গোয়েন্দা ( ধারাবাহিক )
গোয়েন্দা ( ধারাবাহিক )
পর্ব - এগারো
রাতে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া করল সূর্য্যকিরণ । মাতাদেবী অতি সযত্নে এবং সাগ্রহে ছেলেকে ভোজন করালেন । তপনকিরণ চৌধুরীর মাথায় ভীষণ চাপ । তিনি কিছুই খেতে পারলেন না । রাত পোহালেই আদালতের রায় অবশ্যই তার বিপক্ষে যাবে - ধরে নিয়ে ছেলেকে প্রশ্ন করলেন - আচ্ছা বাবা, তুই কি করে আদালতের রায় পাল্টে দিবি? আমি তো দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি আমাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। আচ্ছা, তুই কি কোন যাদুমন্ত্র শিখেছিস নাকি ?
সূর্য্যকিরণ একটু হকচকিয়ে উঠল । এই রে ধরা পড়ে গেলাম না তো !
নিজের বিবেককে প্রশ্ন করল । দুবৃত্তের বিবেক বলে কিছু হয় না । সুতরাং বিবেক নিশ্চুপ থেকে গেল । এ ক্ষেত্রে ছলনার আশ্রয় নিতেই হয় । সূর্য্যকিরণ তিন তিনবার মেট্রিক পাশ করতে পারেনি স্রেফ এই ছলনার জন্য । প্রতিবারই পরীক্ষায় খাতায় রসগোল্লা পেয়েছে। সেইজন্য রসগোল্লার আঠালো স্বাদ তার নিকট পরিত্যক্ত । জীবনটাই যেন মধুমেহ রোগাক্রান্ত । অতএব একমাত্র ভরসা উপস্থিত বুদ্ধি ; যার জোরে সে এতদিন পুলিশ ,মা, বাবা, ঠাকুমা, সবাইকে ধোঁকা খাওয়াতে পেরেছে। এবারও তাই করল । বলল -
বাবা ! আমার মনে হচ্ছে তোমার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে ।
চমকে উঠলেন তপনকিরণ।
- ভুল ! না তো ?
তিনি তো কোন ভুল করেননি । ট্রাস্টি বোর্ডের সঙ্গে তাঁর কোনদিন কোন ব্যাপারে তর্কও করেননি। অথচ ওঁরা মামলা করে বসল ।
সূর্য্যকিরণ বলল - এখানেই সবচেয়ে বড় ভুলটা তুমি করে বসেছ । এমনিতে ঠাকুমার উইল সাপেক্ষে তাঁরা দেখভখলের জন্য কিছু অনুদান পেতেন । তুমি কি ভেবে দেখেছো তাঁদের প্রয়োজন যে তোমার মতই সর্বগ্রাসী ?
- কি বলছিস সূর্য্য ? ওদের ঘুষ দিয়ে চলতে হোতো আমাকে ? যার পিতা স্বনামধন্য ব্যবসায়ী অরুণকিরণ চৌধুরী - যিনি জীবদ্দশায় কারও কাছে শির নত করেননি; তাঁর সন্তান হয়ে আমি ট্রাস্টির তোষামোদি করতে যাব ?
- তোমার এই অহংকারই তোমাকে আজ এখানে এনে দিয়েছে বাবা । দেখছি বিষয়সম্পত্তি সম্পর্কে তোমার তেমন জ্ঞান নেই ।
হাসলেন তপনকিরণ । হাতি যখন দ- এ পড়ে তখন ব্যাঙেও লাথি মারে ।
বললেন - সমস্যায় পড়ে আছি বলে মুখে যা নয় তাই বলে যাচ্ছিস?
- কেন বলব না বাবা ? ঠাম্মার কাছে তো গিয়েছিলে ? কোন সুরাহা করতে পেরেছ ? আর দেখ, আমি কেমন করে ঠাম্মার মত বদলাই ।
- কেমন করে বদলাবি ? মা তো অনড় , পাষাণবৎ হয়ে আছেন আমাদের উপর ।
- ঠিক আছে। সকাল হোক। আমরা আবার যাব তাঁর কাছে। এমন কৌশল দেখাব যে তিনি সুড়সুড় করে গড়িয়ে আসবেন ।
অনুপ্রভা দেবী এতক্ষণ সব শুনছিলেন মন দিয়ে । ছেলের কথায় আপ্লুত হয়ে বললেন - এই না হলে ছেলে। দেখ দেখি, এমন ছেলেকে আমরা অকারণে অযথাই বের করে দিয়েছিলাম !
তপনকিরণ বাবু তখনকার মত কথাগুলো হজম করে নিলেন । ছেলে যা বলছে তা যদি সত্যি হয় তাহলে একে অলৌকিক কাণ্ড ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না ।
অনুপ্রভাদেবী বললেন - আর একটু মাংস দিই বাবা। খাদুড় ছেলে; আগে তো একলাই এক কিলো পাঁঠার মাংস খেয়ে নিতিস !
- না মা। আজকাল ওসব বড় একটা পাই না তো। পেট মরে গেছে। বেশী কিছু নিতে পারে না।
পরদিন ভোরবেলায় ওঁরা তিনজন ঘুম থেকে উঠলেন। প।রাত:কৃত্যাদি সেরে চা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লেন বৈদিক ভিলেজের উদ্দেশ্যে । আজ অডি গাড়িটা বের করলেন । বি এম ডব্লিও নিয়ে গতকাল গিয়েছিলেন বলে ভুত দেখেছিলেন। আজ যেন ভালোয় ভালোয় সব ঠিক থাকে । অনুপ্রভাদেবী তো ছেলের এই অডি গাড়িটা ভীষণ পছন্দ করেন ।
সকালের প্রথম ভাগ । রাজপথে ভীড় নেই বললেই চলে। সব ট্রাফিক সিগন্যালেও পুলিশ নেই। সূর্য্যই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল । যেখানে পুলিশ মোতায়ন আছে নিপাট ভদ্রলোকের মত সিগন্যালকে সমীহ করেছে আর যেখানে পুলিশ নেই লাল হলুদ সবুজ যাই থাক না কেন সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটিয়েছে। মিনিট চল্লিশের মধ্যে বৈদিক ভিলেজে পৌঁছে গেল গাড়ি। ঠাম্মার অতি প্রিয় ক্ষীরমূরলী মিষ্টান্ন নিয়ে প্রথমে প্রবেশ করল সূর্য্যকিরণ । দ্বাররক্ষীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল বিশ্বময়ীদেবীর কুটির কোন দিকে। পশ্চাতে তার বাবা মা অনুগমন করলেন । বাড়ির দরজায় টোকা দিতে একটি কম বয়সী মেয়ে - বছর চৌদ্দ পনের হবে হয় তো - দরজা খুলে দিল। এত সকালে আগন্তুক দেখে জিজ্ঞেস করল - কে আপনি ?
- আমি ! আমি গো। সূর্য্যকিরণ চৌধুরী। আমার ঠাকুমা এখানে থাকেন। কয়দিন দেখি না। তাই মন ছটফট করছিল বলে সকাল সকাল চলে এসেছি । ঠাম্মা ঘুম থেকে উঠেছেন নিশ্চয় !
মেয়েটি আমতা আমতা করে বলল - হ্যাঁ এএ , উঠেছেন। এখন ঠাকুরঘরে আছেন ।
- বেশ তো। একটু অপেক্ষা করি না হয় । তা তুমি কে গা?
মেয়েটি লজ্জিত হয়ে বলল - আমি শুভশ্রী। শুভশ্রী দণ্ডপাট। ঠাকুমা আমাকে তাঁর কাছে রেখেথেন ।
- বেশ তো । এতে লজ্জা পাবার কি আছে ?
তপনকিরণ এবং অনুপ্রভাদেবী এসে বললেন - ও কাজের মেয়ে।
তারপর শুভশ্রীকে বললেন - যাও মেয়ে, মাকে খবর দাও , নাতি এসেছে দেখা করতে ।
শুভশ্রী ভেতরে যেতেই বিশ্বময়ীদেবী বললেন - ও শুভা, কে এসেছে রে ? কার সাথে কথা বলছিলি ?
- ঠাকুমা, তোমার নাতি এয়েছে গো । দেখা করতে চাইছে।
- আমার নাতি ? মানে সূর্য্যদেব ? আরে আজ এত সকালে সূর্য্যদেবের উদয় হয়েছে। ডেকে নিয়ে আয় ।
তারপরই বললেন - না থাক, আমিই নিয়ে আসি।
বলে উঠোনে বেরিয়ে এলেন। সূর্য্যকে দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক চাইতেই দেখলেন তপনকিরণ আর অনুপ্রভা দাঁড়িয়ে।
বেশ গম্ভীর গলায় বললেন - তোমরা আবার কেন ?
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে অনুপ্রভাদেবী বললেন - না মা , আমরা একা আসিনি, সূর্য্যও এসেছে। বলল ঠাম্মাকে অনেকদিন দেখিনি, দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু ও তো আপনার এখানকার ঠিকানা জানে না; তাই বলল আমাকে নিয়ে চল ঠাম্মাকে দেখব।
- কিন্তু কোথায় সে ?
তপনকিরণ বললেন - ওই তো মা । তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে !
বিশ্বময়ী দেবী নাতিকে দেখে আহ্লাদিত হয়ে ওকে যেই বুকে জড়িয়েছেন, অমনি সূর্য্যের আত্মার একটি অংশ বিশ্বময়ীদেবীর হৃদয়ে প্রবেশ করে গেল ।
যারপরনাই আহ্লাদিত ঠাকুমা নাতিকে বুক থেকে ছাড়াতেই চাইলেন না । বললেন - যাদু বাছাধন আমার। কতদিন দেখিনি । আহ্ জীবনটা জুড়িয়ে গেল ।
সূর্য্যকিরণের মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠল । বিশ্বময়ী দেবী এবার সকলকে ভেতরের ঘরে নিয়ে বসালেন । শুভশ্রীকে বললেন - আমার দাদুভাইয়ের জন্য ভালো ভালো খাবার আর গরম গরম কফি নিয়ে আয় ।
শুভশ্রী রান্নাঘরে চলে গেল । সূর্য্যকিরণই প্রথম কথাটা পাড়ল ।
- জানো তো ঠাম্মা ! আজ আদালতের রায়ে আমরা ফতুর হতে চলেছি।
ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে।
উত্তেজিত হয়ে বিশ্বময়ী দেবী বললেন - কখনোই না। আমি বেঁচে থাকতে এমন অঘটন ঘটতেই পারে না ।
- কি আর করবে ঠাম্মা ? যে পৈশাচিক উইল তুমি করে দিয়েছ তাতে এ ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না যে !
- কিসের উইল ? ওই উইল আমি বদলে দেব। আমাকে কোর্টে নিয়ে চল । আমি নিজে গিয়ে সব বাতিল বলে ঘোষণা করে দেব।
সূর্য্যকিরণ তার বাবার দিকে চেয়ে হাসল শুধু। কিন্তু ঈশারায় তাঁদের কোন কথা বলতে নিষেধ করল ।
বিশ্বময়ীদেবী বললেন - আমায় নিয়ে যাবি তো দাদুভাই?
- কোন লাভ হবে না ঠাম্মা । আজ আমরা বেঘর হবই। তবু যখন বলছ নিজের চোখে আমাদের সর্বনাশটা দেখবে চল ।
বিশ্বময়ীদেবী রাগে কাঁপতে লাগলেন ।
- স্বয়ং মহাদেবেরও ক্ষমতা নেই তোদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন ।
( চলবে )
