ধরে কাস্টমারের।


একটু একটু করে হ্যাপি হচ্ছে সে।


চামেলী আবার ফুলকি হয়ে উঠেছে। সক্কাল সক্কাল উঠে পুকুরে চান করে, সাঁতরে মাঝ পুকুরে গিয়ে শাপলা তুলে আনে, স্টিলের গেলাসে অর্ধেক জল ভরে শাপলা ডুবিয়ে সাজিয়ে রাখে চৌকির পাশে। মোটা করে সিঁদুর পরে, চোখে কাজল টানে। শিশির ঘুম ভাঙা মাতাল চোখে তাকিয়ে থাকে বউএর দিকে। আদর করে।


ফুলকি কেরোসিনের স্টোভে ভাত চড়ায়, তরকারি রাঁধে, টিফিনে ভরে এগিয়ে দেয়। শিশির কাজে যায়। এই তো সুখ। সুখে সুখে ফুলে ওঠে ফুলকি। তবে এটাই কি ফুলকির জীবনে হ্যাপি এন্ডিং?


মাঝে মাঝে খুব মার কাছে যেতে ইচ্ছে করে। শিশিরকে বলে না, সব খুশি একসঙ্গে পায় নাকি সিনেমার নায়িকারা?


পেলেই তো সব শেষ, হ্যাপিজ এন্ডিং!


কিন্তু এখনই তো এন্ডিং চায়না ফুলকি, আরও যেন কিছু চায় সে, কিসের একটা তেষ্টা এখনও। ফুলকি বোঝে না।


শিশির বেরিয়ে যাওয়ার পর আবার এক পথচাওয়া শুরু, কখন ফিরবে শিশির!


সারাদুপুর পুকুরপাড়ে বসে থাকে ফুলকি, ঢিল ছোঁড়ে। কদিন যাবৎ একটা লোক আসে ঐপারে। খালিগায়ে আবলুশ গড়ন, ফুলকি আড় চোখে তাকায়।


চার দেওয়া ছিপের ফাতনা নড়ে ওঠে, ফুলকি ছিপ টেনে ধরে, মৃগেল উঠে আসে একটা, ফুলকি মাছ নিয়ে ঘরে ফেরে।


বিকেলে টেনে চুল বাঁধে, কাচা কাপড় পরে, উঠোন ঝাঁট দেয়, জল ছেটায়। তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালে, শাঁখ বাজায়।


রান্না সারে, টাটকা মাছের রগরগে ঝাল, শিশির খুব পছন্দ করে।


আজকাল আর বেশি রাত জাগতে পারেনা শিশির। সারাদিনের খাটনি শেষে ঘরে ফিরে বউএর বেড়ে দেওয়া ভাত শেষ করলেই বিছানাটা বড্ড টানে। ফুলকিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে শিশির।


ফুলকির ঘুম আসে না। একটা আবলুশ গড়ন চোখে ভাসে।


শিরশির করে ওঠে শরীর, কোমরে মৃদু ব্যথা। সাবধানে শিশিরের হাতটা নিজের গা থেকে নামিয়ে ফুলকি খিল খোলে।


বাইরে জ্যোৎস্না যেন চুঁইয়ে পড়ছে। ফুলকি পুকুর পাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। ওই তো আবলুশ, এগিয়ে আসছে, তার দিকেই।


বড্ড গরম লাগে ফুলকির। এই খোলা আকাশে এত হাওয়া, তবু গরম!


ফুলকি কেঁপে ওঠে। ঘেমে ওঠে। বুকের কাপড় সরে যায়। আঁচল লুটিয়ে পড়ে। আবলুশের আরও কাছে এগিয়ে যায় ফুলকি।


কই এখনও তো হ্যাপি হচ্ছে না সে, তবে কি পিকচারের এন্ডিং এখনও বাকি?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics