চিঠি লেখার অভিজ্ঞতা
চিঠি লেখার অভিজ্ঞতা
হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো
মন
তোমার চিঠি পেলাম, অনেকদিন অপেক্ষার পরে। তোমার চিঠি আসতে দেরী হলেই কেমন ভয় ভয় করে... মনে হয় তুমি আমার ওপরে রাগ করেছ, না কি ভুলেই গেছ আমাকে...
জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না
হায় ভীরু প্রেম হায় রে...
আশার আলোয় তবুও ভরসা পায় না
মুখে হাসি তবু চোখে জল না শুকায় রে...
বার বার পড়েই চলেছি, চিঠিটা। মুখের হাসি তো মিলিয়েই গেছে আমার, আর চোখের জল তো বাধাই মানছে না।
কতদিনের পরিচয় আমাদের... মন আমার! এখনও আমি ভরসা যোগাতে পারলাম না তোমাকে, আমার ভালবাসায়...
আমার অযোগ্যতা প্রমাণিত হলো আরও একবার।
শুনেছি, মাত্রাহীন সংরক্ষনশীলতা আর অতি-অধিকার- প্রবণতা না কি অদম্য ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ! মানছি... কিন্তু সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্যে যে বিশ্বাস- ভিতের প্রয়োজন, তার অভাবে যে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায় ভালবাসার রাজপ্রাসাদ... আমাকে বেঁধে রাখার জন্যে তোমার এই উগ্র আগ্রহ প্রথম প্রথম বেশ উপভোগ করতাম আমি... কিন্তু সেই রক্ষণশীলতা বাড়তে বাড়তে কখন যে অসুখের পর্যায়ে পৌঁছে গেল... যে রোগের কোনও চিকিৎসাই হয় না। আমাকে তো কষ্ট দাও তুমি, নিজেও কিন্তু খুব কম কষ্ট পাও না।
সব শুনে দেবাংশী বলেছিল, "খুব ভালবাসে রে তোকে... আজকাল এইরকম ভালবাসা দেখা যায় না। এই ধরণের প্রেমকেই বোধহয় কবিগুরু 'রাহুর প্রেম' এর আখ্যা দিয়েছিলেন।"
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া
লোহার শিকল ডোর..."
'কিন্তু দেবী, এইরকম কণ্ঠরোধ করে দেওয়া ভালবাসা তো আমি চাই না রে... দুজনের ভালবাসার মধ্যে যদি মুক্ত আকাশই না থাকবে, আমরা শ্বাস নেব কী করে? আমিও তো ওকে খুব ভালবাসি দেবী, কিন্তু চক্ষে হারাই না।'
আমি বড় বেশী অকপট তোমার কাছে। নিজেকে বোধহয় সম্পূর্ণ করে মেলে ধরতে নেই, প্রেমাস্পদের সামনে। কিছুটা রহস্যময়তা, কুয়াশার আবরণের মতো হয়তো সম্পর্কটাকে মোহময় করে তোলে।
তোমার থেকে এত দূরে থাকি, তোমার অভাব প্রতি মুহূর্তে আমি এত বেশী অনুভব করি... আমার প্রায় সব চিঠিগুলোই দিনপঞ্জিকার রূপ ধারণ করে, তুমিও তো বল, আমার চিঠি পড়তে তোমার খুব ভাল লাগে। তোমার মনে হয় আমার স্পর্শ, ঘ্রাণ সবই পাচ্ছ তুমি...
কিন্তু এ তুমি কী লিখেছ মন? আমাদের দুজনের রাস্তা না কি আলাদা! আমাকে চলতে বলেছ আমার রাস্তায়... বললে আমি না কি দু'নৌকোয় পা দিয়ে চলার চেষ্টা করছি... আমার চরিত্রের কোনও ঠিক নেই..
হ্যাঁ, আমিই তোমাকে জানিয়েছিলাম, রবীন্দ্রর সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কথা... সে নিজেই এসে পরিচয় করতে চেয়েছিল আমার সঙ্গে। আমাকে তুমি এখনও চিনে উঠতে পারলে না গো, তুমি তো আমার মন! আমি মানুষ ভালবাসি, নানারকমের মানুষের সঙ্গে মিশতে ভাল লাগে আমার। কিন্তু তুমি! তুমি তো একজনই! মন, তোমার যায়গা তো কখনই কাউকে দিইনি আমি, দিতে পারবও না।তুমি লিখেছ, আর দেখা হবে না আমাদের! তোমার মন তুমি গচ্ছিত রেখেছিলে আমার কাছে, বড় যত্নে- আদরে লালিত করেছি তাকে... অনাদর করিনি কখনও... কিন্তু আমার মনটাও যে বাঁধা পড়ে আছে তোমারই কাছে, মন... কী ব্যবস্থা করলে তার?
ছটফট করে মরছে হয়তো বা...
আদর কর, আদর কর আমার মন- পাখিটাকে, খাঁচায় ভরে রেখ না গো... পোষ মানা তো, ছেড়ে দিয়ে দেখই না... দেখবে কোথাও যাবে না সে, ঘুরঘুর করবে তোমার পাশে পাশেই... ডানাদুটো তো কবেই ছেঁটে দেওয়া হয়েছে তার, উড়তে চাইলেও পারবে না গো...
তুমি লিখেছ, আমাকে না কি চিনতেই পারনি তুমি... আমি না কি পুরুষ ঘেঁসা... ছেলেদের সঙ্গই বেশী ভাল লাগে আমার। কে বলে, চিনতে পারনি মন! একদম ঠিক বুঝেছ। ছোটবেলা থেকেই আমি এইরকমই, চরিত্রগত কারণে।
আমার মা'র জ্যোতিষার্ণব কাকামশাই আমাকে দেখার পরে মা'কে বলেছিলেন 'তোর মেয়ের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যগুলো পুরুষালী।'
মেয়ে স্কুলে পড়তাম কিন্তু পাড়ায় আমার সব বন্ধুই ছিল ছেলে। মেয়েদের চাইতে ছেলেদের সঙ্গেই বেশী সহজ হতে পারি আমি... তারা কিন্তু শুধুই আমার পরিচিত মন, তার বাইরে আর কিছু না।
তুমি হয়তো গুছিয়ে নিয়েছ নিজেকে, নিজের মতো করে। তাই হোক মন! আমি- হীন তোমার জগতেই সুখী থাক তুমি... কিন্তু তোমাকে ছাড়া যে আমার কোনও অস্তিত্বই নেই গো...
যদি আরো কারে ভালবাস
যদি আরও ফিরে নাহি আস
তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও
আমি যত দুখ পাই গো...
খুব খুউব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমাকে... তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে... মন আমার।
আর দেখা হবে না আমাদের! তাহলে আর বেঁচে থেকে কী লাভ বল? কিন্তু কীভাবে শেষ করে দেব নিজেকে... কিছুই করবার দরকার অবশ্য নেই, তুষের ধিকিধিকি আগুনে পুড়ে পুড়েই মরে যাব একদিন। হয়তো বা বেঁচে থাকব অর্ধমৃত হয়ে…
মরব না, বুঝি বা এই আশাতেই, যে কোনোদিন কখনও তুমি বাড়িয়ে দেবে তোমার হাত
'পথিক ওগো, থাক থাক...'
আমার বড় ঘুম পাচ্ছে মন, কতদিন যে ঘুমোইনি আমি... তুমি আসবে তো স্বপ্নে? স্বপ্নেই এস না হয়, ভালবেস... তোমার শুধু তোমার
মন ।