হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ২
হৃদয়ে দেশভাগ (ধারাবাহিক) ২
২
বাবা-মা বলতে মনার মনে পিসির মুখে মুখে শোনা কথায় আঁকা অস্পষ্ট এক ছায়ামাত্র। আর মনা পায় মায়ের হাতের ছোঁয়া মায়ের নিপুণ হাতে সেলাই করা নকশি কাঁথাগুলির ওমের মধ্যে। এছাড়া মনাকে ভীষণ ভালোবাসে ওর বৈমাত্রেয় বড়দাদা। তবে মনা বড়দাদাকে ডাকে ভাই বলে, কারণ বড়দাদা কনিষ্ঠ বাকী চার ভাইকে নাম ধরে ডাকলেও মনাকে ডাকে ভাই বলেই, মনাও পাল্টা ভাই বলেই ডাকে। বড়দাদা মনাকে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে অনেক বোঝায়, "অহন তো কাম-কাজ করনের দরকার, অহনে তো তুমি ডাঙ্গর অইসো ভাই।" খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে মনা উত্তর দেয়, "ভাই, আমি কইলে নৌকা বানানের কামই করুম হুদা, আর বাইচ খেলনের সুমে কইলে তুমি আমারে আটকাইতে পার্বা না।" বড়দাদা ভূপেন মেনেই নিলো মনার আব্দার, উদ্দেশ্য একটাই.... মনা কাজে তো চলুক আগে!
পরদিন সকালে দুধের সর জ্বাল দেওয়া ঘি দিয়ে গরম সিদ্ধভাত খেয়ে শুরু হোলো মনার কর্মজীবন। ভূপেন, উপেন, যোগেন, নগেন আর নারান - এর সঙ্গী হোলো মনাও। কারখানায় মন টিকছে না মনার, তবু ভাইকে দেওয়া কথা রাখতে মনা দাদাদের কাছে চিনছে করাত, হাতুড়ি, বাটালি, রাঁন্দা, ক্যারামপিস (ক্র্যাম্প পিস), আরও নানান যন্ত্রপাতি। একবার এ কর্মচারী তো পরক্ষণেই অন্য কর্মচারীর পাশে বসে ঝুঁকে পড়ে তাদের কাজের আগাপাশতলা বোঝার চেষ্টা করছে। আবার কখনো বড়দাদার পাশটিতে বসে দেখছে ইঞ্চি ফুট গজের হিসেব করা স্লেটে আঁক কষে কষে। অবাক বিস্ময়ে দেখছে বড়দাদার গদি সামলানো, খদ্দেরদের সাথে আদান-প্রদান, মহাজনের সাথে আলাপ আলোচনা। তবে মনার মন কিন্তু ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার বাঁকে বাঁকে।
মাসকয়েক পার হতেই মনা এবার ভালোবাসতে শুরু করেছে কাজটাকে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, "মনা দ্যাশের (দেশের) হগ্গলের থন (সবচেয়ে) বড় নৌকাডা বানাইছে, ঠিক ভাইয়ের মুখে শোনা ইস্টিমারডার (স্টিমারটার) লাহান (মতোই) বড়ো দীঘল নৌকা।" একদিন মনা বসে বসে দেখতে দেখতে মাইঝ্যা (মেজো) দাদার কাজের অবশিষ্টাংশ বেশ নিঁখুতভাবেই শেষ করে ফেললো। পরের দিন সাইঝ্যা (সেজো) দাদার অর্ধেক করে রাখা নকশা সুন্দর করে শেষ করে রাখলো, দাদার দুফোইরা খাওনের সুমে (দুপুরের খাবার সময়)। এভাবেই মনার হাতেখড়ি, না না, হাতেবাটালি হয়ে গেলো। অনেক চেষ্টা করেও মনার ভাই মনাকে পাঠশালায় পাঠাতে পারে নি। তবে নিরক্ষর মনা কিন্তু খড়িপেন্সিল বা কাঠপেন্সিল দিয়ে কাঠের তক্তার ওপর ভারী সুন্দর ফুল লতাপাতা, সিংহের মুখ-থাবা, পেখমধরা ময়ূর, বাসুকির ফণা... দিব্যি ফুটিয়ে তুলতে পারে। তারপর সেই নকশার দাগে দাগে বাটালি দিয়ে খোদাই করে জীবন্ত করে তুলতে পারে তার আঁকা নকশাদের। আসলে জাত শিল্পী, রক্তে কাঠের কারুশিল্প। ধীরে ধীরে মনার মন বসে গেছে চারচালা টিনের পৈতৃক কারখানা ঘরের কোণে। তবে মাঝেমধ্যে কোথাও নৌকাবাইচের খবর পেলেই হোলো, মনা সেখানে হাজির, নিজের নৌকা আর শাগরেদ খুইশা, ন্যাপলা আর রমজান আলিকে নিয়ে। মনা বোধহয় নৌকাবাইচ খেলায় হারতে শেখে নি, মেডেলে মেডেলে তার ভাইয়ের (বড়দাদার) ঘরের মেহগনি কাঠের আলমারির একটা তাক ভর্তি হয়ে উঠেছে।
দিন চলছে মসৃণ গতিতে। মনার বয়স উনিশ পেরিয়ে কুড়ি। মনার বিয়ের ঠিক হয়েছে, বুড়িগঙ্গার পাড়ের মেয়ে এগারো বছরের ইন্দুবালার সঙ্গে। শুভ দিনে বিয়েও হয়ে গেলো। তারপর ইন্দু তার বাপের বাড়িতে। আর মনা ডুবছে কাজের নেশায়। মনার হাতের কাজের, মনার বানানো বাইচের নৌকার ভারী নামডাক হয়েছে। সাভারের, এমনকি ঢাকা শহরের কিছু লোকজনের কানেও পৌঁছেছে নৌকা বানানোয় মনার সুন্দর কারিগরির নাম। মনার কাজের মতির ও সাফল্যের দাবিদার কিন্তু অন্য একজন হোলো। সে মনার বৌ ইন্দু। তিনটি বছর পার, এবার ইন্দুর দ্বিরাগমন হোলো পতিগৃহে। তেইশ বছরের মনার সংসারের কর্ত্রী হয়ে এলো চোদ্দো বছরের ইন্দুবালা। লক্ষ্মীমন্ত ইন্দু সংসারের সব কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভারী সুন্দর করে চমৎকার সব সেলাই করে। ঘোমটা টানা ইন্দু একদিন মনাকে একখণ্ড সাদা কাপড়ে রঙীন সুতোয় ফুলতোলা একটা রুমাল দিলো সকাল সকাল কাজে যাবার সময়। মনার বুকের রক্তটা ছলাৎ করে উঠলো, ঠিক যেমনটি হয় বাইচ খেলার শেষে দু'হাতে বৈঠা মাথার উপর তুলে "চিকুইর পাড়নের সুমে"(চিৎকার করার সময়)!
সম্পন্ন আর্থিক পারিবারিক পরিকাকাঠামোয় মনার সুমসৃণ জীবন যাপন। নৌকায়, কারখানায়, ঘোড়ায়, পূজাপাঠে, খোল -কর্ত্তাল - হরিধ্বনিতে, গাছের ফলফলাদিতে, বারো মাসের তেরো পার্বণে, দাদাদের শাসনে-আদরে, ভাপা ইলিশে, চিতলের মুইঠ্যায়, খেঁজুরের রস জ্বাল দেবার গন্ধে, পিঠে পুলি নাড়ু মোয়া মিষ্টান্নে আর ইন্দুর অকুন্ঠ নীরব ভালোবাসার সাথে। তরতর করে পার হয়েছে আরো বছর তিন-চার। এরপর খুশির জোয়ার শতেক গুণ করে মনা ইন্দুর প্রথম কন্যাসন্তান রমলা এলো, তার বছর ছয়েক পরে কমলা এলো ঘর আলো করে। তারপর বছর ঘোরার অপেক্ষা, এলো বিমলা। মনা মেয়েদের নিয়ে ভারী খুশী। সংসারে সুখ শান্তি উপচে পড়ছে, কোথাও কোনো কমতি নেই। মনার হাতে তৈরী নৌকার কদরে কারখানা ঘর বাড়তি আরেকখানা করতে হয়েছে।