ছুটির কথা
ছুটির কথা
১৯৮৫-১৯৮৬ চাতরা নেতাজী বালিকা শিক্ষা নিকেতন
এই কটা বছর ছুটি মানে দারুণ মজা। কখন বাড়ি যাবো এই ভেবে। হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরতাম। মসলন্দপুরের স্কুলের বন্ধুরা এত ভালোবসতো আমায় আজো মনে পড়লে কষ্ট হয়। যারা হোস্টেলে থাকতো না তাদের অনেকেই গরমের ছুটিতে আমি বাড়ি আসার আগে একটা বড় ব্যাগ ভর্তি আম,জামরুল ভরে দিতো। একমাস দেখা হবেনা সেই দুঃখে। এমন এক একটা ছুটির সময় এমনো হয়েছে,হয়ত ব্যাগ গুছিয়ে নিজের বেডিং ভালো করে বেঁধে রেখে দিতাম। একজন একজন করে সবার বাড়ির লোক এসে নিয়ে যেতেন আর আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম কখন আপু বা গোপালদা আসে। চারটে বাজতো পাঁচটা বাজতো শেষে অন্ধকার হয়ে যেতো। আসলে আমার ফেরার দিন টা মা বাবা হয়ত ভুলে যেতো তাই কেউ আসতো না। আমি স্কুলের ফোন থেকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতাম তোমরা কাউকে পাঠালে না আমায় নিয়ে? ওপাশ থেকে জবাব আসতো 'এমা একদম ভুলে গেছি আজ তোর ছুটি শুরু কাল ভোরের ট্রেনেই গোপালকে পাঠাচ্ছি'। আমিও কাঁদতে কাঁদতে হোস্টেলে ফিরে আসতাম। আমি একা নই মিষ্টুদি রুম্পাদি আরো দুচারজন থাকতাম একসাথে একঘরে। ছোড়দি এসে ব্যপারটা হাল্কা করার জন্য বলতেন ' সেজে গুজে রইলাম বসে নিয়ে গেলোনা চোপার দোষে। আজ রাতে তবে লুচি করতে বলি কি বলিস' বলেই হাসতেন মিটিমিটি। আমি মনে মনে ভাবতাম কতটা ব্রাত্য হলে মা বাবা ভুলে যায়!
১৯৮৮-১৯৯০ ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন।
যখন ক্লাস নাইন তখন সোমা ক্লাসে ক্যাপ্টেন আমি মনিটর। সেটা আবার বদলেও যেতো কিছুদিন পর পর। সোমা অতি সততার সাথে যত্ন করে ব্ল্যাক বোর্ডে আমার নামটাই এক নম্বরে লিখে রাখত। তার বন্ধুর উপর এতটাই বিশ্বাস যে পুরো ক্লাস চুপ থাকলে আমি মনিটর হয়েও সব থেকে বেশি ডিসটার্ব করব। আর তখন যেন ক্লাস চলা কালীন খালি মনে হত কখন শাস্তি দিয়ে আমায় ক্লাসের বাইরে পাঠাবে। আমায় পাঠালেই পাশের ক্লাস থেকে নবনীতাও বেরিয়ে আসতো ব্যাস আমাদের খিল্লি শুরু। সোমা গুড গার্ল তাই শাস্তি পেতোনা বেচারা আড্ডাটা মিস করত। সেই সময় বাড়ি আসতে ছুটিতে মোটেও ভালো লাগতো না। বাড়ি আসার তখন একজনই কার
ণ ছিলো। সে না থাকলে আমার বাড়ি ফিরতেই ভালো লাগতো না। কিন্তু স্কুল ছুটি হলে হোস্টেলের মেয়েদের বাড়ি ফিরতে হত এটাই নিয়ম। আজো মিস করি শালপাতায় গরম ঘুঘনি,ডিমের চপ স্কুল ক্যান্টিনের। সাদা স্কার্ট শার্ট আর সবুজ ফিতে দিয়ে দুটো ঝুঁটি। আমার এই স্কুলের বন্ধুরা আজো আছি হাতে হাত ধরে কয়েকজন। আমি লাকি যে আমি সোমা নবনীতা বৈশাখী আজ এতবছরেও কেউ কারো থেকে দূরে যাইনি। সাথে অঙ্গনা অর্বা স্বাতি বর্নালী সুতপা আরো কয়েকজন জুড়ে আছি।
১৯৯১-১৯৯৭- চিত্তরঞ্জন কলেজ
গার্গী জয়শ্রী সুতপা মেহেলি সঞ্জয় সম্রাট অভিজিৎ সুব্রত রঞ্জিত দেবাংশুদা প্রকাশদা। এদের সাথেই কেটে গেছে কয়েকটা বছর। যোগাযোগ রয়েছে অনেকের সাথেই। তখন তো পুরো বখে যাওয়া মেয়ে আমি। কলেজ ছুটি দিতো প্রায় দুমাস।একমাস পরেই বাড়িতে বলে দিতাম সবাই কলেজ খুলে গেছে। সারাদিন কফি হাউসে নয় কলেজের কমনরুমে আড্ডা দিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরতাম। কোন কোন দিন সবাই সিনেমা দেখে গড়েরমাঠে ঘুরেই কলেজের ক্লাস করতাম। কিন্তু ভালো মেয়ের মত পাঁচটায় বাড়ি ফিরে আসতাম ঠিক। এই চক্করে তো আমার জন্য সোমার 'গন উইথ দা উইন্ড' সিনেমাটা পুরো দেখাই হয়নি। এত বড় যে তিনবার ইন্টারভেল ছিলো, আমি সেকেন্ডেরটায় বেড়িয়ে এসেছিলাম সোমাকে নিয়ে। এই কটা বছর আমি জীবনের সেরা কিছু সময় কাটিয়েছি। আসলে বন্ধুদের মত আপন আর ভালোবাসার মানুষ আমি কম দেখেছি সে স্কুলের হোক বা কলেজের।
১৯৯৯-২০২০
অনেক লম্বা এই জীবনটা। বাবা একেবারেই ছুটি দিয়ে দিলো তার বাড়ি থেকে। এখন বড্ড দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি ছুটি চাইছি এমনই একঘেয়ে জীবন থেকে। কেন জানিনা সবসময় মনে হয় আমার জীবনে আমারই কোন প্রাধান্য নেই। প্রতিটাদিন আমি অন্যদের জন্য বাঁচছি। কেন? আর তো হাতে গোনা কয়েকটা দিন আছে। আমারো খুব ইচ্ছে করে একা একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেড়িয়ে পরি আমার মনের মত জায়গায় নিজের সাথে নিজে সময় কাটাতে। কখনো সেটা জঙ্গল হোক বা পাহাড়। নয়ত অচেনা কোন গ্রামেই কাটাই কয়েকদিন। আমার মত অনেকেই চায় এমন ছুটির দিন জানি কিন্তু বলতে পারেনা। মোদ্দা কথা আমার এবার লম্বা ছুটি চাই।