দিদিমণি
দিদিমণি
"দিলিনা কেন ঘাড়ে এক রদ্দা !ওসব জানোয়ারের হাত কনুই থেকে মুচড়ে দিতে হয়",
"না ম্যাডাম, ভয় করে !যদি কাল আবার কোন অসভ্যতা করে! ",
"ঠিক আছে , কাল 10:15 তে তোরা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াবি । একটু আগে আসবি । আমি একটু পেছন থেকে তোদের পেছনে থাকবো।"
পরদিন সকাল 10:15 , টিনা অনেক আগেই আজকে এসেছে । কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লাস টেনের রোকেয়া, সবিতা , অনুপমা,আসমানী চলে এলো দলবেঁধে। টিনা ওদের চোখের ইশারা করলো। ওরা দলবেঁধে হাঁটতে শুরু করল অন্যদিনের মতো, টিনা একটু পেছনে ।
ভোলার চায়ের দোকানটার কাছে আসতেই দোকানের বেঞ্চে বসা তিন-চারজন অসভ্য বখাটে ছেলের মধ্যে আলোড়ন।দেখেই বোঝা যায় একেবারে বাপে খেদানো মায়ের তাড়ানো ছেলে। চুলে লাল, হলুদ রং, জুলফির কাছে আবার দাগ দেওয়া। অদ্ভুত রঙের জামাকাপড় পড়ে একেবারে নায়কের ভঙ্গিতে ।
টিনা ইচ্ছে করে একটু দূরে,আস্তে হাঁটছিল ,যাতে ছাত্রীদের সঙ্গে বেশ একটু দূরত্ব বজায় থাকে। হঠাৎ একটা ছেলে ঠোঁট সরু করে সিটি দিয়ে উঠলো। আর একজন এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েদের সামনে,
"কি হল কথার উত্তর দিলে না!"
অন্যদিন এই ধরনের আচরণে ওরা তাড়াতাড়ি পা চালায়, কিন্তু আজ আর তা করলো না । ওদের মধ্যে একটু ডাকাবুকো অনুপমা এগিয়ে গেল,
"কি উত্তর দেব? ",
" বা রে ,তাও জানো না !ও আমাকে ভালবাসে কিনা? "
"ও আপনাকে ভালোবাসে না । হোলো ?এবার যেতে দিন ",
ওরা যেই ওই চ্যাংড়াটাকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করল, ছেলেটা রোকেয়ার ওড়না টেনে ধরে ।
" এই যে বলে যাও ভালোবাসো কিনা ?,
"না, "
রোকেয়া দেখে নিল টিনাকে তারপর বলল,
"ভালোবাসি না, হল তো ?এবার রাস্তা ছাড়ুন",
"তা বললে তো হবে না জানেমান! ",
ওড়নাটা ছাড়তে চায় না ছেলেটা । ভোলাদা নির্বিকার ওই ছেলেগুলোর অর্ডার করার ডিম পাঁউরুটির ডিম একটা চামচ দিয়ে টিনের মগে গুলছে, খটখট আওয়াজ হচ্ছে। এসব যেন কিছুই ঘটছে না!
এই রাস্তাটা বেশ ফাঁকা। আসলে ওদের এই হরিতকী তলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় বাস স্ট্যান্ড থেকে একটু ভেতরে । ভ্যান যায় তবে 10 টাকা ভাড়া। গ্রামের ভেতরে স্কুল তাই রাস্তায় ভোলাদার চায়ের দোকান আর কয়েকটা বাড়ি ফাঁকায় ফাঁকায়।
ছাত্রীরা বেশিরভাগ সাইকেল নিয়ে যায়, কেউ কেউ পায়ে হেঁটে । আর এই ধরনের কিছু নেই কাজ তো খই ভাজ ছেলেরা এই চায়ের দোকানের বাইরে বসে মেয়েদের উত্যক্ত করতে থাকে। যারা এখান থেকে পথচলতি ঘটনার সাক্ষী তারাও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায় । বেশির ভাগই চাষী পরিবারের তাই তাদের বাবা-মায়ের সময় কোথায় মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দেবার? ওই সময়টুকু মাঠে খাটলে লাভ !
আর যাদের উপায় আছে তারাও নিজের মেয়েটাকে নিয়ে আলগোছে বেরিয়ে যায়, আর ভোলাদা খরিদ্দার হারাবার ভয়ে চুপ।
গতদিন যখন লিয়াকৎ রোকেয়ার হাতে একটা চিঠি গুঁজে দেয়, ভয় পেয়ে রোকেয়া স্কুলে গিয়ে বেশ কান্নাকাটি করে আর সেখান থেকেই টিনা এসব জানতে পারে ।
গন্ডগোলটা যখন বেশ পেকে উঠেছে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে টিনা ওখানে উপস্থিত হয় । ওদের সামনে ম্যাডাম দেখে লিয়াকৎ এর চ্যালাচামুন্ডারা একটু দূরে সরে যায় । কিন্তু ওড়না টেনে ধরে থাকা লিয়াকৎ মেয়েছেলে দেখে ভয় পাবে বা পেলেও তা দেখাবে কেন?
ও ওড়ণাটা হাতে ধরেই দাঁড়িয়ে থাকে। টিনা গিয়ে সপাটে চড় কষায় ওর গালে ,তারপর এক ঝটকায় ওর হাত থেকে ওড়ণাটা ছাড়িয়ে নেয়।
"ব্যাপারটা ঠিক হলো না", গালে হাত ঘষতে ঘষতে গজরায় লিয়াকত।ওর গালে টিনার পাঁচ আঙুল লম্বা হয়ে ফুটে উঠেছে। টিনা আগে থেকেই তৈরি ছিল তাই শরীরের সব শক্তি এক করে চড়টা কষিয়েছে।
লিয়াকতকে তড়পাতে দেখে ওর সঙ্গীরাও এগিয়ে আসে ।
"আপনি মেয়েছেলে মানুষ, বাইরে থেকে চাকরি করতে আসেন এসব ঝামেলায় পড়বেন না",
"কি বললি?"টিনা এগিয়ে যায়,
"ও আমাদের গ্রামের মেয়ে ",
"হ্যাঁ, হ্যাঁ ,ও আমাদের গ্রামের মেয়ে ",
চ্যালা চামুন্ডারা হুক্কাহুয়া করে,
"ও আমার ছাত্রী। এইসব অসভ্যতার যদি আর দেখেছি সব কটাকে থানায় পূরবো! এখন এখান থেকে যাবি না দেব আর এক চড়? ",
"এখানে চাকরি কি করে করেন ?দেখব! "
শাসাতে শাসাতে লিয়াকতের দল সাইকেলে ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। ভোলাদা মনে মনে ডিম পাঁউরুটির খরিদ্দার চলে গেছে বলে বেশ বিরক্ত ।
সকলকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে পৌঁছোতে, ততক্ষণে ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেছে। টিনা প্রথমে হেড স্যার কে বিষয়টা জানিয়ে থানায় ফোন করতে বলে। থানা থেকে সাব-ইন্সপেক্টর মিস্টার ঘোষ এসে একটা ডাইরি নেন আর ভোলার দোকানে এবং স্কুলের গেটের সামনে কয়েক মাসের জন্য পুলিশ পোস্টিং এর ব্যবস্থা করেন।
টিনা ভালই জানে এর এখানেই শেষ নয় বরং শুরু কিন্তু ও ভয় পেলে মেয়েদের শেখাবে কি? ভয় পেতে?