mousumi roy

Tragedy Crime Thriller

3  

mousumi roy

Tragedy Crime Thriller

ঘাতক শূন্যতা

ঘাতক শূন্যতা

7 mins
300


অনিরুদ্ধর শরীর দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। দিল্লির বড় বড় ডাক্তাররাও কিছু আশা দিতে পারছে না। নবাগতা এত অসহায় হয়েছিলো শেষবার যখন বাবা ছেড়ে চলে যান। সবাই বলত খুব বাজে অসুখেই তার বাবা মারা গেছে। আজ সে বুঝতে পারছে কি হয়েছিলো তার বাবার,কেন তার পর মা সমাজ আত্মীয় স্বজন সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। শিক্ষিতা মহিলা ছিলেন, অনেক কষ্টে দিল্লিতে চাকরি নিয়ে চলে আসেন। মুন্নিকে মানে নবাগতাকে এখানেই বড় করে তোলেন। খুব সহজ সুন্দর পরিবেশে মানুষ করেন তিনি মেয়েকে। সম্পূর্ণ সংস্কার মুক্ত ভাবে।

 

মুন্নি যখন চাকরিতে ঢোকে সেখানেই তার সিনিয়র অনিরুদ্ধ সেনের সাথে পরিচয় এবং ভালোবাসার সুত্রপাত। অনিরুদ্ধ বয়েসে প্রায় বছর দশেকের বড়ই মুন্নির থেকে। সুপ্তি রায়, মুন্নির মা

তাঁর অল্প আপত্তি ছিলো এই বিয়েতে কারণ তিনি মেয়ের জন্য আরো ভালো কিছু ভেবেছিলেন। কিন্তু তিনি বাঁধাও দেননি মেয়েকে, সে যদি সুখী হয় তার বড় কিছু হয়না। মুন্নির বিয়ের বছর খানেকের মাথায় চন্ডীগড় হাইওয়েতে গাড়ি এক্সিডেন্টে সুপ্তি মারা যান, স্পটডেড। যে ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট সে ট্রাক টা ধরা যায়নি।

 বেশ ভালোই কাটছিলো মুন্নির বিবাহিত জীবন, সারাদিন দুজনেই অফিসে থাকত। মুন্নি এরপর সন্তানসম্ভবা হলে অনিরুদ্ধ তাকে চাকরি টা ছেড়ে দিতে বলে, তার যথেষ্ট স্বচ্ছল অবস্থা। পরে নাহয় আবার চাকরি করবে বছরখানেক সে বিশ্রামে থাকুক আর সুস্থ সন্তানের জন্ম দিক। মুন্নিও মেনে নেয় এ প্রস্তাব, সেও পারছিলো না ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলো। পাশের ফ্ল্যাটের মিত্র আন্টিকে বলে..

- আমায় একটা ভালো মেইড দিতে পারেন আন্টি, একা আমি এত কাজ করতে পারছিনা। 

- দাঁড়া মিসেস চাড্ডার বাড়িতে একটা অল্প বয়েসি মেয়ে মাস দুয়েক ধরে আছে, আমায় একবার কাজের কথা বলেছিলো। ওরা নাকি বড্ড খাটায় মাইনেপত্র ভালো দেয়না। 

- বেশ তুমি বলে দেখো, সারাদিন আমার সাথে থাকবে হাতে হাতে কাজ করবে।

-তবে ও কিন্তু শনি রবি দুদিন ওর বাড়ি চলে যায়।

- ওই দুদিন অনি বাড়িতেই থাকে ট্যুর না থাকলে অসুবিধা হবেনা। 


মিসেস মিত্র মেয়েটিকে নিয়ে আসেন মুন্নির কাছে, মেয়েটার মুখটা বড্ড চেনা চেনা লাগে।

মুন্নি জানতে চায় মেয়েটির কথা.. 

-আমার নাম পিয়ালি, বাড়িতে মা আর স্বামী আছে। স্বামী অসুস্থ তাই আমাকেই কাজ করতে হয়। চৌক বাজারের কাছে ছোট্ট ঘরে ভাড়া থাকি, যাতায়াত খরচা বেশি তাই শনি রবি বাড়ি যাই।

- তুমি বরাবর এখানেই থাকো? 

- না বারাসাতের বাসিন্দা, বিয়ের পর এখানে আসি। মা একা তাই মাকেও নিয়ে আসি। স্বামী এখানে সোনার দোকানের কারিগর ছিলো। হাঁপানি বাড়ায় কাজ ছেড়ে দিয়েছে। 

- কাল থেকেই কাজ শুরু কর, চাড্ডারা কত দেয় মাইনে?

-সাড়ে চারহাজার, কিন্তু সব কাজ করায়,আর খেতেও দেয় খুব কম দিদি।

- ঠিক আছে আমি পাঁচ হাজার দেব, কিন্তু খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাজ চাই। নিজের মত থাকবে। 


পিয়ালি চলে যায়, মুন্নি ভাবে এত সুন্দর দেখতে মেয়েটা কপালের কি পরিহাস। কিন্তু কোথায় যেন দেখেছে সে মনে করতে পারছেনা। পিয়ালি পরেরদিন থেকেই কাজ শুরু করে, খুব যত্ন নিয়েই। কিছু বলে দিতে হয়না যখন যেটা দরকার সে হাতের কাছেই এনে দেয়। অনির কাছেও খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ সে মুন্নিকে খুবই যত্নে রাখে। সবই ঠিক ঠাক চলছিলো। মাঝে মাঝে অনি বাইরের কাজে যেত দু তিনদিনের জন্য। শুক্রবার গিয়ে রবিবার ফিরে আসত। দুটো দিন মুন্নির খুব একা লাগতো। কিছুদিন ধরে পিয়ালির শরীরটাও ভালো নেই কাশি জ্বর লেগেই থাকছে। মুন্নি সন্তানের কথা ভেবে পিয়ালিকে একমাসের মাইনে দিয়ে কাজ ছাড়িয়ে দেয়। মনে ভয় হয়েছিলো যদি কোন ইনফেকশন তার শরীরেও ছড়ায় তবে সন্তানের ক্ষতি হতে পারে।


পর্ব ২


সময় মত মুন্নির এক কন্যা সন্তান জন্মায়, সুস্থ স্বাভাবিক শিশু। অনিরুদ্ধ আর মুন্নি দুজনেই খুব খুশি। নার্সিং হোম থেকে সাতদিন বাদে বাড়ি ফিরে আসে। পাশের বাড়ির মিসেস মিত্র শাঁখ বাজিয়ে নতুন অতিথিকে ঘরে তোলেন। এবং কি কি করতে হবে পরামর্শ দেন। অনিরুদ্ধ দুবেলার জন্যই আয়ার ব্যবস্থা করে দেয়,কারণ বাড়িতে দ্বিতীয় কোন মানুষ না থাকায় মুন্নির একার পক্ষে খুবই অসুবিধা হয়ে যেত। দিনের বেলার যে আয়া তার নাম নাগমা, সব বাঙালি বাড়িতে কাজ করে তার বাংলাটা ভালোই রপ্ত হয়েছে। এই অলকনন্দাতে প্রচুর বাঙালির বাস। নাগমা ভালো দেখাশোনা করে বাচ্চার খুব যত্ন নিয়ে আর মুন্নির ও। রান্নার লোক একবেলা এসে রান্না করে দিয়ে গেলেও, নাগমা মুন্নির জন্য কিছু স্পেশাল খাওয়ার মাঝে মাঝে করে দেয়, যাতে সে শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমান দুধ দিতে পারে। একদিন দুপুরে বাচ্চা ঘুমালে দুজনের মধ্যে কথা হয়...

-নাগমা তোমার বাড়ি কোথায়, কে কে আছেন? 

- জী চৌক বাজারে ভাড়া বাড়িতে থাকি আমার বাড়ি দেরাদুনে। এখানে আমার স্বামীর ঝুটা গেহনার দুকান আছে। আর কেউ নেই ছেলে গাঁওয়ে আম্মির কাছে থাকে পড়ালেখা করে।

- এই তুমি পিয়ালিকে চেনো।ওর বাড়িও চৌক বাজারে ছিলো, ও আমার বাড়িতে কাজ করেছে কয়েকমাস। অসুখ করেছিলো তাই ছাড়িয়ে দিলাম। 

- যার স্বামী ট্রাক চালাতো পাঞ্জাবি আদমি? 

- না বাঙালি ছিলো, সাথে মাও থাকতো। 

- না দিদি পিয়ালি একজন ছিলো গতমাসে মারা গেলো বাজে রোগ হয়েছিলো, ওই ট্রাকওয়ালাদের বিবিদের হয় খুব খারাপ অসুখ। কিন্তু ওর স্বামীর কুছু হয়নি সে ভালো তান্দরুস্ত আদমি, এখানকার ঘর ছেড়ে চলে গেছে। 

- ইসস খুব বাজে লাগছে.. কি কর এমন হোলো ওর

- ওর এক আশিক ছিলো, হসপিটালের স্টাফ তারো ওই খারাপ অসুখ ছিলো। ও জানতো তাওভি ওর সাথে সব করেছিলো। জেনে বুঝেই

- ওর বর কিছু বলেনি

- কে জানে লোকটা কেমন চুপচাপ থাকতো সবসময়, লড়াই ঝগড়া করত না। পিয়ালির সব সামান বাড়িওয়ালি কে দিয়ে কোথায় চলে গেছে। 

- হুম বুঝলাম। খুব খারাপ লাগছে মেয়েটার জন্য। 


কিছুদিন পর অনিরুদ্ধর শরীর অসুস্থ হয়, সে গোপনে চিকিৎসা করায় কিন্তু মুন্নিকে কিছু জানতে দেয়নি। আর বাচ্চা হওয়ার কয়েকমাস আগে থেকেই দুজন আলাদা ঘরে থাকা শুরু করেছিলো। তাদের মধ্যে কোন শারীরিক সম্পর্ক ছিলোনা। এটা ডাক্তারের মানা ছিলো স্বাভাবিক ভাবেই। তাই মুন্নি প্রথম প্রথম কিছু বুঝতে পারেনি। যখন বাড়াবাড়ি পর্যায় গেলো তখন সে জোর করে অনিরুদ্ধ কে। বাচ্চাটার সবে ছয়মাস বয়স... 

- বল অনি কি হয়েছে তোমার, কিছু লুকাচ্ছ আমায়। কি এমন অসুখ করল যে দিন দিন তুমি আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ। এবার ডাক্তারের কাছে আমিও যাব। 

- আরে না মুন্নি তোমার যেতে হবেনা আমি নিজেই পারব সব। তুমি তোমার আর বাচ্চার খেয়াল রাখো। দরকার হলে আমি ব্যাঙ্গালোরে যাব ট্রিটমেন্টের জন্য।

- আমার মন কু ডাকছে অনি আমি বাপিকেও দেখেছিলাম রোজ জ্বর হত কাশতো, একদিন হসপিটালে গেলো আর ফিরলোনা।

- ধুস কিসসু হয়নি আমার সব ঠিক হয়ে যাবে।


পর্ব ৩


হটাৎ একদিন অফিস থেকে ফোন আসে মুন্নির কাছে, অনিরুদ্ধ খুব অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। মুন্নি যেন তার সব প্রিভিয়াস রিপোর্ট নিয়ে তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসে। খুব নার্ভাস হয়ে যায় সে কি করবে, কার কাছে যাবে বাচ্চাটা যে একা। তার এই অবস্থা দেখে নাগমা বলে... 

- দিদি তুমি জলদি যাও, আমি বেবির কাছে থাকব আর মিত্র আন্টিকে বলে যাও উনিও যদি এখানে থাকেন। তুমি বেবির জন্য চিন্তা কোরোনা আমি আছি তো। 

মুন্নি যত তাড়াতাড়ি পারে সব রিপোর্ট নিয়ে মিসেস মিত্র কে বলে হসপিটালে পৌছায়।

তখন অনিরুদ্ধ স্পেশাল কেবিনে অজ্ঞান অবস্থায়। মুন্নি রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যায়। 

 

কি শুনলো সে! ডাক্তার ঠিক বলছেন তো কোথাও কোন গন্ডগোল হচ্চেনা তো? অনির এ অসুখ কি করে হতে পারে,মুন্নি কান্নায় ভেঙে পড়ে। ডাক্তার বোঝায় তাকে... 

- ম্যাডাম আপনি ভুল বুঝবেন না এই অসুখ শুধু শারীরিক সম্পর্কের জন্যই হয়না, আরো কারণ থাকে। আপনি অনিরুদ্ধর পাশে থাকুন, ওর এখন সব চেয়ে বেশি আপনাকে প্রয়োজন। 

- কিন্তু সবাই শুনলে তো অনিকেই খারাপ ভাববে এখন কি করব আমি। বাচ্চাটাও যে সবে পৃথিবীতে এলো, সে তার বাবাকে কি দেখতেও পাবেনা? 

- এই কথার জবাব এই মুহুর্তে নেই আমাদের কাছে, আপনি স্থির থাকুন।

মুন্নি অপেক্ষা করে অনিরুদ্ধর জ্ঞ্যান ফেরার। 

ঘন্টা কয়েক পর নার্স এসে খবর দেয় যে সে এবার দেখা করতে পারে পেশেন্টের সাথে।

- অনি ঠিক আছো?

- হুম, তিন্নিকে কার কাছে রেখে এলে? 

- নাগমা আর মিত্র আন্টির কাছে। তোমার এ অসুখ কিভাবে হোলো অনি? 

- মুন্নি আমায় ক্ষমা করে দাও, এক দূর্বল মুহুর্তে আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি।

- কে সে? 

- পিয়ালি 

- কি বলছ কি একি অবান্তর কথা এমন হতে পারে? 

- হুম মুন্নি সেই ভুলের মাশুল গুনছি। জানিনা আমি আর কতদিন বাঁচব। আমার আলমারি তে একটা সাদা খামে পিয়ালি তোমার জন্য চিঠি রেখে গেছে।আমি খুলিনি তুমি বাড়ি ফিরে দেখো কি লেখা তাতে, হয়ত সেও ক্ষমা চেয়েছে।


ফিরে আসে মুন্নি বাড়িতে একবারে মুষড়ে পড়েছে সে। নাগমা কে ছুটি দেয়, রাতের আয়া এসে গেছিলো ততক্ষণে। নিজে স্নান সেরে অনির ঘরে যায়,বাচ্চাটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আলমারি থেকে খামটা খুঁজে বের করে, অনির খাটের উপর বসে চিঠিটা খোলে। তাতে লেখা...


মুন্নি আমি জানি তুমি খুব অবাক হবে চিঠিটা পেয়ে, যখন পড়বে তখন হয়ত আমি কোথাও থাকব না। হ্যাঁ আমি তোমার স্বামীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছি, যাতে তার শরীরে মৃত্যুর বীজ বুনে দিতে পারি। ঠিক যেমন করে তোমার বাবা আমার বিধবা মা কে আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই মারণব্যাধি দিয়ে মেরেছিলো। আমি আর ভাই তখন ছোট ছিলাম, মা ছাড়া কেউ ছিলোনা আমাদের। তাকেও তোমার বাবা কেড়ে নিয়েছিলো। সেদিন ঠিক করেছিলাম তোমাদের পরিবার কে শেষ করে যাব। তোমার মায়ের এক্সিডেন্ট ও আমার ভাইয়ের ট্রাকেই হয়েছিলো। তাঁকে না সরালে আমি তোমার বাড়িতে আসতে পারতাম না। আমার মা তোমাদের বাড়িতে আশ্রিতা ছিলেন, তুমি তখন ছোট তাই আমায় চিনতে পারোনি। আমিও আমার শরীরে সেই মারণরোগ বয়ে এনে তোমার স্বামীকে দিয়ে গেলাম। ভাইকে খুঁজে পাবেনা। আমার কথা ছেড়েই দাও। এবার দেখো দুটো অসহায় মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকে সমাজে মুখ লুকিয়ে। আমি তোমার শিশুকে এ শাস্তি দিতে চাইনি কিন্তু আমার আর কোন উপায় ছিলোনা। 


মুন্নি পাথরের মত বসে থাকে চুপ করে। সে তার বাবার মুখটা মনে করে ঘেন্নায় কুঁকড়ে যায়। এ বিষবৃক্ষ তারই যে রোপণ করা।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy