হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ৪
হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ৪


৪
নৌকায় উঠে বসেছে মনা সপরিবারে, আজ আর মনা নিজের হাতে বৈঠা নিতে পারে নি। মনার মন খালি বলছে যেন সব হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে। রমজান আলির লগির ঠ্যালায় দুলে উঠলো নৌকা, বৈঠায় টান মারতেই কোথা থেকে দৌড়তে দৌড়তে ন্যাপলাও এসে চড়ে বসলো নৌকায়, ঘোষণা করলো, "আইজ খুইশারাও গেসে গা, ভুরব্যালা।" পাটাতনে সবাই বসেছে, সবারই নির্বাক মুখ ফেরানো পাড়ের দিকে। মনা রমজান আলির কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে তখনো, হালে আজ ন্যাপলা। ধীরে ধীরে মনার চোখে ঝাপসা হয়ে আসছে সবুজে সবুজ ফুলবাইড়া..... নান্নার, তার প্রিয় মানিকগঞ্জ। ওদের গন্তব্য নারায়ণগঞ্জ। ওখান থেকে গোয়ালন্দগামী স্টিমারে চড়ে গোয়ালন্দ, তারপর রেলের গাড়ী চড়ে কোলকাতা, এক অচেনা অজানা দেশের অপরিচিত গন্তব্যভূমিতে হয়তোবা অনিশ্চিত অনির্দিষ্টেরই এ যাত্রা।
নৌকা এগোচ্ছে, নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ঘাটের দিকে। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ফুলবাইড়া...
নান্নার। একটি গাঢ় সবুজ রেখা শুধু দিগন্তে যেখানে আকাশ মিশেছে ধলেশ্বরীর পাড়ে, তার বিভাজিকা হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো ফুলবাইড়া.... নান্নার.... দূরের মানিকগঞ্জ হোলো অদৃশ্য দৃষ্টিপথ থেকে।
মনার চোখের কোল বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়াচ্ছে তখনও। ইন্দুর মুখ ঘোমটায় ঢাকা, তার চোখ-মুখের ভাব দেখা গেলো না। ইন্দুর বড়ো জা দুই হাতে মাথা ধরে অদ্ভুত নির্লিপ্ত অসহায় এক ভঙ্গীতে বসে আছে। মনার যে পিসি কথায় কথায় ডাক ছেড়ে বিলাপ করে, সে পিসিও হতভম্ব চুপ, কোটরাগত চোখের কোলে টলটলে দু'ফোঁটা জল ঝরে পড়ার অপেক্ষায়, যেন বুঝে উঠতে পারছে না কী ঘটছে! মনার তিন মেয়ে রমলা, কমলা, বিমলা আর মনার বড়দাদার ছোটছেলে মানিক আর মেয়ে মায়াও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নীরবে বসে আছে। শিশুগুলির কোনো আন্দাজ নেই ঠিক ঘটে চলেছে।
মনার বড়দাদা এবার মনার উদ্দেশ্যে বললো, "ওই মনা, এম্নে কান্দস ক্যা? কয়দিন অইলেই তো ফিরা আইয়া পড়ুম অনে? দুঃখু পাইস না। আমু আমরা ফিরা আমোগো দ্যাশেই, দেইখস্। মুইস্যা ফালা চক্ষু, পোলাপাইনেরা ডরাইবো না? তরে এম্নে কাইনতে দ্যাখলে? ন, চক্ষু মুস্!" নিজের কাঁধে ফেলে রাখা গামছাটা এগিয়ে দেয় মনার বড়দাদা। এতক্ষণ নীরব ছিলো অশ্রু বিসর্জন, এবার মনা আর পারলো না, বড়দাদাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আর এতক্ষণ পাষাণ সেজে থাকা বড়দাদার চোখের জলও মনার বাবড়ি ঝাঁকড়া চুল ভেদ করে মনার কাঁধে ঝরে পড়তে লাগলো। যে যতই মুখে একজন আরেকজনকে স্বান্তনা দিক, মনে মনে সবাই সন্ত্রস্ত, নিজস্ব ভবিষ্যৎ আশঙ্কায়। একদিনের একবেলার মধ্যেই যে সব ওলটপালট, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার সময়টুকু পর্যন্ত পায় নি কেউ।
শ্রাবণের ভরা বর্ষার ধলেশ্বরীতে রমজান আলি আর ন্যাপলা সাবধানে দাঁড়-বৈঠা টানছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে নদীর স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে। ছইয়ের তলায় ক্ষুধা তৃষ্ণা বিষাদে অবসন্ন শিশুগুলি ঝিমোচ্ছে। ইন্দু, ইন্দুর বড়ো জা আর পিসির মুখ দেখে তাদের মনের মধ্যেকার ঝড়ের গতি বোঝার উপায় নেই। মনা দুই হাঁটুতে মুখের থুতনি রেখে একদৃষ্টে ধলেশ্বরী নদীর রৌদ্রোজ্জ্বল সোনাঢালা জলের দিকে চেয়ে। মাঝে মাঝেই মেঘের আড়ালে পাল্টে যাচ্ছে ধলেশ্বরীর রূপ। বড়দাদা রমজান আলির পিছনে বসা।
ঐ বুঝি দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ঘাট, ঐ দূরে ধূ ধূ, কালো কালো রেখার মতো দেখা যায় বুঝি। ধলেশ্বরীর বুক বেয়ে মনাদের নৌকা এগোচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ঘাটের দিকে।
নারায়ণগঞ্জ ঘাটে পৌঁছে মনারা শুনলো আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঁদপুরের দিক থেকে আসছে গোয়ালন্দগামী সেদিনের শেষ স্টিমার। নিজেদের নৌকা রইলো নোঙ্গর করা। মনা আর তার পরিবারের সবাই, বড়দাদার পরিবারের সকলে পিসিকে নিয়ে স্টিমার ঘাটের একধারে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজেদের সব পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে। আবাল্যের গল্পে শোনা মনার স্বপ্নের স্টিমার নিয়ে আজ আর মনার মনের মধ্যে কণামাত্র উচ্ছ্বাসও অবশিষ্ট নেই। রমজান আলি আর ন্যাপলা গেছে টিকেটের সন্ধানে। নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে ওরা দেখলো ওদের মতোই কাতারে কাতারে পরিবার পোঁটলা পুঁটলি বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে চলেছে এক অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে, কেউই জানে না, এরপর কী হবে? দিশাহারা ছলছলে জলে ভরা লালচে চোখে আর ধরা ধরা গলায় সমব্যাথায় কাতর মানুষগুলি অসহায়ের মতো হতাশাভরা গলায় এর ওর সাথে কথা বলে বুঝতে চাইছে যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন অনির্দিষ্ট অদূর ভবিষ্যৎকে।
স্টিমার এসে ভিড়েছে ঘাটে, লোকজনের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। বেশী সময় হাতে নেই, স্টিমার ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়ি করে লোকজন লোকারণ্য স্টিমারে উঠছে। মনাও কোনোরকমে ঠেলাঠেলি করে ইন্দু আর মেয়েদের তুলে দিয়ে নিজেও উঠেছে। বড়দাদা আর ন্যাপলা ধরাধরি করে পিসিকে তুলেছে। এবার বড়দাদার পরিবারের স্টিমারে ওঠার মুখে বড়দাদার ছেলে ভিড়ের চাপে উল্টে পড়ে গিয়ে হাত পা কেটে ছড়ে গেলো, সামনের দাঁত ভেঙে ঠোঁট কেটে অঝোরে রক্ত পড়ছে। মনা চেষ্টা করেও নামতে পারছে না। ভিড়ের চাপে ঠেলা খেয়ে স্টিমারের আরো ভিতরের দিকে ঢুকে গেলো। মনার কাঁধে বসানো কমলা - বিমলা ছোট্ট ছোট্ট মুঠিতে বাবার চুল খামচে ধরে আতঙ্কে তারস্বরে চিৎকার করছে। ভিড়ে যাতে আলাদা না হয়ে যায়, তাই ইন্দু বুদ্ধি করে রমলার আর পিসির আঁচল নিজের কাপড়ের আঁচলের সাথে শক্ত করে গিঁট দিয়ে বেঁধে নিয়েছে। টাল সামলাতে না পেরে বুড়ি পিসি রমলাকে বুকে জড়িয়ে ইন্দুর পায়ের কাছে ডেকের পাটাতনের উপর উবু হয়ে বসে পড়েছে। পোঁটলা পুঁটলিগুলি কতক ইন্দুর কাঁখে কাঁধে, কতক পিসির আর রমলার কোলে। ইন্দুর মাথার উস্কো চুল উড়ছে বাতাসে, জবাফুলের মতো লাল দু'টি চোখ, দাঁত চেপা শক্ত চোয়াল, ইন্দুর মাথা থেকে ঘোমটা খসে পড়েছে কখন! কালো কালো মাথার ভিড় টপকে ইন্দুর নজর চলছে না পাড়ের দিকে। এইসময় ইন্দুর মনে এলো ক'বছর আগে বাপেরবাড়ি গিয়ে বেতারে শোনা নেতাজীর ভাষণ। ইন্দুর টকটকে লাল শুকনো চোখদুটো হুহু করে জ্বলছে, যেন লঙ্কাবাটা ডলে দিয়েছে কেউ।
বড়দাদা ছেলেকে সামলে তার পরিবার নিয়ে কিছুতেই উঠতে পারছে না স্টিমারে। ভিড়ের চাপে এগোতেই পারছে না স্টিমারে ওঠার সিঁড়ি পর্যন্ত। রমজান আলি আর ন্যাপলা আপ্রাণ চেষ্টা করছে কোনোক্রমে ভিড় ঠেলে সরিয়ে নিরাপদে ওদের এগোনোর পথ করে দিতে। কিন্তু ওরা বিফল হোলো, এই স্টিমারে আর যাত্রী তোলা হবে না, যাত্রী বেশী হয়ে গেছে। স্টিমারের সিঁড়ি সরিয়ে রেলিঙ টেনে দেওয়া হোলো। মনার আর মনার বড়দাদার কাতর অনুনয় কেউ শুনলো না, আবেদন পৌঁছলো না কারোর কানে। ভিড়ের মধ্যে চিৎকারে কেউ কারোর কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছে না, শুনতে পাচ্ছে না কেউ কিচ্ছু স্পষ্ট করে। শুধু কোলাহল আর কোলাহল! তারই মাঝে এক হৃদয়বিদারী জোরালো ভোঁ দিয়ে স্টিমার দুলে উঠলো। পাক খেয়ে উঠলো সকলের ভাঙাচোরা রক্তক্ষরিত মনের মধ্যে সেই "ভোঁ-ওওওওওওওও....."
চারিদিকের কান্নাকাটি কোলাহল ছাপিয়ে আরেক হৃদয়বিদারক চিৎকার "ভাই-ই-ই-ই".... মনার গলা স্টিমারের ডেক পাটাতন ইঞ্জিন চুঙিতে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার মনার কাছেই ফিরে এলো, নাকি ঘাটে বিচলিত হয়ে দাঁড়ানো বড়দাদার গলার ডাক এসে মনার কানে পৌঁছলো, তা মনা বুঝলো না। মনা শুধু শুনতে পেলো সেই ডাক..... হৃদয়বিদারক আকুল ডাক, "ভাই-ই-ই-ই"! সে ডাক যেন বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ছুঁয়ে উড়ে মিলিয়ে গেলো মানিকগঞ্জ, নান্নার, ফুলবাইড়ার মাটির দিকে, গায়ে মনার বুক ভাসানো নোনা জলের বাতাস মেখে, উদাসী হয়ে।
হেলেদুলে ঢেউয়ের তালে স্টিমার এগোচ্ছে রাক্ষসী পদ্মার বিপুল জলরাশিতে, মনাকে নিয়ে অনির্দেশের পথ পাড়িতে। মাথার উপর দূর আকাশে বাসায় ফিরতি পথে উড়াল দেওয়া গাঙচিলেরা, আর পিছনে চলে যাচ্ছে ধীরগতিতে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটার মাটি, নদীতে নদীতে ঘিরে থাকা মনার জন্মভূমির মাটি, মনার পিতৃ-পিতামহের ভিটার মাটি, মায়ের হাতের তৈরী নকশি কাঁথার মতো বিছিয়ে থাকা 'শস্য শ্যামলা সুজলা সুফলা' মনার দেশের মাটি। মনা ইন্দু চলেছে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে।
******
"দিদমা, ও দিদমা, দিদমাআআআ গ, কিস্যু কওনা কেইর লিইগ্যা?" কঁকিয়ে উঠলো গোপাল গোবিন্দ দুই ভাই। মাথাভরা রুখু চুল আরও রুখু, চোখে রাত্রি জাগরণের রক্তিমাভা ছাপিয়ে টকটকে লাল চোখ সত্যিই রক্ত ঝরাবে বোধহয় এবার। আবারো বৃদ্ধা ইন্দুবালার গায়ে ধাক্কা দিয়ে পাষাণভাঙা চিৎকারে চারিদিক সচকিত করে তুললো গোপাল গোবিন্দ, "দিইইদমাআআ..."! আগের রাত থেকে না খাওয়া, না দাওয়া, না ঘুম। মাঝে একবার দু'ঢোঁক জল শুধু। নব্বই পার হওয়া বৃদ্ধা, নিজের বয়সের হিসেব নিজের কাছেই তার ছিলো না। ছিলো শুধু একবুক বেদনা, দেশভাগের বেদনা, দেশ ছাড়ার অব্যক্ত যন্ত্রণা। প্রায় একশো ছুঁই ছুঁই বয়স বৃদ্ধা ইন্দুবালার, লোকের তাই অনুমান। সব হারিয়ে ফেলেছে, ঘর সংসার, স্বামীর পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি, এমনকি দেশের নাগরিকত্বটুকুও। স্বামীর হাত ধরে, সন্তানদের বুকে করে নিয়ে তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো এসে আশ্রয় নিয়েছে পরভূমে। দেশভাগের ফসল। একটা দেশ তখন তিন টুকরো। যে টুকরোয় ইন্দুবালার জন্ম কর্ম সংসার ধর্ম ছিলো, তা রাতারাতি পরের হলো। আর নিজের ভূমি ছেড়ে এসে আশ্রয় নিলো দেশের যে টুকরোয়, তাতো ইন্দুবালার পরভূম হয়েই রইলো আমৃত্যু।
গোপাল গোবিন্দ দিদিমার মৃতদেহের পাশে দিশেহারা দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে। জানে না কী করণীয়। জ্ঞান হওয়া ইস্তক দিদিমাই ওদের সব। কবেই যে ওদের সব আপনজনেরা ইহলোকের মায়া কাটিয়েছে। কেউ অনাহারে, তো কেউ রোগে ভুগে, বিনা চিকিৎসায়। কেবলমাত্র রয়ে গিয়েছিলো দুই অনাথ নাতি গোপাল গোবিন্দকে বুকে আঁকড়ে বৃদ্ধা ইন্দুবালা। আজ সেও চলে গেলো ওদের মায়া কাটিয়ে। নাকি ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে, অপমানে? এর উত্তর গোপাল গোবিন্দর কাছে হয়তো নেই, তবে যে দেশের টুকরোটায় আশ্রয়প্রার্থী ছিলো সপরিবারে ইন্দুবালা, সেই দেশ ও তার জনগণের কাছে আছে কি? সম্পন্ন গৃহবধূ কেন বাধ্য হয়েছিলো আক্ষরিক অর্থেই হতে পথের ভিখারিনী? কে দেবে সেই উত্তর? সাত-সাতটি দশক যে দেশের ধূলোমাটি গায়ে মেখে এক ছিন্নমূল উদ্বাস্তু বৃদ্ধা রমণী ভিক্ষাবৃত্তি করে দিনাতিপাত করেছে, কখনো দু'মুঠো ভাতের বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করেছে, ন্যূনতম সরকারি সাহায্যের আশ্বাসটুকু পর্যন্ত না পেয়েও, সেই দেশটাকেই নিজের নিরাপদ আশ্রয় ভাবতে চেয়েছে... সেই দেশ কি ইন্দুবালাকে সেই মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পেরেছে? শুধু কয়েক টুকরো কাগজের ওপরে কয়েকখানা শিলমোহর ছিলো না ইন্দুবালার পরিবারের হাতে, কিন্তু এই দেশটায় যে তারা ছিলো সেই ১৯৪৭ সাল থেকে, তার কোনো প্রমাণ ইন্দুবালারা দেখাতে পারে নি। তাই এই দেশটার মাটিতেও তাদের আর কোনো অধিকার জন্মায় নি। স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে ফুটপাতে ঘুরে ঘুরে ইন্দুবালার পায়ের তলার চামড়া ক্ষয় হয়েছে পেট ভরানোর তাগিদে, কিন্তু সহায় সম্বল না থাকায় নাম ওঠাতে পারে নি এনআরসি তালিকায়। শেষ নিঃশ্বাসও ছেড়ে গেলো আজ ইন্দুবালাকে।
সরকারি অফিসারবাবুটির তৎপরতায় ইন্দুবালার সৎকারের ব্যবস্থা হলো চাঁদা তুলে। গোপাল গোবিন্দ চিতায় পুড়তে থাকা দিদিমার দেহের দিকে উদাস চেয়ে। জানে না এরপর ওদের ভাগ্যে কি আছে? কেউ নেই ওখানে শ্মশানের মড়িপোড়া ডোমটা ছাড়া। চিতা ঠাণ্ডা করতে হবে। ডাকলো ওদের ডোম। তখনো চিতা থেকে পাক খেয়ে খেয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে, আর পুবমুখী হাওয়ায় মিশে ভেসে চলে যাচ্ছে সেই ধোঁয়া ইন্দুবালা জন্মভূমির দিকে। কারুর আর সাধ্য নেই ইন্দুবালাকে এনআরসি তালিকাভুক্ত করে এই দেশের নাগরিক ঘোষণা করবে। দেশকালের গণ্ডী বড়ো গৌণ এখন ইন্দুবালার হৃদয়ে দেশভাগের দগদগে ক্ষতর বিরামহীন ক্ষরণে। সেই ক্ষরণে সামান্যতম প্রলেপের অবকাশ অভিমানী ইন্দুবালা এই অহঙ্কারী দেশটাকে দিতে চায় নি হয়তোবা আর, কিছুতেই! এনআরসি তালিকা মুবারক... বলে গেলো হয়তো ইন্দুবালা যাবার বেলায়। কে জানে?
(ডিসক্লেইমার:- প্রিয় পাঠক পাঠিকাবৃন্দ, আমার দাদামশাই-দিদিমার মুখে শোনা তাঁদের স্মৃতির ভাঁড়ার থেকে, তাঁদের চাক্ষুষ দেখা শিকড় ছেঁড়ার অমূল্য অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। প্রায় পাঁচ দশক আগে শোনা, বাহাত্তর বছর আগের আবেগতাড়িত এ বিবরণ। কল্পনার মিশেলে গল্পাকারে রূপান্তরের সময়, এই কাহিনী বিন্যাসের বা অন্য কোথাও যে কোনো ত্রুটি থেকে থাকলে তা আপনারা নিজগুণে ক্ষমা করবেন, এইই আশা।)