হরিহর আত্মা
হরিহর আত্মা
(১)
ছেলেটির নাম রজত। সে একটি প্রাইভেট অফিসে কাজকরে। উত্তর কলকাতার একটি গলির ভিতরে তার বাড়ি।
রজত বিয়ে করেনি আর কখনো সেই বিষয় ভাবেওনা। অনেক ছোটবেলাতে সে তার মা বাবা কে হারিয়েছে।
উত্তর কলকাতার সেই বাড়িটির মধ্যে তিন জন থাকে। তিন জন বলছি এই কারণে, কারণ রজত, ভোম্বল, আর তারবিশ্বস্ত চাকর হারু।
ভোম্বল হলো তার পোষা কুকুরের নাম। কুকুরটি তার প্রাণের থেকেও আপন। ভোম্বল ই তার কাছে সবথেকে কাছের।
মা বাবা গত হওয়ার পর সেই তার কাছে সব।
সকালবেলা রজত অফিসে চলে যাওয়ার পর ভোম্বল, হারুর কাছেই থাকে। হারুই ওর সারাদিন দেখভাল করে।
রজত সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে আসলে ভোম্বল তার পায়ের কাছে লেজ নাড়তে নাড়তে দৌড়ে আসে। যতই হোক রজত তার মনিবকে সারাদিন দেখতে না পেয়ে এই সন্ধ্যার সময় তাকে পেয়ে ভোম্বল যেনো খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।
রজত রোজ তার জন্য কিছুনা কিছু খাবার নিয়ে আসে। যেদিন আনতে পারেনা সেদিন ভোম্বলের খুব রাগ হয়। রজতের কাছে আসেনা। মুখ ঘুরিয়ে থাকে সবসময়। তারপর আস্তে আস্তে ঠিক হয়।
এভাবেই রজতের রোজকারের জীবন চলতে থাকে।
(২)
তখন বর্ষাকাল শুরু হয়েছে ঝড় বৃষ্টির দাপটে যেনো মনে হচ্ছে গোটা পৃথিবীটা ভেসে যাচ্ছে । তার সাথে পাল্লা দিয়ে বইছে ঝোড়ো হাওয়া আর মেঘের গর্জন। সারাদিন ধরে অনবরত বৃষ্টি চলতেই থাকে।
পরেরদিন সকালে রজত অফিসেও যেতে পারেনা। সেদিন ঘরেই থাকে সারাটাদিন ভোম্বল আর হারুর সাথে।
অফিসের চাপে বাড়িতে সময় দিতে পারেনা তাই গোটা দিন আজকে সে বাড়িতেই কাজকর্ম করবে। হারুর আজকে একটু বিশ্রাম।
এর মধ্যেই এক দুঃসংবাদ আসে হারুর গ্রাম থেকে। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে বন্যায় তাদের ঘর ভেসে গেছে। এই খবর পেয়ে হারু খুব কাঁদতে থাকে। সে তারপরের দিনই গ্রামে যেতে চায় তার মালিকের অনুমতি নিয়ে।
রজত আর কি করে, এমন অবস্থায় তাকে জোর করে ধরে রাখা যায়না। তাই রজত তাকে সম্মতি দেয় গ্রামে যাওয়ার জন্য। আর হতে কিছু টাকাও দিয়ে দেয় সে।
এইভাবে অনেকদিন প্রায় কেটে গেলো। কিন্তু অফিস কামাই করে রজত আর কদিন ঘরে থাকবে।
তাকে তো যেতে হবেই কাজে।
রজত হারুকে এবার ফোন করলো। কিন্তু ফোন করে জানলো সেখানে তার মা আর ভাই জলের তোরে ভেসে গেছে। তাই এখন আস্তে পারবেনা কিছুদিন সময় লাগবে।
তার বদলে আর একজনকে সে পাঠিয়ে দেবে এই কিছুদিনের জন্য।
(৩)
কিন্তু পরেরদিন হারুর বদলে যে চাকরটার আসার কথা ছিল সে কিন্তু এলোনা। রজতের এবার সত্যি মেজাজ টা বিগড়ে যায় । সে ভাবে এখন কি করবে। ভোম্বল কে একা রেখে কিভাবে সে অফিস যাবে।
কিন্তু কিছু করার নেই অফিস তাকে যেতেই হবে।
বাধ্য হয়ে ভোম্বল কে একা রেখেই তাকে অফিস যেতে হয়।
এইভাবে দুদিন কেটে যায় কিন্তু সেই কাজের লোক আর আসেনা। হারুকে অনেক ফোন করেছে রজত কিন্তু ফোনেও তাকে পাচ্ছেনা।
অত ঝড় বৃষ্টির দিনে তাদের গ্রামে ফোন না পাওয়াই স্বাভাবিক।
প্রতিদিনই প্রায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে বর্ষাকালের বৃষ্টি অত সহজে থামার নয়।
এদিকে রজতের খুব অসুবিধা হয়ে পড়েছে। ঘরের কাজ অফিসের কাজ এসব সে আর একা সামলে উঠতে পারেনা। আর কতদিন হারুর জন্য এভাবে বসে থাকবে। আর এত বৃষ্টিতে সে আসবেই কি করে এত দূরে।
খুবই সমস্যায় পড়েছে রজত।
সে এবার অন্য একজন কাজের লোককে ঠিক করার কথা ভাবলো। কিন্তু সেটাও আর পেলনা।
এভাবে কেটে গেলো আরো এক সপ্তাহ। এভাবেই কোনোরকম ভাবে চলছে রজতের। সে আর পারেনা একা সবকিছু করতে।
(৪)
এরকমই একদিন রজত রোজকারের মত অফিস যাওয়ার আগে ঘরের সবকিছু করে তারপর বেরোয়।
ভোম্বলের খাওয়া থেকে শুরু করে তার যত্ন করে তারপর সে অফিস বেরোয়। মাঝে মাঝে লাল কালিও পরে যায় এখন তার দেরি করে যাওয়ার জন্য অফিসে।
অফিসে গিয়ে তার তেমন মন বসেনা কাজে। সারাদিন ভোম্বলের কথা ভাবতে থাকে। সে কি করছে কি খাচ্ছে এসব।
তো রোজকারের মত রজত সেদিনও অফিস থেকে বাড়ি ফিরলো। ফিরেই যেনো সে অনুভব করলো ঘরটার মধ্যে কেমন একটা নিস্তব্ধ পরিবেশ।
আর তার কাজ গুলো যেনো কেউ করে দিয়েছে এসে।
বাসন পত্র, ঘর গোছানো, জামা কাপড় কাচা। সবই যেন আগের থেকে করা রয়েছে।
রজত কিছু বুঝতে পারলোনা সে ভাবলো এসব কে করে দিয়ে গেলো। এমনকি ভোম্বলের খাওয়াও হয়ে গেছে ।কিন্তু কে খাইয়ে দিল? ঘরে তো কেউ আসেনি।
এদিকে অন্যান্য দিনের মতো তার প্রাণের কুকুর টা যেনো তার কাছে আর এলোনা লেজ নাড়তে নাড়তে। বাড়িটা কেমন যেনো চুপচাপ। কিন্তু রোজকারের মত রজত তার জন্য আজকেও খাবার এনেছে। বরং এখন আরো বেশি করে আনে। সে কোনোভাবেই ভোম্বল কে কষ্ট দিতে চায়না।
রজত এবার কুকুর টাকে তার নাম ধরে ডাকতে থাকে।
কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়না।
তারপর ভোম্বল কে দেখা যায় রজতের দিকেই সে এগিয়ে আসছে । তাকে যেনো আজকে বড় অদ্ভুত দেখতে লাগছে। শরীর টা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। একটা আবছা ছায়া মূর্তি যেমন হয় ঠিক তেমন।
রজতের তাকে দেখে এবার মায়া হয়। কিন্তু ভোম্বল কোনো আওয়াজ করেনা। সে যেনো বোবা হয়ে গেছে। রজত কিছু বুজে উঠতে পারেনা।
সে ভোম্বল কে একটু আদর করে তার খাবারটা দিয়ে।তারপর জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুম এ চলে যায় ফ্রেশ হতে। তারপর রোজকারের মত নিজের কাজ করে ভোম্বল কে খাইয়ে নিয়ে, নিজেও খাওয়া দাওয়া করে একেবারে ঘুম।
(৫)
তারপর রজত আলো নিভিয়ে ঘুমোতে যায় বিছানায়। কিন্তু সে অনভব করে ঘরে যেনো আর একজন কেউ আছে। মনে হচ্ছে তার খাটের নিচে যেনো কেউ শুয়ে আছে। ঠিক হারু যেমন ঘুমাতো তেমন।
ঘরে যেনো মনে হচ্ছে সেই আগের মতই তিনটি জীব রয়েছে।
কিন্তু রজত কিছুই দেখতে পায়না। শুধু একটা নিস্তব্ধ পরিবেশের অনুভূতি পায়। রজত ভাবে তার সাথে এইসব অলৌকিক জিনিস হচ্ছে কেনো?
খানিকক্ষণ ঘুমানোর পর রাত যখন প্রায় দুটো বাজে ঠিক তখন রজত একটা গোঙানির শব্দ শুনতে পায়। মনে হচ্ছে কেউ যেনো কাঁদছে।
সে ভাবলো হয়তো তার ভোম্বল কাঁদছে। সে সাথে সাথে আলো জ্বালালো। কিন্তু কই কিছুতো নেই। ভোম্বল তো ঘুমাচ্ছে একভাবে। সে তো কাঁদছেনা।
রজত এবার আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। সে ভাবে যে সারাদিন এত কাজের চাপে হয়তো ভুলভাল শুনছে। তার মাথার ঠিক নেই।সবটাই তার মনের ভুল। সে একগ্লাস জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে।
কিন্তু খানিকক্ষণ পরে আবার সেই কান্নার শব্দ শুনতে পায়। রজতের এবার একটু ভয় হয়। সে এবার বলে ওঠে কে! কে আছো ঘরে?
কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়না। সে আবার আলো জ্বালায়। কিন্তু কিছুই দেখতে পায়না।
ভোম্বল ঠিক যেমন ঘুমাচ্ছিল সেইভাবেই ঘুমাচ্ছে একভাবে।
কিন্তু রজতের মাথায় একটা ভাবনা খেলে গেলো হঠাৎ করে। ভোম্বল তো ছোটবেলা থেকে কখনও একভাবে ঘুমায়না। সেতো অনেকবার এদিক ওদিক নড়াচড়া করে।
রাতে তো সে কোনদিন এভাবে ঘুমায়নি। সবসময় সে সজাগ থাকে।
সামান্য কিছু আওয়াজ পেলেই সে জেগে ওঠে। কিন্তু আজকে দু দুবার আলো জ্বালা হলো। রজত কে? কে? করে আওয়াজ করলো কিন্তু ভোম্বল তো একবারও জেগে উঠলোনা।
ব্যাপারটা কি! এবার সত্যি রজতের একটু ভয় হতে লাগলো। সে ধীরে ধীরে ভোম্বলের কাছে এগিয়ে গেলো।
এবং তার গায়ে হাত দিতে গেলো। কিন্তু একি! তার শরীর কোথায়?
শরীরে স্পর্শ অনুভব করতে পাচ্ছেনা কেনো সে?
শুধু তাকে দেখতেই পাচ্ছে কিন্তু স্পর্শ করতে পাচ্ছেনা। আজ কি হচ্ছে এসব রজতের সাথে। সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছেনা।
হঠাৎ! ভোম্বল উঠে দাড়ায়। কিন্তু একি! সে বাইরের দিকে যাচ্ছে কেনো এত রাতে।
রজত ভাবলো কোনো চোর ঠোর এসেছে বোধ হয় তাই ভোম্বল তাকে ধরার জন্য যাচ্ছে।
কিন্তু না বাইরে পুরো ফাঁকা চারিদিক অন্ধকার।
সেই অন্ধকারের মধ্যেই ভোম্বল আর রজত এগিয়ে যেতে থাকে।
তারপর একটা পুকুর ঘাটে এসে উপস্থিত হয়।
রজত বুঝে পায়না ভোম্বল তাকে এখানে নিয়ে এলো কেনো। রজত এবার একটু হেঁসেই ভোম্বল কে বলে " কিরে তুই আমাকে এত রাতে পুকুর ঘাটে নিয়ে এলি কেন? নিজে স্নান করার জন্য নাকি? এবার বুঝেছি তুই কেনো কাঁদছিলি তখন। এতো রাতে তোর পুকুরে স্নান করার সখ হয়েছে বুঝি?"
এদিকে তখন আর রাত নেই পূব দিগন্তে তখন হালকা সূর্যের কিরণ দেখা দিয়েছে। এইসব ঘটনার মধ্যে কখন যে ভোরের আলো ফুটেছে রজতের খেয়াল নেই।
ভোরের আলোয় ঠান্ডা বাতাসে পুকুর ঘাটে বসে থাকতে বেশ ভালই লাগছে রজতের। অনেকদিন পরে এইরকম অনুভূতি উপভোগ করছে।
তারপর আর একটু আলো ফুটতেই রজত ঘাট পাড় থেকে উঠে দাড়িয়ে বলে। "চল ভোম্বল এবার বাড়ি ফেরা যাক। বাড়ির কাজ করে আবার অফিস যেতে হবে।"
এই বলে রজত পিছন দিকে মুখ ফেরাতেই ভোম্বল কে দেখে সে একপাশ ফিরে শুয়ে আছে।
রজত আবার একটু হেঁসে বলে। " কিরে ভোম্বল তুই আমাকে সারারাত জাগিয়ে রেখে এখন নিজে পুকুর ঘাটে এসে ঘুমাচ্ছিস? চল উঠে পড় বাড়ি যেতে হবে"
এবার রজত সামনে এগিয়ে যায় তার গায়ে হাত দিয়ে তাকে ডাকতে থাকে। হঠাৎ করেই কাল রাতের কথাটা মনে পড়ে যায় রজতের।
রাতে যখন সে ভোম্বলের গায়ে হাত দিয়ে ডাকছিল কই তখনতো তার শরীর টা সে স্পর্শ করতে পারেনি। তাহলে এখন কীকরে পারছে।
রজত এবার সেটাকে স্বপ্ন ভেবে সেই কথা ভুলে যায়।
আবারো ডাকতে থাকে ভোম্বলকে। কিন্তু তার শরীরে স্পর্শ করেই রজত বুঝে যায় যে সে আর বেঁচে নেই। তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে।
রজত জোরে জোরে তাকে ডাকতে থাকে কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়না।
সত্যি সে আর কোনোদিন সাড়া দেবেন তার মনিবের ডাকে।
তখন রজত খুব জোরে কাঁদতে থাকে তাকে জড়িয়ে ধরে আর বলতে থাকে "এটা কি করে হলো তুই আমাকে ছেড়ে এভাবে যেতে পারিস না ভোম্বল। তুই উঠে পড়! ঘুম থেকে উঠে পড়!"
(৬)
এই সময় পুকুর ঘাটে দুজন মহিলা আসে, হাতে জামাকাপড় নিয়ে। কিন্তু তারা রজতের কান্না দেখে দাড়িয়ে পড়ে। তখন তারা জিজ্ঞেস করে "কি হয়েছে আপনার এরম করে কুকুরটাকে জড়িয়ে কাঁদছেন কেন?
ওই কুকুরটা কি আপনার?"
তখন রজত কাঁদতে কাঁদতেই বলে "হ্যা ও আমার প্রাণের থেকেও দামী। একটু আগে আমার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কিন্তু এখন কিভাবে এরম হয়ে গেলো বুঝতে পাচ্ছিনা"
এবার মহিলা দুটো কয়েক মিনিট চুপ থেকে বলে ওঠে "এসব কি বলছেন আপনি ওই কুকুরটা তো মারা গেছে সেই আগেরদিন দুপুরবেলা। কুকুরটা নাকি কোথা থেকে এসে এই পুকুর ঘাটের কাছে এসে খেলছিল নিজের মতো। হঠাৎ মনে হয় কোনোভাবে জলে পড়ে যায়। তারপর উঠতে না পেরে সেখানেই জলের মধ্যেই দম আটকে মারা যায়। বিকেলবেলা নাকি আমাদের ওই দাসবাবু এদিকে রোজ হাঁটতে আসেন। তখন তিনি এসে দেখেন একটা মরা কুকুর জলের ওপর ভেসে উঠেছে। তখন তিনি কুকুরটিকে ওই ঘাটের একপাশে রেখে দিয়ে চলে যান।"
এই শুনে রজতের যেনো স্মৃতি শক্তি লোপ পেতে শুরু করল। মাথা ঘুরতে শুরু করলো । সাথে সাথে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।
রজতের যখন জ্ঞান এলো তখন সে দেখলো নিজের বাড়িতে বিছানায় শুয়ে আছে। তার পাশে সেই দাসবাবু, ওই দুজন মহিলা আর একজন ডাক্তার ।
রজত সাথে সাথে উঠে বসলো। আর বলতে লাগলো "আমার ভোম্বল কোথায়? কোথায় গেলো সে? ওকে নিয়ে আসুন আমার কাছে"
তারপর রজত জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে দিলো।
এরপর কয়েকদিন কেটে গেলো ধীরে ধীরে ডাক্তারের পরামর্শে রজত ভালো হয়ে উঠলো।
এবার রজত সেদিন রাতের সমস্ত ঘটনাটা সাজাতে লাগলো।
সে ভাবলো...
ভোম্বল যদি আগের দিন দুপুরে মারা যায় তাহলে সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে কার সাথে ছিল সে। রাতে কাকে খেতে দিল রোজকারের মত। রজত ভোম্বলের সাথে রোজকারের মতোই তো ছিল কোনো সন্দেহ জনক কিছু তো তার চোখে পড়েনি।
তবে হ্যা ভোম্বল সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে কোনো আওয়াজ করেনি।কেমন একটা চুপচাপ ছিল। আগের মতো তাকে অত চঞ্চল বোলেও মনে হচ্ছিলনা। কিন্তু রাতে তাহলে কে কাঁদছিল অমন করে? কেই বা তাকে নিয়ে গেলো পুকুর ঘাটে?
সবথেকে বড় কথা ভোম্বল ঘর থেকে বেরোলো কিকরে? সে তো বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে যায় অফিস যাওয়ার সময়।
হাজারো প্রশ্ন রজতের মাথায় এখন খেলা করছে কিন্তু তার কোনো উত্তর সে খুঁজে বার করতে পারলনা।
সবকিছু যেনো রজতের মাথায় তালগোল পাকিয়ে গেলো। রজত এবার ধীরে ধীরে তার একাকিত্ব জীবনে ফিরতে লাগলো। তার আর কেউ রইলনা। হারুও আর ফিরলেন আর ভোম্বলই ছিল তার প্রাণ। এখন সেও নেই কিভাবে সে বেঁচে থাকবে এই দুনিয়ায়। আর কার জন্যই বা বাঁচবে....
(গল্পের কাহিনী এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু না
এখান থেকে গল্পের আরও একটি দিক ফুটে ওঠে।রজতের মাথায় যে প্রশ্ন গুলো ঘুরছিল এবার তার রহস্যভেদ করার পালা)
দ্বিতীয় অধ্যায়
(ভোম্বল ও হরির ফিরে আসা)
(১)
রজত এখন মাঝে মাঝে ভোম্বলের দেখা পায়। তার সাথে কথা বলে। সে কেমন যেনো একটা হয়ে পড়েছে। অফিসের চাকরিটাও চলে গেছে। সে এখন শুধু একাই থাকে গোটা বাড়িটার মধ্যে। নিজের মতোই বাড়ির কাজ বাজ করে। একদম চুপচাপ হয়ে গেছে রজত।
এভাবেই চলতে থাকে তার জীবন।
রোজকারের মতোই একদিন রজত নিজের কাজ বাজ করে রাতে খাওয়ার পর ঘুমোতে যায়। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে রজত। বাইরে আবারও ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তীব্র বাতাসের সাথে মেঘের গর্জন যেনো কোনো প্রলয় শুরু হয়েছে বাইরে।
হঠাৎ ঘরের দরজাটা নড়ে ওঠে। বাইরে ঠক ঠক শব্দ!
রজতের তৎক্ষণাৎ ঘুম ভেঙে যায়। সে উঠে বসে খাটের ওপর। সে ভাবে বাইরে এত জোরে ঝড় বইছে সেই জন্য হয়তো দরজাটা নড়ছে। সে আবার শুয়ে পড়ে।
আবার কিছুক্ষণ পর সেই আওয়াজ, এবার আর একটু জোরে আওয়াজ টা শোনা যাচ্ছে। রজত এবার বিরক্ত হয়ে আলো জ্বালে। এবার সে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে আসে। এসে আবার সে শুয়ে পরে।
আবারো সেই ঠক ঠক আওয়াজ। এবার আরো জোরে। আর এইবার দরজার আওয়াজের সাথে আর একটা গলার আওয়াজ শোনা গেলো। দরজার ওপার থেকে রজত শুনতে পেলো কে যেনো তাকে ডাকছে। "দাদাবাবু দরজা খুলুন! আমি হারু। বাইরে খুব ঝর বৃষ্টি হচ্ছে। আমাকে ভেতরে আসতে দিন।"
রজত সেটা শুনে তড়াক করে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দেয়। সে হারুকে পেয়ে যেনো কিছুটা সাহস বুকে ফিরে পায়।
তারপর নিচের দিকে চোখ পড়তেই রজতের যেনো বুক টা কেঁপে ওঠে।
রজত একটু তুতলে তুতলে বলে " তু...তু... তুমি ভো...ভো... ভোম্বলকে কো...কোথায় পে...পেলে?
ও...তো___"
আর বাকিটা সে বলতে পারলোনা। তার আগেই হারু তাকে বলে উঠলো "চলুন দাদাবাবু আগে ঘরে ঢোকা যাক তারপর সব বলছি"
হারু আর ভোম্বল এবার ঘরে প্রবেশ করলো।
হারুর সারা শরীর টা একটা কালো কাপড়ে ঢাকা। মুখটাও ঠিক মত দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এত বৃষ্টির মধ্যে সে এসেছে কিন্তু তার শরীরে একফোঁটাও জল লেগে নেই।
রজত তাকে জিজ্ঞেস করে "তুমি বৃষ্টির মধ্যে এলে কিন্তু তোমার গায়ে জল লাগেনি কেন?"
হারু জবাব দেয় "আমার গায়ে আর কোনদিন জল লাগবেনা দাদাবাবু আমি যে এখন আর মানুষ নেই। শুধু মাত্র আপনার ডাকে আমি ছুটে এসেছি আপনার কাছে। সমস্ত সত্য ঘটনা বলার জন্য। আমি আপনাকে কিছু জানাতে এসছি দাদাবাবু।"
এই শুনে রজতের মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। সে আবারও প্রচন্ড ভয় পেয়ে ওঠে।
তখন হারু তাকে ভয় পেতে বারুন করে।
আর হারু তার কথা বলতে শুরু করে রজতকে।
(২)
হারু গ্রামে যাওয়ার পর সেখানে তার মা আর ছোটো ভাই জলের তোরে কোথায় ভেসে গেছে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়না। মাতলা নদীর জল সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। সেই দুঃখে হারু খুব ভেঙে পরে কান্নায়। সেই অকাল বৃষ্টির মধ্যে হারু বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকে তার মা আর ভাইয়ের খোঁজে। কিন্তু কোথায় পায়না তাদের।।
হারু আরো বলে যে তার বদলে যে লোকটাকে কাজে পাঠানোর কথা ছিলো সেও মাতলা নদীর বুকে জলের তোরে ডুবে মারা গেছে।
এই বৃষ্টিতে সারাদিন ঘুরে ঘুরে হারুর খুব জ্বর হয়। সে বিছানা থেকে উঠতে পারেনা। হারু বুঝতে পারে তার সময় আর নেই। ওই অবস্থায় আর ডাক্তার বদ্যি সেখানে পাওয়া খুবই দুষ্কর।
তারপর হঠাৎ একদিন হারু সেই জ্বরে মারা যায়।
কিন্তু তার শরীরটা শেষ হয়েছে ঠিকই তবে তার আত্মা শান্তি পায়নি। তার মনিবের ডাকে সে আবার ফিরে আসে মনিবের কাছেই।
রজত অফিস থেকে ফিরে যে দেখতো ঘরের সব কাজ করা সেটা হারুই করে রাখতো রোজকারের মতোই আগে থেকেই
কিন্তু হারু রজত কে দেখা দিতে চায়নি কারণ সে ভয় পাবে বলে। আজ সে বাধ্য হয়ে রজতের কাছে ফিরে এসছে সমস্ত ঘটনার রহস্যভেদ করতে ।
এবার রজতের অত ভয় করছেনা তার থেকে বেশি যেটা হচ্ছে সেটা হলো কষ্ট।
রজত তাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে "তুমি বাড়ির কাজ করে দিয়ে যেতে আগের মতোই তাও আমকে জানাওনি দেখা দাওনি। তুমি তোমার মনিবকে এত ভালোবাসো যে মৃত্যুর পরেও তুমি ফিরে এসেছিলে আমার কষ্ট দেখে!"
তখন হারু উত্তর দেয় "আজ্ঞে দাদাবাবু আপনার এবং ভোম্বলের সেবা করাই ছিল আমার পরম ধর্ম। আপনার মত ভালো মানুষ আর হয়না। আপনাকে সেই ছোট বেলা থেকে আমি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। আপনার বাবা মশাই আর মা ঠাকুরান চলে যাওয়ার পর সব দায়িত্ব আমি বহন করেছি নিজে হাতে। তাই আমি মরে যাওয়ার পরেও আমার আত্মা শান্তি পায়নি। মৃত্যুর পরেও আপনার যে সেবা করতে পেরেছি এবার আমি মুক্ত হতে পারবো।"
এইবলে হারু থামে
(৩)
এবার রজত বলে ওঠে "তাহলে ভোম্বল! ওকে তুমি কোথায় পেলে অত আর নেই এই পৃথিবীতে।"
হারু বলে এটাই আসল কথা আপনাকে সেটাই এবার বলতে চাই।
সেই কালো কাপড়ে মোড়ানো হারুর কথা শুনে যা জানা গেলো তা হলো এইরকম__
হারু গ্রামে চলে যাওয়ার পর সবকিছু রজতকেই করতে হতো। তারপর থেকে রজত যখন ভোম্বল কে একারেখে অফিসে চলে যেত ।তখন ভোম্বল খুব মনমরা হয়ে থাকতো। সে নিজের মনে কাঁদতো। কাউকে কিছু বোঝাতে পারতোনা। একা একা ওই ঘরের মধ্যে তার দম আটকে আসতো। সবসময় বাইরে বেরোতে চাইতো। কিন্তু রজত তো তালা দিয়ে যেত তাই সে বেরোতে পারতোনা।খুব কষ্ট পেতো ভোম্বল।
তারপর হারু মরে যাওয়ার পর সেই কষ্ট আর না দেখতে পেয়ে সে এখানে এসে উপস্থিত হয়। তখন ভোম্বলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে খুব জোড়ে জোড়ে চিল্লাতে থেকে।
রোজকারের মত হারুর সাথেই ভোম্বল থাকতো সারাদিন বাড়িতে।
এরকমই একদিন দুপুরে ভোম্বল বাইরে যাওয়ার জন্য চেঁচামেচি করতে শুরু করে। বাইরের উঠোন টার সামনে। এই দেখে হারুর মনে মায়া জন্মায়। তারপর সেই তালা লাগানো গেট খুলে দেয় হারু। ভোম্বল বাইরে বেরিয়ে যায়। কিন্তু এটাই যে তার শেষ বেরোনো হবে কে জানত।
এবার হারু তাকে গেট খুলে দিয়ে নিজের কাজে মন দেয়। হারু ভাবে সে হয়তো এখানেই আছে কোথায় আর যাবে। তাই নিজের কাজ করতে থাকে আবার।
কিন্তু হঠাৎ ভোম্বল কে আর দেখতে পায়না হারু। সে সাথে সাথে এদিক ওদিক দেখতে বেরোয় কিন্তু দেখতে পায়না তাকে।
এদিকে ভোম্বল খুব মজা পেয়েছে ছাড়া পেয়ে। নিষ্পাপ কুকুরটি খেলতে খেলতে কখন যে সেই পুকুর ঘাটে গিয়ে পৌঁছেছে তার কোনো হুঁশ নেই।
হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায় জলে। তারপর প্রাণপণ অনেক ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু উঠতে পারেনা। জলের মধ্যেই হাবুডুবু খেয়ে মারা যায় ভোম্বল।
এদিকে হারু যখন তাকে দেখতে পায় তখন সব শেষ। ও দেখে যে ভোম্বল ওই ঘাটের পাসে মরে পড়ে রয়েছে। কেউ মনে হয় ওকে জল থেকে তুলে ওখানে রেখে দিয়েছে।তখন আর কিছু করার নেই!
তারপর থেকে আরু আর ভোম্বল মারা গিয়েও তার বাসভূমি ছেড়ে যায়নি তারা তার মনিবের কাছেই থেকে যায়।
সব কথা শুনে আর ঠিক থাকতে পারেনা রজত তখন সাথে সাথে মাথা ঘুরে পরে যায় মাটিতে এবং জ্ঞান হারায়।
কিন্তু সে জ্ঞান আর আসেনা কোনদিন ফিরে।
সবশেষে দেখা যায় তিনজন হরিহর আত্মা একসাথে সেই অঝোরা বৃষ্টির রাতে কোথায় যেনো চিরকালের মতো বিলীন হয়ে যায়!
তারপর দিন আশপাশের লোক রজতের মৃতদেহ বাড়ির মধ্যে থেকে উদ্ধার করে। পুলিশ আসে ।
কিন্তু মৃত্যুর কারণ হিসাবে বলা হয় যে অতিরিক্ত রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার জন্য রজতের মৃত্যু হয়।
সমাপ্ত।।
___________________***_______________

