ছাঁকনি
ছাঁকনি


ভোর পাঁচটায় হাঁটতে বেরিয়েছে মানস, মানস বিশ্বাস। রোজই বের হয়, আজও ব্যতিক্রম হয়নি। একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে সে। স্ত্রী 'চন্দ্রালী' ঝটপট উঠে বাসিকাজ সেরে প্রস্তুত; 'মানস' ফিরে এলেই হাতের সামনে চায়ের পেয়ালা তাঁর চাই-ই চাই। হ্যাঁ, ওই তো ফিরে এসেছে, বারান্দায় জুতো খোলার শব্দ পেয়েছে চন্দ্রালী। ―'চন্দ্রা...চন্দ্রা' ― 'হ্যাঁ বোসো...চা আনছি'মানস চা'য়ে চুমুক দেয়; কিন্তু কেমন যেন বিরক্তি ফুটে ওঠে মানসের মুখে। ― 'চন্দ্রা, চা কি ভালো করে ছাঁকা হয়নি?'― 'হ্যাঁ গো, তা নাও হতে পারে জান! ক'দিন ধরে ভাবছি তোমাকে বলব, একটা নতুন ছাঁকনি আনতে; তা কিছুতেই মনে থাকে না'― 'আচ্ছা, আজ ফেরার সময় নিয়ে আসব।'কথাগুলো শেষ করে মানস অন্যমনস্ক হয়ে যায়। অনেক গুলো ভাবনা উঁকি দেয় তাঁর মনে... "ছাঁকনি... আজ শুধু তোমারই প্রয়োজন নয় চন্দ্রা! ছাঁকনি প্রয়োজন আজ আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে; নতুন কোনো সম্পর্কই হোক অথবা কোনো মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই হোক; প্রতি মুহূর্তে আমি বা আমরা ঠকে চলেছি করো না কারো কাছে; শুধুমাত্র একটা ছাঁকনি না'থাকার জন্য।
আপনারই সহকর্মী আপনাকে ঠকিয়ে টাকা ধার নেবে। বেশ আলাপ জমিয়ে তুলবে একসময়, হয়তো আপনার মন পাবার জন্য! তারপর তাঁর প্রয়োজন মিটে গেলে, নানা অজুহাতে আপনাকে এড়িয়ে চলবে। কারণ আপনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে তাঁর কাছে। একটা সামাজিক ছাঁকনি থাকলে কাজে লাগত ওই সময়ে! সমাজের নিকৃষ্টতম কুখ্যাত গুন্ডাকে ভোট দিয়ে জেতাই রাজনৈতিক নির্বাচনে― এখানেও প্রয়োজন একটা রাজনৈতিক ছাঁকনির! বাড়ির প্রিয়জনকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করি এক মাতালখোর অকর্মণ্যের সাথে― পারিবারিক ছাঁকনি নেই তাই। প্রিয়ভাষিণী কাজের দিদি যাকে বাড়িতে দাখিল করি―পরে সেইই চক্রান্ত করে সর্বস্ব লুঠ করে দলবলের সাথে; বিশ্বস্ততার ছাঁকনি থাকলে এই বিপদে পরতে হয়না। সরকারি বেসরকারি নামী দামি বহু স্কুল-কলেজের ডিগ্রি লাভ করে বুক ফুলিয়ে, চোখে অহংকারের চশমা লাগিয়ে ঘুরছে লক্ষ্যহীন যুবসমাজ। বিষয়মুখী বহু প্রশ্নই ওঁদের 'সিলেবাসের' বাইরে; কেন এমন হয়? শিক্ষার ছাঁকনি নেই তাই। পরিবারের খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কিংবা মনোরঞ্জনের উপকরণ―চটুল গান-বাজনা নাকি নৈতিকতাহীন 'সিরিয়াল' সবকিছুই ঠিক করছে ক্ষমতালোভী নীতিহীন পরানুকারী রাষ্ট্র ব্যবস্থা; সঠিক রাষ্ট্রনীতি ছাঁকনির বড়ই অভাব চন্দ্রা...!"―'কি গো চা'টা শেষ কর, ঠান্ডা হয়ে যাবে তো'―'হ্যাঁ, এই তো শেষ করছি'―'তুমি তৈরি হয়ে নাও, অফিস আছে তো! আমি ততক্ষণে তোমার খাবার রেডি করে দিই'―'হ্যাঁ উঠছি...'মানস বেরিয়ে পড়ে অফিসের পথে। আবার শুরু সেই ছাঁকনিহীন দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা। সে মনে মনে আওড়ায়, 'ছাঁকনি এবার নিতেই হবে...'।