ধৃষ্টদ্যুম্ন
ধৃষ্টদ্যুম্ন
প্রতিশোধের চিন্তায় জন্মগ্রহণ আর প্রতিহিংসার আরেক ভাবনায় জীবননাশ। এই মহারথীর জীবন প্রতিশোধের আগুনে সারাটা জীবন জ্বলেছে। প্রথম জীবনের বঞ্চনার প্রতিশোধ তাঁকে আবার জন্ম নিতে বাধ্য করেছে। আর সেই নব জন্ম তাঁকে করে তুলেছে মহাভারতের আরেক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। তবে ইনি পুরোপুরি রহস্যময়, জীবন থেকে মরণ অব্দি তিনি আগুনের মতোই তিনি জ্বলন্ত।
ওনার পিতা রাজা দ্রূপদ, দুই বোন দ্রৌপদী আর শিখন্ডী। এছাড়াও রয়েছে আরো চার ভাই। সেই চার ভাই আর শিখন্ডী ওনার অগ্রজ শুধু দ্রৌপদী ছোট।
পিতার নাম পরিচিত হন দ্রৌপদ নামে।
পূর্বকথন:
কাহিনীর শুরু হচ্ছে যখন দ্রূপদ ছিলেন রাজকুমার, শিক্ষার্থী ছিলেন আশ্রমে। সাথী ছিলেন দ্রোনাচার্য্য। দুই জনই ছিলেন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। বন্ধুত্ব দিন দিন বাড়ে। আশ্রম শিক্ষার শেষের দিনে বন্ধুকে কথা দেন, দ্রূপদ রাজা হলে বন্ধুকে দেবেন অর্ধেক রাজত্ব।
বেশকিছু দিন পরে রাজা হন দ্রূপদ। এদিকে দ্রোনাচার্য্য খুব গরীব। দ্রূপদ রাজা হতে অনেক আশা নিয়ে যান দ্রোনাচার্য্য দ্রূপদের কাছে। কিন্তু ততদিনে রাজা হয়ে দ্রূপদ অনেক বদলে গেছেন, প্রথমে দ্রোনাচার্য্যকে সেরকম সম্মান দেখান নি। দ্রোনাচার্য্য তখন বন্ধুর দেওয়া কথা মনে করান। দ্রূপদ শুনে খুব রুষ্ট ভাবে অপমান করেন। বন্ধুত্বের সম্মানটুকু রাখেন না। দ্রোনাচার্য্যকে একরকম তাড়িয়ে দেওয়া হয় রাজসভা থেকে।
বিতাড়িত দ্রোনাচার্য্য মনে মনে শপথ করেন এই অপমানের প্রতিশোধ নেবেন, অর্ধেক রাজত্ব তিনি নিয়েই ছাড়বেন। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি হস্তিনাপুরের সেরা অস্ত্রশিক্ষাবিদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার ভার নেন।
তবে নিজের কাজে কোন খামতি রাখেন না। ভীমকে সেরা করে তোলেন গদাযুদ্ধ শিক্ষা দিয়ে অর্জুনকে সেরা ধনুর্ধর করে তোলেন। যুধিষ্ঠির ছিলেন বল্লম তরোয়াল চালনায় পারদর্শী। নকুল সহদেব ও ছিলেন বড় তরোয়াল বীর।
শিক্ষা শেষে গুরুদক্ষিণা হিসেবে পাণ্ডবদের বলেন রাজা দ্রূপদকে বন্দি করে আনতে।
পঞ্চপান্ডবের সামনে রাজা দ্রূপদের বাহিনী খড়কুটোর মত উড়ে যায়। বন্দি হন রাজা দ্রূপদ।
দ্রোনাচার্য্য'র সামনে এনে উপস্থিত করা হয় বন্দি দ্রূপদকে। বন্দি দ্রূপদকে সেই অপমানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন দ্রোনাচার্য্য।
তারপর নিজে নিয়ে নেন দ্রূপদের অর্ধেক রাজত্ব আর বাকিটা ফিরিয়ে দেন দ্রূপদকে।
একলব্য-শ্রীকৃষ্ণ:
এদিকে একলব্য শ্রীকৃষ্ণের দ্বৈরথ চলছে।
দ্বারকা আক্রমন করে একলব্য ভয়ানকভাবে পরাজিত আহত হয়ে একরকম ফকির হয়ে ফিরে আসেন।
দুর্যোধনের সহায়তায় তারপর ফিরে পান হৃত গৌরব।
একলব্যকে অর্থ সম্পদ লোকবল জমি সবকিছু দিয়ে সাহায্য করেন দুর্যোধন।
এরপরে একদিন শ্রীকৃষ্ণ পুত্র শাম্ব ফিরছিলেন জঙ্গলের ধার দিয়ে। সেই সময় তাকে বন্দী করেন একলব্য।
শ্রীকৃষ্ণের কাছে খবর পাঠানো হলে শ্রীকৃষ্ণ আসেন একলা নিরস্ত্র অবস্থায়।
একলব্য শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈরথ হয়।
তখন একলব্যের মাথায় একটি বড় পাথর দিয়ে আঘাত করেন শ্রীকৃষ্ণ।
এর ফলে মারা যান একলব্য।
মারা যাওয়ার আগে
একলব্যের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে গুরু দ্রোনাচার্য্যর উপরে। তিনি বলেছিলেন যদি একলব্য তার অধীত বিদ্যার যদি অপপ্রয়োগ করে তাহলে সে মারা যাবে।
সেই অভিশাপ যদি না দিতেন দ্রোনাচার্য্য তাহলে আজ তিনি তার প্রতিশোধ নিয়ে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারতেন।
মৃত্যুর আগে একলব্য তাই শ্রীকৃষ্ণর কাছে চান আশীর্বাদ দ্রোনাচার্য্য বধের...
শ্রীকৃষ্ণ তখন তাকে দ্রোনাচার্য্য বধের আশীর্বাদ দিয়ে দেন।
জন্ম:
অপমানিত দ্রূপদ কিন্তু ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেন না।
তিনি ফিরে গিয়ে রাজ্যের জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠান আর তাদের মত অনুযায়ী করেন অগ্নিকে সাক্ষী রেখে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ।
যজ্ঞ পরিচালনা করেন দুই মহাঋষি যজ আর উপযজ। এই দুই মহাঋষি ছিলেন দুই ভাই।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আগুন থেকে উঠে আসেন ধৃষ্টদ্যুম্ন । আগুনের মতোই তার রূপ ছিল আর জন্ম থেকেই তিনি চিরযুবক।
হাতে তার অগ্নি প্রদত্ত ধনুক আর খড়্গ।
খুব আনন্দিত হন দ্রূপদ। তার অপমানের বদলা নেবার স্বপ্ন তার হাতের মুঠোয় চলে আসতে দেখে।
এই ধৃষ্টদ্যুম্নই হলেন গত জীবনের একলব্য।
এরপরে কিছুক্ষনের মধ্যেই বেরিয়ে আসেন আগুন থেকে আরেক চিরযৌবনা দ্রৌপদী।
কিন্তু রাজা দ্রূপদ এতটুকু খুশি হন না দ্রৌপদী কে দেখে, তারপর কি হয়..
সেটা পরে আলোচনা করা যাবে নাহয়
পরিবার:
একদিন ধৃষ্টদ্যুম্ন পুজো করছিলেন মন্দিরে।
সেই মুহুর্তে কাশীরাজ সুধন্য একজন রাজকুমারীকে তাড়া করছিলেন। রাজকুমারী কোকিলা সাহায্য চাইলে ধৃষ্টদ্যুম্ন পরাজিত করেন রাজা সুধন্যকে। সেটাই ছিল কোকিলা আর ধৃষ্টদ্যুম্নর প্রথম মিলন।
পরে সেই রাজকুমারী কোকিলা'কে বিয়ে করেন ধৃষ্টদ্যুম্ন।
ওনাদের চার সন্তান হয়।
চার সন্তানের নাম হল - ক্ষত্রধর্মন, ক্ষত্রঞ্জয়, মনন্দ, সত্যধৃতি।
কুরুক্ষেত্রে:
এই মহাযুদ্ধে পাণ্ডব পক্ষের হয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন হন সেনাপতি। এই যুদ্ধে অংশ নেন ওনার চার পুত্র। দ্রোনাচার্য্য ভয়ঙ্কর যুদ্ধে বধ করেন চার পুত্রকেই।
তখন শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধিতে একটা প্ল্যান করা হয় দ্রোনাচার্য্য বধের জন্য। সেই অনুযায়ী পরের দিনে ভীম বধ করেন অশ্বত্থামা নামের একটি হাতিকে। আর খুব জোরে জোরে চিৎকার করেন "অশ্বত্থামা হত" বলে।
পুত্র অশ্বত্থামা মারা গেছে ভেবে দ্রোনাচার্য্য ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করেন।
যুধিষ্ঠির বলেন- 'অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ'।
কিন্তু 'ইতি গজঃ' কথাটি বলেন খুব আস্তে।
দ্রোনাচার্য্য নিজের পুত্র সম্বন্ধে 'অশ্বত্থামা হত' শুনেই কেঁপে উঠেন, বিহ্বল হয়ে যান ফলে শ্রুতিগোচর হয়না বাকিটুকু। তবে উনি বিশ্বাসও করে উঠতে পারেন না পুরোটা। তাই অস্ত্র ত্যাগ করে সেই মুহূর্তে ধ্যানযোগে বসেন সত্যতা যাচাইয়ে।
এই সুযোগে ধৃষ্টদ্যুম্ন ওনার খড়্গ দিয়ে মাথা কেটে দেন ধ্যানস্থ দ্রোনাচার্য্যর।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী নিরস্ত্র কাউকে হত্যা করা খুব অন্যায়। এইভাবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের 15 তম দিনে মারা যান দ্রোনাচার্য্য।
মৃত্যু:
এই অন্যায় ঘটনায় অশ্বত্থামা খুব হতাশ হয়ে যান।
পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য হয়ে উঠেন ভয়ঙ্কর। 18 তম দিনে যুদ্ধ শেষ হলে অশ্বত্থামা হানা দেন গভীর রাত্রে ঘুমন্ত পাণ্ডবদের তাঁবুতে। একে একে বধ করেন নিদ্রিত শিখন্ডী সমেত দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে।
এরপরে ধৃষ্টদ্যুম্ন মুখোমুখি হলে আক্রমন করতে উদ্যত হন অশ্বত্থামা। ধৃষ্টদ্যুম্ন তার অস্ত্র নেবার প্রার্থনা জানালে অশ্বত্থামা নাকচ করে দেন। বলেন যে ওনার পিতাকে তো নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করা হয়েছিল তাই এখন আর কোন অনুরোধ গ্রাহ্য হবে না।
এরপর অশ্বত্থামা এক ঝটকায় মাথা কেটে হত্যা করেন ধৃষ্টদ্যুম্নর।
প্রতিশোধের আগুনে জন্ম যার, সেই মহাবীরের মৃত্যু ঘটল প্রতিশোধের আগুনে পুড়েই।
কিছু কিছু সময়ে আমাদের সত্যি কিছু করার থাকেনা। বলি প্রদত্ত হয়ে ভাগ্যের হাতের পুতুল হতেই হয়।
নাহলে ধৃষ্টদ্যুম্নর আর কি দোষ ছিল...
জন্ম তো ওনার হয়েছিল রাজা দ্রূপদের মনের প্রতিশোধের আগুনে আর মরণও হল অশ্বত্থামার মনের প্রতিশোধের আগুনে পুড়েই।
তবে যোদ্ধার মৃত্যু যেরকম হয়, উনিও সেভাবেই প্রায় মারা গেলেন নিজের জীবনের উদ্দেশ্য "দ্রোনাচার্য্য বধ" উনি যেভাবে করলেন ঠিক সেভাবেই।
ভাগ্য সত্যিই অদ্ভুত খেলা খেলে...