গৌরীদান
গৌরীদান


সে ছিল ফুটফুটে এক মেয়ে
বয়স তখন ছিল বারো হল যখন বিয়ে।
হ্যাঁ তার কথাই আজ বলব। সময়টা অনেকদিন পিছনের,স্বাধীনতার অনেক আগের গল্প। তখন মেয়েদের 'গৌরীদান' করতে হত অর্থাৎ ঋতুমতী হবার আগে বিয়ে দিতে হত,না হলে সমাজে মান থাকত না।
ফুটফুটে মেয়ে নীহার। ১২বছর বয়সে শ্বশুরবাড়ি এলে,শাশুড়ি তাকে গড়ে পিটে নিতে লাগলেন,কারণ সবাই তখন মনে করত মেয়েরা হল কাদার তাল,তাদের মনের মত করে গড়ে পিটে নিতে হয়।
শাশুড়ির কাছে ডাল চেনা দিয়ে শুরু তার গড়ে ওঠার প্রথম ধাপ। স্বামী তখন পড়াশুনো করে,অতএব কাজ শেখাই তার প্রধান কাজ। নীহার কাজকর্ম শিখতে শিখতে বেড়ে ওঠে ক্রমে। ১৫বছর বয়স হলে স্বামীর কাছে যাবার অনুমতি পায়। দুজনার মধ্যে ভালবাসা হয়,ফলস্বরূপ কয়েক মাসের মধ্যে সে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। সবাই খুশি। সঠিক সময়ে ফুটফুটে একটি ছেলের জন্ম হল। ছেলেকে নিয়ে খুশির জোয়ারে ভাসে তারা। দেখতে দেখতে ছেলের ১বছর ৪মাস বয়স হল। নীহারের জীবনে নেমে এল কালো মেঘের করাল ছায়া। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেল তার স্বামী হঠাৎ তিন দিনের মধ্যে। চারিদিক অন্ধকার। শোকে পাথর হয়ে গেল নীহার,চোখে একফোঁটা জল নেই,মুখে একটা শব্দ নেই,খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করল সে। ছেলে রইল পরিবারের সকলের জিম্মায়, কোনোদিকেই তার মন নেই তখন। তার যে একটা দুধের শিশু আছে তাও তার মাথায় নেই। বড়রা তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ছেলেকে এনে দিলেন তার কোলে। সম্বিত ফিরল নীহারের। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে চোখের জলে ভাসল সে। এরপর সেই ছেলেকে বুকে নিয়ে শুরু হল তার লড়াই।
১৭বছর পার হতে না হতেই তার জীবনের সব রঙ মুছে গেল। সাদা ধুতি উঠল তার সোনার অঙ্গে,গহনাদের হল বিসর্জন। শুরু হল বৈধব্য,শুরু হল লড়াই কঠোর বাস্তবের সঙ্গে। সে বয়সে সৌন্দর্যের সাথে ব্যক্তিত্ব মিলেমিশে তাকে করে তুলেছিল আরো সুন্দরী,যৌবন তার শরীর বেয়ে ধারার মত বয়ে চলেছে তখন। সেই যৌবনকে শাসন করে,একনিষ্ঠ ভাবে কঠোর বৈধব্য পালন,কৃচ্ছসাধন কতটা মনের জোর থাকলে করা সম্ভব,তা বলাই বাহুল্য।
মনে কাঠিন্য এনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল সংসারে। যৌথ পরিবার,সদস্য সংখ্যা ৬০। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও সকলের সুখসুবিধা দেখা,খেয়াল রাখা,এ ছিল তার বৈশিষ্ট্য। তাই পরিবারে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য। এ তো তাকে করতেই হত। তার মাথার উপর থেকে ছাদটাই যে গিয়েছিল উড়ে,বাপহারা শিশুটাকে বড় করতে হবে যে। বাড়ীতে দোল দুর্গোৎসবে বড় ভূমিকাই ছিল তার। অন্যান্য বউরা যখন একগা গয়না পড়ে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াত,নীহার স্বেচ্ছায় পুজোর সমস্ত দায়িত্ব নিজে নিয়ে ঠাকুরঘরে নিজেকে বন্দী করেছিল। ভোর ৪টেয় শুরু হত ভোগের আয়োজন,চলত সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত। রাতের পুজোর সব আয়োজন শেষ করে সে বেরতো ভোগের ঘর থেকে। এছাড়া বাড়ীতে ছেলেপুলের সংখ্যাও বড় কম ছিল না,সবার দেখাশোনার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছিল সে। অতিথি আপ্যায়ন তাও। হাসিমুখে সব পালন করত। বিশ্রাম কি জানত না তা। সবার সব দাবী মিটিয়ে তবে নিজের শোয়া। দিনান্তে নিজের ছেলেটাকে বুকে টেনে নিত,আদর করত,তখন সবার আড়ালে তার চোখে জল পড়ত।
বাড়ীতে ভাসুরঝিদের বিয়ে লাগতে শুরু করলে,শাশুড়ি তার গহনা দিয়ে তাদের সাজিয়ে দিতে লাগলেন,বলতেন,"ওর আর কি হবে?তাছাড়া সবাই ওকে দেখবে অতএব ওর যা সম্বল তা তাদের জন্যই নিয়োজিত হোক।" মুখ বুজে সব দেখত,টুঁ শব্দটি করেনি কখনও। একমাত্র লক্ষ্য ছেলেটাকে মানুষ করা। তার এই সব হারানোর পর তার বাবা তাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে এসেছিলেন,সে যায়নি। বাবা তার রায়বাহাদুর,বাড়িতে ইংরেজদের সঙ্গে বসে মদ্যপানের আসর,যা নীহারের মোটেই পছন্দ ছিল না। স্বদেশী মনোভাবাপন্ন শ্বশুরবাড়িতে থাকতেই সে ছিল স্বচ্ছন্দ। বাবাকে জবাব দিয়েছিল সে,"শ্বশুরবাড়ি মেয়েদের তীর্থস্থান,এখানেই থাকব আমি"। এরপর বাপেরবড়ি আর যায়নি সে,ভাইয়েরা আসত মাঝেমধ্যে,ওইটুকুই।
শ্বশুরবাড়িতেই মনপ্রাণ ঢেলে কাজে ব্যস্ত রাখত নিজেকে সব ভুলে থাকার অছিলায়। ছেলে একটু বড় হয়ে একদিন মায়ের কাছে দুটো পয়সা চেয়েছিল। মা বুঝিয়েছিলেন ছেলেকে,"তোমার তো বাবা নেই,আমি পয়সা কোথায় পাবো বল?"ছোট্ট ছেলেটাকে আর কখনো বোঝাতে হয়নি,সেই একদিনেই সে বুঝে নিয়েছিল মায়ের কতটা কষ্ট। মা অন্তঃপ্রাণ। ছোট থেকেই বাড়ন্ত চেহারা,দশ বছর বয়সের ছেলেকে দেখে মনে হত ১৫-১৬বছরের ছেলে। সেই ছেলে দেওয়ালীতে বাজি পোড়াতে গিয়ে বিরাট অ্যাক্সিডেন্ট,একটা চোখ ঝুলে পড়ল, ডানহাতের তিনটে আঙুল খসে পড়ল। নীহার অজ্ঞান হয়ে গেল দেখে,তিনদিন তার জ্ঞান ফেরেনি। অন্ধের যষ্টি,একমাত্র অবলম্বন তাকেও বুঝি হারাতে হয়। ৬টা মাস ছেলে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পড়েছিল। তখনকার সাহেব ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিলেন,কোনো আশা নেই।
অবশেষে,মায়ের টানেই হবে হয়তো,সে ছেলে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরেছিল। একটা বছর তার পড়া নষ্ট হল। মায়ের যত্নে,শুশ্রূষায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে আবার পড়াশুনো শুরু করল। জীবনে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি ছেলেটি। সে ছেলেও বুঝে গিয়েছিল তাকে বড় হতে হবে,মায়ের দুঃখ ঘোচাতে হবে। বোঝে মায়ের সারাদিনের জীবন কালি করে এ পরিশ্রম শুধু তাকে বড় করা, মানুষ করার জন্য। ছেলেটি বড় হল আস্তে আস্তে,বাড়ীতে সদস্য সংখ্যা কমতে লাগলো। বয়স্করা একে একে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে লাগলেন। যৌথ পরিবার ভাঙতে লাগলো। মা আর ছেলের সংসার। ছেলে চাকরী পেলো। মায়ের সংগ্রাম শেষ হল। ছেলের বিয়ে দিয়ে নতুন করে সংসার রচনা করলেন। স্বামী সুখ না পেলেও অমন সন্তান সুখ খুব কম মা-ই পায়। ছেলেটি রত্ন। মাকে মাথায় করে রেখেছিল সারাজীবন।
আমার অনুপ্রেরণা হলেন এই মহিলা,হ্যাঁ ইনিই। ইনি আমার পরম পূজনীয়া ঠাকুমা। জীবনের প্রথমভাগে না হলেও,দ্বিতীয় ভাগে অফুরন্ত সুখ পেল নীহার কিন্তু তার আক্ষেপ ছিল,"যদি লেখাপড়া জানতাম নিজে তো পয়সা রোজগার করতে পারতাম,সকলের করুণার প্রার্থী হয়ে,দয়া ভিক্ষা করে আমায় বাঁচতে হত না"। অত্যন্ত বলিষ্ঠ চরিত্রের মহিলা ছিলেন তিনি,ছিল প্রখর আত্মসম্মানবোধ,ছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে অটল,ছিলেন পরিশ্রমী,সর্বগুণসম্পন্না। আমাদের ছোটবেলায় মা থাকতেন ছোটটিকে নিয়ে আর আমরা বড়রা সব ঠাকুমার ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠি। তাঁর প্রভাব আমাদের ভাইবোনেদের ওপর ভীষণভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। আমাদের প্রতিপালন করে তিনি সুখ পেতেন,আনন্দ পেতেন। মায়ের কাছে অক্ষর পরিচয় হবার পর তিনি আমাদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করতেন। আমাদের পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তিনি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। ছুটির দিনে দুপুরে যখন বাড়ি থাকতাম,মা যখন ছোট ভাই-বোনকে নিয়ে বিশ্রাম করতেন,ঠাকুমা আমাদের মাদুর পেতে পড়তে বসাতেন,নিজে খাটে শুয়ে খেয়াল রাখতেন আমরা মন দিয়ে পড়ছি কিনা। আমরা ভাল করে লেখাপড়া শিখি এ ছিল তাঁর ভীষণ আকুতি। নিজে ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমতী, চোখকান খোলা,চারিদিকে নজর। নিজে পড়াশুনো শিখতে পারেননি বলে শুধু আমাদের নয়,আশপাশে গরিব ছেলে মেয়েরা অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারছে না জানতে পারলে তাদের বই কিনে দেওয়া,পরীক্ষার ফিস দিয়ে দেওয়া এসব করতে দেখেছি আমরা ছোট থেকেই।
আমি যখন ক্লাস ফাইভ,দিদি সেভেন,ঠাকুমা আমাদের প্রাইমারি সেকশনের টিচারকে বাদ দিয়ে অন্য একজন টিউশন টিচার ঠিক করলেন যিনি আমাদের পাড়ার উল্টোদিকেই থাকতেন। যেহেতু বড় রাস্তা পার হয়ে যেতে হতো,তাই কাজের লোকেরা পৌঁছে দিয়ে আসত আর পড়া হয়ে গেলে টিচারের বাড়ির কেউ রাস্তা পার করে দিতেন। ঠাকুমা যেতেন মাসের শেষে মাইনে দিতে। একদিন গিয়ে দেখেন আমাদের টিচার আমাদের পড়াবার সময় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়াচ্ছেন। বাড়ি ফিরে ঠাকুমার আক্ষেপ,"যদি লেখাপড়া জানতাম,হাসির মতো উল্টে শুয়ে রোজগার করতাম"। হ্যাঁ,আমাদের সেই টিচারের নাম ছিল হাসি। যখন যেমন প্রাইভেট টিউটর প্রয়োজন হতো,ঠাকুমাই ব্যবস্থা করতেন। পাড়ায় বেরিয়ে যে বাড়ির ছেলে মেয়েরা স্কুল পাশ করে কলেজে গেছে তারা কে কোথায় টিউশন পড়েছে খোঁজ নিয়ে ছুটেছেন টিচারের বাড়ি। বাবা ছিলেন ব্যস্ত মানুষ, সময় পেতেন না,মা ছোট ভাইবোনদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তাই ঠাকুমাই ভরসা। আমাদের স্কুলের রেজাল্ট বেরোলেই পাড়ায় বেরিয়ে পড়তেন নাতি-নাতনিরা কেমন দারুণ রেজাল্ট করেছে তা জানাতে। আমরাই ছিলাম তাঁর জীবন। আমাদেরও যতরকম আবদার ছিল তা
ঁর কাছে।
সবদিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর,আমরা অবাক হয়ে যেতাম। ঘরে বিছানায় শুয়ে টের পেতেন গোয়ালঘর ধোওয়া হয়নি। "রাতে সতর্ক থাকিস দাশু,ভোরের মধ্যেই গরুর বাচ্চা হবে।" গরুর যে দেখাশুনা করত তার প্রতি সতর্কবার্তা,আর তাই-ই ফলত বাস্তবে। এই দাশু ও আরেকজন নাম ঘন্টা এরা দুজন আমাদের বাড়িতে এসেছিল যখন তাদের ১৩-১৪ বছর বয়স। ঠাকুমা এদের পাড়ার ক্লাবে এক্সারসাইজ করতে পাঠাতেন ভোরবেলায়। এদের জন্য ছোলা ভিজিয়ে রাখতেন,ব্যায়াম করে ফিরে আদাকুচি দিয়ে সেই ভেজানো অঙ্কুরিত ছোলা খেতে দিতেন। ঠাকুমাকে দেখেছি এদের কখনও কাজের লোকের মত দেখতেন না,নিজের ছেলের মতই দেখতেন,আর তারাও 'মা'বলতে অজ্ঞান ছিল,খুব ভালবাসত ঠাকুমাকে,আর আমাদের সকলকেই। পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছিল তারা। গরুর দেখাশোনা যেমন করত,রোজ তাদের জন্য দুধও বরাদ্দ ছিল। এদের দুজনকেই ঠাকুমা উপযুক্ত সময়ে বিয়ে দেন,তাদের বউদের ছ'গাছা করে সোনার চুড়িও গড়িয়ে দেন। এরপর দাশু বউ নিয়ে আমাদের বাড়িতেই থাকে,ঘন্টা তার বউকে গ্রামে রেখে আসে। পরবর্তীতে পান্ডুয়ায় আমাদের জমিতে দুজনকেই ঠাকুমা বাড়ি করে দেন। বিয়ের পর দাশুর দুটো ছেলে হয় পরপর আমাদের বাড়িতেই থাকাকালীন। ঠাকুমা দাশুকে একটা রিক্সা কিনে দেন,বলেন,"সন্ধ্যেবলায় কাজ থাকে না,রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে দুপয়সা বাড়তি রোজগার করে আয়"। আমাদের তখন আড়াইশ বছরের পুরনো অতবড় বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ সব ছিল ঠাকুমার তত্ত্বাবধানে,বাবাকে তাকিয়ে দেখতেও হতো না। রাজমিস্ত্রি,রংমিস্ত্রি,ইলেকট্রিক মিস্ত্রি,কলমিস্ত্রি,কাঠমিস্ত্রি,ঘরামি প্রয়োজনে লোক মারফত নিমেষে জোগাড় করে ফেলতেন ঠাকুমা। তাঁর এমনই ব্যক্তিত্ব ছিল,এমনই রাশভারী ছিলেন তিনি, তাঁকে অমান্য করার ক্ষমতা কারও ছিল না তখন। সেসময় কংগ্রেস আমলে আমার বাবা সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রেশনব্যবস্থা চালু হল,ঠাকুমার ভারী অপছন্দ। ভাঁড়ারে চালডাল থৈথৈ করবে,তা না রেশন! বাড়িতে পার্টির মিটিং ছিল,খাদ্যমন্ত্রী উপস্থিত,এছাড়া অনেক নেতাব্যক্তিও ছিলেন সেই মিটিংয়ে। ঠাকুমা সেখানে গিয়ে বলেন,"মরি মরি,এই তোমাদের খাদ্যমন্ত্রী,ভাঁড়ার ঢুকল রেশনে?"তাঁর মুখের ওপর খাদ্যমন্ত্রীর সেদিন কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না,কেবল বলেছিলেন,"কি করি মা,এছাড়া যে আর উপায় নেই"। আমরা বড় হয়ে বাবার কাছে এ গল্প শুনে হেসেছি ঠিকই, তবে তার এমন বলিষ্ঠ চরিত্রে,এমন ব্যক্তিত্বে মুগ্ধও হয়েছি বারংবার।
আবার এই ঠাকুমাই আমাদের সবরকম আবদার মেটাতেন। তাই একেকজনের জন্য একেকরকম জলখাবার,যে যেমন চাইত। বাবা আমাদের এত আসকারা দেবার জন্য রাগ করতেন, বলতেন "মেয়েগুলোকে পরের বাড়ি যেতে হবে মা,এত আসকারা দিও না"। ঠাকুমার নির্লিপ্ত জবাব ছিল,"এবাড়ির ছেলেপুলে কখনও খারাপ হয় না।" নিজেদের কানে ঠাকুমার আমাদের প্রতি আস্থার কথা শুনে আমরাও চেষ্টা করেছি চিরকাল তার মর্যাদা রাখতে। সব দিকে চোখ-কান খোলা এই মহিলার বুদ্ধি দেখে আমরা বারেবারে তাজ্জব হয়েছি। নিজেদের মধ্যে বলেছি, "ঠাকুমাকে প্রধানমন্ত্রী করে দিলে দারুন দেশ চালাত কিন্তু"। তাঁকে যত দেখেছি তত অবাক হয়েছি,মুগ্ধ হয়েছি। আমাদের ছোট থেকে সব কাজে পারদর্শী দেখতে চাইতেন,তৈরি হবার সুযোগ দিতেন,নিজে ছিলেন তেমনই একজন বলিষ্ঠ মানসিকতার মহিলা। পারি না,পারব না বলে কোনো কথা তাঁর অভিধানে ছিল না। বাড়িতে প্রচুর কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও কখনও বাসন মাজার লোক না এলে আমরা বাসন মাজতে চাইতাম। যদিও অন্য কাজের লোক তা করে দিত। ওনার নির্দেশে প্রত্যেকে আমরা ছাদে গিয়ে টব থেকে মাটি নিয়ে নিজের নিজের কাঁসার থালা প্রাণপণে ঝকঝকে করে আনতাম। কোনও কাজে যাতে আমরা পিছপা না হই তার জন্য। কাজের লোক যখন বাড়ির নারকেল গাছের পাতা চেঁচে কাঠি বার করত আমরা বোনেরা অবাক চোখে দেখতাম,করতে চাইতাম একটু,তারা দিতে চাইত না পাছে হাত কেটে যায়। ঠাকুমা নির্দেশ দিতেন,"দে না করতে একটু,করুক"।
আবার সেসময়ের নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ বছর বয়স পার হলেই ঠাকুমা আমাদের দিয়ে পুজোপাঠ,বারব্রত করাতেন। শিবরাত্রিতে শিবের উপোস করালে,নিজেই অস্থির হতেন আমাদের কষ্ট হচ্ছে বলে। বারোটা বাজলেই নিয়ে যেতেন মন্দিরে,শিবের মাথায় জল ঢেলে উপোস ভঙ্গ করার জন্য। কারো একটু হাঁচিকাশি হলে,ভালো করে ভাত খেতে না পারলে,তখনকার পেতলের পাম্প দেওয়া স্টোভে নিজে আলু ভাজা,লুচি করে দিতেন রান্নার লোক থাকা সত্ত্বেও। যখন বয়স ১১,দিদি ১৩,ঝোঁক উঠলো বাগানে সরস্বতী পুজো করবো। বাড়িতে বইপুজো হত,এ আমাদের মূর্তি এনে পুজো হবে। বাড়ি থেকে কোঁদাল,শাবল,বাঁশ সব নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি,পরিষ্কার,দারুণ তোড়জোড়। বাড়ির নিচটায় ভাড়া দেওয়া ছিল,তাদের সব ছেলেপুলে,আমরা দুইবোন ও ভাই,বাকিরা তখন ছোট তাই, সবাই মিলে লেগে পড়লাম। মন্ডপের ছাউনি হল মায়ের দামী দামী পিওর সিল্কের শাড়ি দিয়ে,পুজোর শেষে যা আর পরার অবস্থায় থাকতো না। আমাদের এই নিজেরা পুজো করার তোড়জোড় নেবার ব্যাপারে ঠাকুমার ছিল প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়। বারে বারে ঠাকুমা আমাদের বুঝিয়েছেন বা বুঝতে সাহায্য করেছেন যে আমরাও পারি। সেই ভাবেই ঠাকুমা আমাদের মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছেন আর সেটুকু সম্বল করেই আমাদের বেড়ে ওঠা। কোনও পরিস্থিতিতে হার মানবো না মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে চলা।
সর্বক্ষণ কর্মব্যস্ত থাকতেন তিনি,কখনও বড়ি দেওয়া,
কখনও কুটনো কাটা,কখনও বা ঘরে ঘরে ঘুরে কার বালিশ ফেটেছে খুঁজে বার করে তা সেলাই দিয়ে মেরামত করা,তাছাড়া সমস্ত কাজ নিপুণভাবে তদারকি করা ছিল তার স্বভাবসিদ্ধ। আমার বাবা-মাকে কোনোদিকে তাকাতে হতো না তার ছত্রচ্ছায়ায় থেকে। এছাড়া দূরের আত্মীয়স্বজন,পরিচিত মানুষদের পোস্টকার্ড মারফত খোঁজখবর নিতে দেখেছি তাঁকে,প্রয়োজনে জোড়া পোস্টকার্ডও পাঠাতেন তিনি।ছোটবয়সে মা-বাবা কোথাও গেলে আমরা তা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না কিন্তু ঠাকুমা কোথাও গেলে সবাই আমরা সঙ্গ নিতাম আর আমাদের অসীম স্নেহময়ী এই ঠাকুমাও সব্বাইকে নিয়ে যেতেন সঙ্গে। নিজের অকাল বৈধব্যের কারণে সব ত্যাগ করতে হয়েছিল বলে,প্রতি মাসে বাড়িতে স্যাকরা ডেকে আমাদের বোনেদের জন্য ও মায়ের জন্য গয়না গড়িয়ে দিতেন। কোনোদিকে তাঁর কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি আমরা দেখিনি কখনও। সবসময় ঘুরতে ফিরতে বলতেন,"ঠাকুর হাত-পা নাড়তে চাড়তে যেন চলে যাই,বিছানায় পড়ে না থাকি"। ঠাকুর তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ করেছিলেন। দুটো দিন বিছানায় ছিলেন কেবল,বাড়িতেই। তারই মাঝে মাঝরাতে অসুস্থতার ঘোর একটু কাটলে উঠে বসে দেখেন আমরা তাঁকে ঘিরে বসে আছি। ছোটবোনের চুল বাঁধা নেই দেখে বলেন,"চিরুনি নিয়ে আয়,তোর চুলটা বেঁধে দিই"। পরদিন আবার টলতে টলতে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে খোঁজ নেন,"ছেলেমেয়েদের কার জন্য কি রান্না হলো?"সে রাতটুকু পার করে তিনি চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে,সবাইকে কাঁদিয়ে। ছাপ রেখে গেলেন আমাদের সবার মধ্যে। তাঁকে বরাবর অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। এমন এক মহীয়সী নারীর কণাটুকু পেলেও বুঝব কিছুটা অন্তত মানুষ হতে পেরেছি। ৩৬টা বছর পার,তবু তাঁর কথা ক্ষণে ক্ষণে মনে আসে। আমরা ভাইবোনেরা প্রত্যেকেই তাঁর জীবন আদর্শে অনুপ্রাণিত।
" জীবন তাঁকে দেয়নি কিছুই করে দিয়েছে নিঃস্ব
তবুও তাঁকে দেখিনি হতে কখনও বা বিমর্ষ।"
ছোটবয়সে তখন অত বুঝতাম না,বারেবারে বলতেন,
"অতি বড় সুন্দরী না পায় বর,
অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর"।
বড় হয়ে তা বুঝতে পারি,কারণ তিনি ছিলেন খুব সুন্দরী আর ঘোর সংসারী। এত গুছিয়ে সংসার করাও যে ক'জন পারে! তাই বুঝি নিজের ব্যাপারে ছিল তার এই আক্ষেপ। তিনি আমার জীবনে চলার পথে অনুপ্রেরণা,তিনি আমার প্রণম্য,নমস্য ঠাকুমা। ৩৬ বছর আগে তাঁকে হারিয়ে আজও যেন প্রতিমুহূর্তে তাঁকে হারাই।
আমি আইন পড়তে গেলে খুব খুশি হন,বলেছিলেন," জজ হোস"। তা আমার হওয়া হয়নি,এজন্য আমার বড় আফসোস। আমার বিয়ের আগেই তিনি পরপারে যাত্রা করেন। বিয়ের পর স্বামী জজ কোর্টের উকিল হওয়ায় আমার আর জুডিশিয়াল পরীক্ষায় বসা হলো না,কোথায় পোস্টিং হবে,কোথায় থাকবো এইজন্যে। তখন স্বামীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমার ঠাকুমার ইচ্ছাকে মান্যতা দিতে পারিনি বলে দুঃখ আমার বড়,যন্ত্রণা নিদারুণ।