Partha Pratim Guha Neogy

Comedy Classics

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Comedy Classics

গল্পবন্ধু

গল্পবন্ধু

5 mins
309


মানুষের জীবনে বন্ধুর একটা আলাদা স্থান আছে। আর এই বন্ধুত্বের শুরু একদম ছোটবেলা থেকে। যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেও বন্ধু লাগে, আমার বন্ধুত্বটা ঠিক তখন থেকে শুরু দিলীপের সাথে । তাতে প্রকৃতি ডাকলো কিনা সেটা বিষয় হিসাবে গুরুত্ব পায় না,সৌহার্দ্যতাটাই আসল । তখনও সে ব‍্যাটা ঠিক দিলীপ বলে পাত্তা পেত না। কখনও 'দিলু' আবার কখনও রাগ হলে 'দীলে' বা কখনও 'গল্পবন্ধু' বলেই বন্ধুদের কাছে পরিচিত ছিলো। তার উপর রাগ আমাদের প্রায়ই হতো ; কারণ বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিলো। আমি তো নিশ্চিত ছিলাম ও ব‍্যাটা একদিন নামকরা সাহিত্যিক হবে। 

যখন জয়েন্টে ভালো র‍্যাঙ্ক করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো আমরা ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম জয়েন্টের খাতায় কি গল্প লিখেছিলি রে ,যে তোর এত ভালো র‍্যাঙ্ক হয়েছে?


শুনে 'হো-হো'-করে হেসে ব্যাটা ফকড়ামি করে বলেছিলো, সে গল্প বলা বারণ আছে। না'হলে তোরা জানলে তোদের র‍্যাঙ্ক আমার থেকেও ভালো হতো। শুনে এত রাগ হয়েছিল, বলেছিলাম,


'দ‍্যাখ দীলে, তোর অনেক চ‍্যাংড়ামি এতদিন ধরে সহ‍্য করছি, তাবলে পরীক্ষা নিয়ে ফক্করি সহ‍্য করব না।' শুনে এমন দাঁতের দোকান খুলেছিল যে রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গিয়েছিল। 


 আসলে কি জানেন, সব সময় পাশাপাশি থাকা বন্ধুদের মধ‍্যে কেউ যদি হঠাৎ করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, তখন মুখে গুণগান গাইলেও মনে মনে বড় জ্বলন হয় । এটা ঠিক হিংসে নয়, বন্ধুকে হারাবার এক প্রবল ভয়। সমকক্ষ হয়ে না উঠতে পারলে যে আর সেই দোস্তি থাকবে না তা যেন মন অবলীলায় বুঝতে পারে।নিজের হীনমন্যতা মানুষকে মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দেয় ধীরে ধীরে। এভাবেই নষ্ট হয়ে যায় কত ভালো-ভালো বন্ধুত্ব। আমিও ,'দিলু' অথবা রাগে বা আদরে ডাকা 'দিলে'-কে হারিয়ে ফেলার ভয় যতবেশী পেতে লাগলাম ততই ওর থেকে দূরে- দূরে থাকা শুরু করলাম।


ইংলিশ অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম স্থানীয় কলেজে। ছুটিতে যখন দিলু বাড়ি আসত কয়েকঘন্টা আড্ডা দিতে চলে আসত আমাদের সঙ্গে। চিরকালের গুলবাজ দিলু কলকাতার যেসব ঘটনা বর্ণনা করত, শুনতে শুনতে আমরাও তার স্বভাব ভুলে যেতাম। আমরা মফঃস্বলের ছেলে, কলেজে উঠলেও তেমন লিয়াকত আলি খাঁ হবার সুযোগ পাইনি তখনও। বন্ধুদের সঙ্গে বসে সিগারেট খাচ্ছি হয়তো, দূরে বাবা আসছেন দেখেই সবাই সিগারেট গুলো পায়ের তলায় ফেলে মুখের সামনে উড়ে যাওয়া মাছি তাড়াতে ব‍্যস্ত হ‍য়ে পড়তাম ঠিকই , কিন্তু মাটিতে ফেলে দেওয়া মহার্ঘ্য বস্তুটির জন্য প্রাণ ফেটে যেত। তখন আমাদের হাতে এত পয়সাও থাকত না যে হরদম সিগারেট কিনবো। তিনজনে মিলে হয়ত একটা সিগারেট ভাগ করে খেতাম। এ হেন আদরের বস্তু,যার কিনা স্থান আমাদের ঠোঁটে তাকে পায়ে মাড়িয়ে ফেলা যে কত বেদনাদায়ক তা শুধু ভুক্তভোগীরায় জানে। 


 একদিন বিকেলে আমরা গল্প করছি পাড়ার মোড়ের পুলকদার চায়ের দোকানে। এখন এটাই আমাদের 'কফিহাউস' । আমরা সাতবন্ধু সেই ছোটবেলা থেকেই পুলকদার দোকানের খদ্দের। দোকানটার একদিকটা মুদিখানা আর একটা দিকে চা-জলখাবারের দোকান। বৌদি আর পুলকদা মিলে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে এই দোকানের পিছনে। আমরা এলে বৌদি দুটো চা-কে সাতভাগ করে দেয়। আর পুলকদা দুটো সিগারেট বের করে বলে, ছোটোতে তোরা চকলেট নিতি কিন্তু গোটা একটা করে। যত বড় হচ্ছিস তত বন্ধুত্ব গাঢ় হচ্ছে। সব ভাগাভাগি করে খেতে শিখছিস, চিন্তায় আছি চাকরিবাকরি বিয়েশাদি নিয়ে। এতটুকু বলে একটা চোখ বন্ধ করে খ‍্যা-খ‍্যা করে হাসে। আমরাও বেশ মজা পায়। সেদিন দিলু আমাদের সঙ্গে থাকায়- চা-সিগারেটের ভাগীদার বাড়ল, বা বলা ভালো প্রত‍্যেকের ভাগের পরিমাণ কমলো। তবু সেই চন্নামিত‍্যটুকু গলায় ঢেলেয় আমরা গপ্পে মশগুল হয়ে পড়লাম। একটু পরে দুটো সিগারেট দিলো পুলকদা সঙ্গে সেই একচোখের ফিঁচেল হাসি। আমরাও হাসতে হাসতে সিগারেট ধরিয়ে চারজন করে একটা সিগারেটে একফুঁক মাত্র দিয়েছি এমনসময় সামনের মোড় ঘুরে আমাদের সঙ্গে থাকা এক বন্ধুর বাবাকে পুলকদার দোকানের দিকে আসতে দেখেই সিগারেট ফেলে তার উপর পা-চেপে দাঁড়িয়ে হাতনেড়ে বিশ্বের যত মশা-মাছিকে হাত দিয়ে উড়িয়ে দিতে তৎপর হলুম। কাকু এসে বিপুলদার কাছে মুদিখানার জিনিস নিয়ে আমাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চলে গেলেন। তখনকার দিনে বাবারাও এইভাবেই ছেলের বড় - হয়ে ওঠাকে মর্যাদা দিতেন।এখনকার মত মাইডিয়ারি ভাব দেখিয়ে আদিখ্যেতা করে সন্তানের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতেন না। 'ছেলে বড় হয়েছে'-এই মর্যাদাটুকু উদাসীনতার বর্ম দিয়ে ঢেকে দিতেন। 


কাকু চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুঃখী মুখে বেঞ্চে বসে পড়লাম।এমনসময় দিলু বলে উঠলো,

"কলকাতায় এমন হয় না"।

সবাই উৎসুকমুখে তাকিয়ে বললাম, 

"কি রকম রে?"


"এই যে বাবাকে দেখলেই দামি সিগারেট কেউ ফেলে দেয় না।"


"বলিস কি ! বাবার সামনেই সবাই সিগারেট খায়"?


" কেউ কেউ তাও খায় বইকি। তবে সবাই অতটা বাড়াবাড়ি না করলেও খানিকটা আড়াল করে রাখে। বাবা অন‍্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান, যেন ছেলেকে দেখেননি।"


" এত্ত সাহস! বাবার সম্মান নাই?"


" এতে অসম্মানের কি আছে?খাবার জিনিস খেয়েছে।"


আমরা হাঁ - করে দিলুর দিকে চেয়ে রইলাম । একদিকে যুক্তিবাদী মন বলছে , 'ঠিকই তো, সবাই খায় যখন তাতে দোষ কোথায়!' 

অন‍্যদিকে সহবত শিক্ষায় শিক্ষিত মন বলছে - 

' বড়দের সামনে যে-কোনো রকম নেশা করাটা অন‍্যায়।'


হঠাৎ পুলকদা বলে উঠলো, 

"এই যে ছেলেরা ,তোদের সহবতের পুরস্কার স্বরূপ আমি দুটো সিগারেট তোদেরকে আজ খাওয়াচ্ছি। তোরা যেটা করিস সেটাই সঠিক ভাই"।

আমরা এই কৃতিত্বের মূল্য হাতে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে উঠলাম।


পরেরদিন আবার আমরা আটজন বসে গল্প করছি বিপুলদার দোকানে, সামনে দিয়ে পাড়ার প্রিয়া দোকানে এলো। আমরা সবাই ছোটো থেকেই প্রিয়াকে চিনি,কিন্তু আজকাল যেন কেমন অন‍্য দোলা মনের মধ‍্যে অনুভব করছি প্রিয়াকে দেখলে। এত মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে কথা না বলে থাকতে আমার মোটেও মন চাইছে না। প্রিয়া কিন্তু আমার দিকে ফিরেও চাইলো না,আড়চোখে একবার দিলুর দিকে তাকিয়ে জিনিস নিয়ে চলে গেলো।ব‍্যাকগ্ৰাউন্ডে পুলকদার গান শুনলাম-

"রাধেএএ, মনটাকে দিয়ে এলি বল্ কোন্ মথুরায়......"

বুকের ভিতরটা মোচড় দিলো আমার। বন্ধুদের দু'একজনের মুখের দিকে তাকিয়েও দেখলাম মুখের নক্সা আমারই মত। বেশ একটা তৃপ্তি পেলাম, তাহলে আমি একা ছ‍্যাঁকা খাওয়া রোমিও নই,দলে লোকজন বেশ ক'জন আছে। বয়েসখানা এমন যে ছ‍্যাঁকা খাওয়ার সঙ্গী পেলেও তখন মন ভরপুর আনন্দ পায়।


তারপর গরমের ছুটি শেষ হয়ে গেলো,দীপু কলকাতায় চলে গেছে আমরাও নিজেদের কলেজ,আড্ডা নিয়ে বেশ সময় কাটাচ্ছি। সেদিন ছিলো রাখীপূর্ণিমা, দূরে দেখি প্রিয়া আসছে পুলকদার দোকানের দিকে। প্রায়ই আসে তাই বিশেষ কিছু মনে হয়নি প্রথমে কিন্তু হঠাৎ এসে আমার হাতটা ধরে রাখী পড়িয়ে বললো,"তোমার বোন নেই তো কি হয়েছে তপুদা, আমি কি তোমার বোনের মত নই? এর জন্যে তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে? এখন থেকে প্রতি রাখীতে আর ভাইফোঁটায় আমি তোমাকে দাদার মত রাখী পরাবো আর ভাইফোঁটা দেবো।"

আমার দূর্দশা তখন বলার মত নয়। এক তো বোন নেই বলে কোনোদিনই আমি তার অভাব বোধ করিনি,আত্মহত‍্যা তো স্বপ্নের অগোচরে। তার উপর আবার প্রিয়া আমার সেই বোন হতে চাইছে,দুঃখে জলেডুবে মরতে ইচ্ছা হচ্ছিলো তখন। কিন্তু আমার এ সর্বনাশ কোন্ বিস্বাসঘাতক করলো - না জেনে মরাটা কোনো কাজের কথা নয়। পুঁটি আমার হতভম্ব মুখ দেখে বললো, "দিলুদা আমাকে চিঠিতে তোমার এই দুঃখ সম্পর্কে লিখেছে । তোমার নামেও একটা চিঠি দিয়েছে আমাদের ঠিকানায়। তোমার ঠিকানায় কেনো দেয়নি জানতে চাইলাম কাল ফোনে, বললো, "বোনের হাতে বন্ধুর চিঠি পেলে নাকি তোমার বোন পাওয়ার আনন্দ দ্বিগুণ হবে। তবে আমাকে তোমাকে লেখা চিঠিটা পড়তে বারবার মানা করে দিয়েছে।"


"এই নাও" -বলে চিঠিটা দিয়ে প্রিয়া চলে গেলো। 


আমি চিঠিটা খুলে দেখলাম, লেখা ছিলো-


"প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস/তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। 

তাই রাখী পরিয়ে বাঁধ দিলাম।"


পিছনে রাসু আমাদের সপ্তরথীর এক রথী বলে উঠলো," গল্পটার সাফল্য কথকের উপর নির্ভর করে ......"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy