হৃদয়ের দেহ বিচ্ছেদ
হৃদয়ের দেহ বিচ্ছেদ


অখিল আজকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে। তাদের পাড়াতেই একটা বিয়ের অনুষ্ঠান রয়েছে। তার বাড়ি থেকে 8-10 বাড়ি পরেই অমরেশ সেনের মেয়ের বিয়ে। অন্য দিন অফিস থেকে ফিরতে প্রায় দশটা বেজে যায়। আজকে কোনোক্রমে বলে-কয়ে একটু আগে অফিস থেকে বেরিয়ে সাড়ে আটটার মধ্যে ঢুকতে পেরেছে। এই সময় কাজের প্রচণ্ড চাপ। তাই বেরোনো খুব কঠিন ব্যাপার।
অমরেশ সেন একটা বেসরকারি অফিসে পিয়নের কাজ করতেন। খুব বেশি মাইনে পেতেন না। তাই দিয়ে সংসার চালিয়ে এক ছেলে আর মেয়েকে মানুষ করেছেন। ছেলে কাজের জন্য এখন বাইরে থাকে। বোনের বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে এসেছে। এখনকার বিয়ের আয়োজন মানে প্রচুর খরচ। তার পক্ষে এত খরচ করা অসম্ভব ব্যাপার। তবু নিজের যা জমানো পয়সা ছিল আর ছেলের কাছ থেকে নিয়ে তার সাধ্যমতো আয়োজনে চেষ্টা করেছেন।
সারাদিন তার বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর আনাগোনা চলছে। উৎসব বাড়ি হলে যা হয় আর কি। সন্ধ্যেবেলায় সারা বাড়ি আলোর বন্যায় ভরে গেল। রাত যত বাড়তে থাকল নিমন্ত্রিত অতিথিদের আনাগোনা বেড়ে গেল।
একদিকে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন আর অন্যদিকে বিয়ের মন্ডপ। সবদিক সামলাতে গিয়ে অমরেশ বাবু হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। তবুও নিজেদের কিছু লোক দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার জন্য কষ্ট কিছুটা লাঘব হচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া চালু হয়ে গেছে। এদিকে বিয়ের মণ্ডপেও বিয়ের কার্যক্রম চালু হয়ে গেছে। সেখানে সময় দিতে হচ্ছে অমরেশ বাবুকে।
অখিল বিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। অমরেশ বাবুকে ব্যস্ত দেখে তাকে আর ডাকলো না তখন। সে সোজা চলে গেল যেখানে খাওয়ার অনুষ্ঠান হচ্ছে সেখানে। এই কাজটা আগে সেরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। পরে না হয় অমরেশ বাবুর সঙ্গে দেখা করবে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে আসলে অনেক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়। আজকের দিনে অখিলের সঙ্গে একই ঘটনা ঘটেছে। অফিসের চাপে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। আত্মীয় স্বজনদের কথা তো বাদ পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঠিকঠাক দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। আজ অনেক পরিচিতদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে।
খাবার টেবিলে বসে কয়েকজনের সঙ্গে অনেক গল্প হল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই তো আর চলে যাওয়া যায়না। তাই একটু বসার সিদ্ধান্ত নিল অখিল। ওদিকে বিয়ের কার্যক্রম প্রায় শেষ। লগ্নটা অনেক আগে থাকায় হয়তো সকাল সকালে কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। না হলে বিয়ের কাজ শেষ হতে সাধারণত অনেক রাত হয়। সেরকম হলে অখিল এতক্ষণ থাকত না।
বাইরে গিয়ে একটু এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করলো। অনেকের সঙ্গে গল্পগুজব হচ্ছে। এরকম সময় অনেকদিন পায়না বলে বাড়ি যাবার আর ইচ্ছা করছিল না তার। আর কাছেই তো বাড়ি না হয় একটু দেরি হবে।
হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ শুনতে পেল অখিল। বিয়ের অন্তিম সময় কান্নাকাটি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। মেয়ের বিদায় বেলায় বাবা-মায়ের যে অবস্থা হয় তা মনে পড়লে অখিলের। বিয়েবাড়ির পরিবেশটা এখন ভার হতে শুরু করেছে। একটা বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভারাক্রান্ত পরিবেশ।
অখিল একবার ভিতরে ঢুকলো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাবা মা খুব কান্নাকাটি করছে। আর মেয়েও তাই। অমরেশবাবুর কাছে তার মেয়ে ছিল চোখের মণি। তাকে বিদায় দিতে তাই তার বুক ফেটে যাচ্ছে। তিনি যেন তাঁর হৃদয়টাকে শরীর থেকে বের করে তুলে দিচ্ছেন মেয়ের হাতে। যেটা নিয়ে সে চলে যাবে অন্য কোথাও।
সমাজের এক চিরাচরিত রূপ ধরা পড়ল অখিলের চোখে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল সে।