কেমন জব্দ
কেমন জব্দ
রোগ রোগ করে চারদিকে যখন সবার মাথা খারাপ অবস্থা, তখন ওই টুকু টুকু পুচকে তিনটে ছেলেমেয়ে রিক, বিষ্টু আর মন ঠিক থাকে কেমন করে।আগে তিন পরিবারের সবাই মিলে কত জায়গায় বেড়াতে যেত, কর্ণাটক, কেরালা, গুজরাট, মহারাষ্ট্রের কত সুন্দর সুন্দর
জায়গায় বেড়িয়েছে। পাহাড়ও ওদের তিনজনের খুব পছন্দের জায়গা, কিছু না হলে কাছাকাছি দীঘা শঙ্করপুরেও ঘুরে আসত। সৈয়দ মুজতবা আলির "দেশ বিদেশে"- পড়ে রিকের এত ভাল লেগেছিল যে বাবার কাছে আফগানিস্তান যাওয়ার বায়না করেছিল, শেষবেশ ওখানকার গন্ডগোলের কথা বলে ওকে নিরস্ত করা হয়েছিল। রিক অবাক হয়ে যায় স্বামী বিবেকানন্দের কথা ভেবে, বিনা টিকিটে, প্যাকিং বাক্সে লুকিয়ে শিকাগো গেছিলেন, রিকেরও খুব ইচ্ছে ওরকম কিছু করে।বিষ্টুর পছন্দের মানুষ এডওয়ার্ড জেমস করবেট, কি সুন্দর জন্তুজানোয়ারদের অবস্থান বুঝতেন, ডাক শুনে পশুপাখি সনাক্ত করতে পারতেন; কুমায়ুন-গাড়োয়ালের মানুষের খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। মন-এর পছন্দের চরিত্র ফেলুদা, ফেলুদার সব গল্প, যেমন গোয়েন্দাগিরি, হত্যাপুরি, রয়াল বেঙ্গল রহস্য, বাদশাহি আংটি, জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা, গোঁসাইপুর সরগরম- সব ও পড়ে ফেলেছে। ওদের এই ভাল লাগার জগৎ দেখে রহিম চাচা বলে- " ছেলেমেয়ে গুলান যেন রদ্ন হইসে, কত কি যে জানে এট্টুখানি বয়সে।" অভিভাবকদের মধ্যে রিকের মা আর মন-এর বাবা খুব রাগী, যেখান থেকে যত প্রশংসা জুটুক, এদের গলানো মুশকিল, দৈবাৎ প্রসন্ন হন যে যার সন্তানের ওপর।
কিশোর ত্রয়ীর বর্তমানের সুখবর, - মন-এর একটা ফুটফুটে ভাই হয়েছে, ওর মা ভর্তি আছে সল্টলেকের একটা হাসপাতালে। তিনজনে শলা করেছে মন-এর বাবার সঙ্গে ওই পুচকেটাকে দেখতে যাবে। মন-এর অবশ্য একটু মনখারাপ কি জানি মায়ের আদরটা তার প্রতি যদি কমে যায়; খেতে বসে মাছের মাথাটা যদি সে আর না পায়; যদি ওর পুতুলের ভাগ চায়। বিষ্টু ওকে বুঝিয়েছে,-" ওরে তোর ভাই-এর মাছের মাথা চিবোতে দেরীআছে, ভাই বড় না হওয়া অব্দি ওটা তুই-ই পাবি।"মন তাতেও একটু অনিশ্চয়তায় আছে; তবে প্রচ্ছন্ন একটা আনন্দও আছে, ওর পুতুলের সংসারে নতুন একটা জ্যান্ত পুতুল যোগ হচ্ছে বলে। কথা মতো মন-এর বাবা প্রথমে বিষ্টু, পরে রিককে তুলে নিল; " নতুন ভাইপুতুলটার জন্য বাবার রাগ ভাবটাও কম আছে,"- মনে মনে ভাবে মন। গাড়িতে মন-এর ছোটপিসীও আছে, সঙ্গে খাবার, ফলফলাদি নিয়েছেন মনের মায়ের জন্য।
বাড়ি থেকে বেরোতে পেরে তিনজনই মহাখুশি, গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরেটা গিলছে; গাড়ি থামতেই রিক বলে উঠল-" যা! এসে গেল।" স্ট্যান্ডে গাড়ি রাখতে গেল মনের বাবা, ওরা অপেক্ষা করছে, একসঙ্গে ঢুকবে; হঠাৎ রিকের পাশ দিয়ে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল এক মাঝবয়সী মহিলা; ওরা অবাক চোখে দেখল, মহিলা ছুটতে ছুটতে গিয়ে একটা লাল মারুতি গাড়িতে উঠল, সঙ্গে ছিল একটা ঢাউস ব্যাগ। মনের বাবা আসতে ওরা ভেতরে ঢুকল, তিনতলার কেবিনে আছেন মনের মা, বেবি কটে শুয়ে মনের পুচকে ভাই, যেন নরম মাখনের দলা। ওরা সবাই জ্যান্ত পুতুলটাকে নেওয়ার জন্য উসখুস করছে, কিন্তু অনুমতি নেই, পাছে ভাইপুতুলটার সংক্রমণ হয়ে যায়। মন মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল, মাও ওকে আদর করছে।ছোটপিসী সঙ্গে আনা খাবারগুলো বার করে গুছিয়ে রাখল। রিক কান খাড়া করল, নার্সেসরুম থেকে একটা গন্ডগোলের আওয়াজ আসছে না, বিষ্টুকে ইশারা করে করিডর পেরিয়ে দুজনে দাঁড়াল রুমটার সামনে।
এক অল্পবয়সী বউ হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে, আর নার্সদের মধ্যে কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে, কেউবা রাগ দেখাচ্ছে; মোটকথা একটা হুলস্থূল অবস্থা, ওয়ার্ড বয়রা ছোটাছুটি করছে, একজন পুলিশও চোখে পড়ল। ওরা শুনল কাঁদতে কাঁদতে বউটা বলছে-" হমরি বাবুয়া কো কোন লে গয়া উঠাকে,"- বেঁটে মতো চেহারার একজন নার্স বলছে- " এমন ঘুম ঘুমোলে, বাচ্ছাটার খোঁজ রাখলে না।" মন কখন ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, ওদের সবারই চোখ গোল গোল, এটুকু বুঝতে পারছে মনের ভাইয়ের মতো ছোট্ট একটা পুতুল হাসপাতাল থেকে চুরি গ্যাছে। রিক মনকে ওর বাবার মোবাইলটা ম্যানেজ করতে বলল, মন ভয় ভয় বাবার কাছে এসে মোবাইলটা চাইল; বাবা রাগতভাবে তাকালেন, নতুন কোন দুষ্টুমির মতলব আছে ভেবে, তবুও দিলেন। মোবাইল হাতে পেয়ে, রিক ওর মামা
পুলিশ ইনস্পেক্টার রঙ্গনকে এখানে যা ঘটেছে বিস্তারিত জানাল। এলাকাটা রঙ্গনের এরিয়াতেই পড়ে, অভিযোগ থানাতেও পৌঁছেছে, মামা নিজেই আসছেন।
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ায় মনের বাবা আর পিসী করিডর দিয়ে এগিয়ে এলেন ওদের কাছে, এইমুহূর্তে ওদের নড়বার ইচ্ছে নেই। একান্ত বাধ্য হয়ে মনের ভাইপুতুলটাকে একবার দেখে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল, মামার সঙ্গে আর দেখা হল না। রাস্তায় মন "খিদে পেয়েছে, খিদে পেয়েছে "- আব্দার করায় মনের বাবা একটা সাউদ ইন্ডিয়ান খাবারের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করালেন। ধোসার অর্ডার দিয়ে ওরা বসে আছে, দেখল হাসপাতালের ওই ছুটে যাওয়া মহিলা, একজন লোকের সঙ্গে ঢুকছে, সঙ্গে ঢাউস ঝোলা ব্যাগটা নেই। রিক বিষ্টুকে ইশারা করল, মনও বাবার পকেট থেকে সন্তর্পণে মোবাইলটা তুলে নিল; হাত ধুতে যাওয়ার অছিলায় পর্দার আড়ালে তিনজন এক হয়ে রঙ্গনকে মেসেজ করল। জায়গাটা হাসপাতাল থেকে বেশী দূরে নয়, মেসেজ দেখে রঙ্গন যদি পৌঁছায়- এই আশায় ওরা বসে রইল; ওদের ষষ্ঠেন্দ্রিয় অপরাধের গন্ধ পাচ্ছে, রিকের সন্দেহ কখনো ভুল হয় না।
ধোসা এসে গ্যাছে, খেতে শুরু করল ওরা, নজর কিন্তু ওই
মহিলা আর ওর সঙ্গীর দিকে, কয়েকটা টেবিল পরে ওরা
কফি খাচ্ছে।মনের ভেতরটা ধুকপুক করছে কফি খাওয়া
শেষ হলে, রিকের মামা পৌঁছনোর আগেই যদি ওরা বেরিয়ে যায়। দুটো কমবয়সী ছেলেমেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল, পেছন পেছন রিকের মামা রঙ্গন, সাদা পোষাকে; ওদের দিকে না এসে দূরে একটা টেবিলে বসলেন, রিক ইশারায় মহিলাকে দেখিয়ে দিল। খাওয়া শেষ হলে মনের বাবা, পিসীর সঙ্গে ওরা বেরোল, রিক পেছন ফিরে মামাকে একবার দেখে নিল।
বিষ্টু বাড়িতে জানিয়ে রিকের বাড়িতে নেমে পড়ল, মনরা
চলে গেল; দুজনে এখন উত্তেজনার তুঙ্গে, মামার কাছ থেকে কোন খবর আসার অপেক্ষায় বসে রইল, মনকে ওর বাবা ছাড়লেন না, নাহলে ও-ও থেকে যেত।
রঙ্গন দোকানের বাইরে দুজন অ্যাসিস্টেন্টকে সাদা পোষাকে মোতায়েন রেখেছেন, একজন ভিক্ষুক অপরজন ফেরিওয়ালার বেশে। পুলিশ সার্কেলে বাচ্ছা চুরির ঘটনায় সন্দেহের তালিকায় যেকজনের স্কেচ আঁকা
আছে তারমধ্যে একজনের সঙ্গে মহিলার চেহারা হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিছুতেই এদেরকে নজর এড়িয়ে বেরিয়ে যেতে দেওেয়া যাবে না, রঙ্গন সজাগ থাকলেন। কফি শেষ করে বিল মিটিয়ে সন্দেহভাজনরা দোকান ছাড়ছে,
রঙ্গন-ও উঠে পড়লেন। লাল মারুতি ছাড়তেই রাস্তা থেকে ভিক্ষুক মানে এসআই জয়সওয়াল আর ফেরিওয়ালা- এসআই নকুল রঙ্গনের গাড়িতে উঠে পড়ল। লাল মারুতিটা অনেক ঘুরপাক খেয়ে চিংড়িঘাটার রাস্তা ধরল, রঙ্গন খানিকটা তফাৎ-এ, ফোন করে অলরেডি আরো
পুলিশ ফোর্সের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। একটা হলুদ দোতলা বাড়ির সামনে গাড়িটা থামল, ওরা ঢুকে যাওয়ার পর, রঙ্গনরাও সন্তর্পণে পিছু নিল। অনেকগুলো জুতো, চটি একটা দরজার সামনে ছড়ানো, যতটুকু দেখেছে রঙ্গন, এই ঘরটাতেই ওরা ঢুকেছে। ভেতরে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ, নীচে বাকী ফোর্স এসে গ্যাছে, রঙ্গন টের পেল। খুব সাবধানে কাজ সারতে হবে, ভেতরে বাচ্ছারা আছে; রঙ্গন কলিং বেল বাজাতে ঢ্যাঙা, রুক্ষ চেহারার একটা লোক দরজা খুললো। জয়সওয়াল লোকটাকে টুঁ শব্দ করতে না দিয়ে সিঁড়ির আড়ালে কায়দা করে ফেললো। রঙ্গন আর নকুল ঘরে ঢুকেই কাউকে কোন সুযোগ না দিয়ে ধরে ফেললো দলের চাঁইগুলোকে; সিঁড়িতে ফোর্সের পুলিশদের বুটে শব্দ। কত মায়ের কোল খালি করে বাচ্ছাগুলোকে এখানে জড়ো করেছে; ওরা ঠিক সময়মতো না পৌঁছলে বাচ্ছাগুলো কোথায় হারিয়ে যেত ভেবে রঙ্গনের শক্ত হাত দুটো নিসপিস করছে। বাছাধনরা পুলিশের গাড়িতে চলল লকআপে; বাচ্ছাগুলোর ব্যবস্থাও করতে হবে, রঙ্গনের এখন অনেক কাজ, এর-ই ফাঁকে রিককেও সব জানিয়ে দিল।
রিক, বিষ্টু, মন- এই অভিযানে সরাসরি অংশ নিতে না পারায় একটু মনমরা, তবে বাচ্ছাগুলো বাড়ি ফিরতে পারায় খুব খুশি। অপরাধী ধরায় সাহায্য করার জন্য প্রশাসন, পুলিশ ও হাসপাতালের তরফ থেকে অনেক শুভেচ্ছা পেল। মন-এর ভাইয়ের ওপর আর হিংসে নেই,
ভাগ্যিস তার ভাইপুতুলকে দুষ্টুলোকেরা চুরি করে নি।