Debashis Roy

Abstract Romance

5.0  

Debashis Roy

Abstract Romance

অন্ধ বিচার

অন্ধ বিচার

4 mins
580



    অভূতপূর্ব এক আদালত! এ আদালতের বিচারপর্বও অভূতপূর্ব! এমন বিচিত্র বিচারপর্ব পৃথিবীর কোনো আদালতে সংগঠিত হয়েছে কিনা; তা পাঠকবর্গ একবার ভেবে দেখবেন।


    এ মহামান্য বিচারকের বিচারালয়ে কাঠগড়ার কোনো বালাই নেই! আসামির উপস্থিতির কোনো নজির নেই! বাদী-বিবাদী পক্ষের কৌশলীদের কোনো বাক্-বিতণ্ডা নেই, নেই কোনো জনসমাবেশ! এ আদালতে বিচারকের আসনে বিচারক একলাই! সামনে আসামির একখানি জীর্ণ পুঁথি, যে পুঁথি পাঠ করে বিচারক আসামির সাজা ঘোষণা করলেন―


      আজীবন নির্বাসন কারাদন্ড

      সেলুলার জেলের অন্ধকূপ!

       সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

          সমস্ত বন্ধন ছিন্ন!

 

    অলৌকিক এই বিচার ব্যবস্থায় আসামির কোনো তাপ-উত্তাপ নেই, কোনো যোগ-অভিযোগ নেই, নেই কোনও মান-অভিমান! চোখ-মুখে দুঃখ ও ক্লান্তির কোনও ছাপ নেই! হাসিমুখে বিচারকের এ রায় তিনি শিরোধার্য করলেন! তবে মহামান্য বিচারকের প্রতি লক্ষ্য রেখে আসামি একটি 'কলম' ও একটি 'খাতার' আবেদন জানালেন! আবেদন মঞ্জুর হল। তবে মহামান্য বিচারপতি কারারক্ষীদের কঠোর নির্দেশ দিলেন! আসামি যা কিছু লিখবেন, তা যেন যথা সময়ে বিচারকের নিকট পেশ করা হয়। আসামি জেলে প্রেরিত হলেন।


    বিচারের পূর্বে আসামির জীবন ইতিহাসের দিকে তাকালে যে জীবন চিত্র উঠে আসে, তা এক মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক চিত্র! প্রতিনিয়ত আঘাতে-আঘাতে জীবন যখন ক্ষত-বিক্ষতে বিষণ্ণে ভরে ওঠে, তখন (বর্তমান আসামি) গুরুর জীবনে এক শিষ্যের আবির্ভাব ঘটলো। শিষ্যের জীবন ব্যথায় ব্যথিত হয়ে; গুরু শিষ্যকে অসীম ভালোবাসা ও স্নেহ দিয়ে বুকে টেনে নিলেন। গুরু ও শিষ্যের দিন বড়ই আনন্দে অতিবাহিত হতে লাগলো! ধীরে-ধীরে শিষ্য, গুরুর ফেলে আসা অতীত জীবন রহস্য জানবার জন্য বড় চঞ্চল হয়ে উঠলো! গুরুর অবর্তমানে শিষ্য গুরুর গোপনে সৃষ্টকারী পুঁথির সন্ধান পেলো। গুরুর হৃদয়ে যত ক্ষতের চিহ্ন আছে, সেই ক্ষত হতে ক্ষরিত রক্ত দিয়ে পুঁথির প্রতিটা কণা তিনি প্রস্তুত করেছেন এবং নিদৃষ্ট সময়ে নিদৃষ্ট লক্ষ্যে সেই কণা আঘাত হানতে সক্ষম! সবার অলক্ষ্যে গভীর রাতে গুরু এইসব 'কবিতা' প্রস্তুত করেন। তবে গুরুর ত্যাগে অসীম ধর্ম, ভোগে নয়! শিষ্যের ভোগে ধর্ম, ত্যাগে নয়। এই বৈপরীত্যের জন্য শুরু হলো গুরু শিষ্যের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। গোপনে শিষ্য গুরুকে যতবার আঘাতে হানেন, সেই আঘাতের ক্ষরিত রক্ত দিয়ে গুরুও প্রিয় শিষ্যকে বশে আনবার জন্য 'কবিতা' প্রস্তুত করেন। একদিন সেই কবিতার সন্ধানও শিষ্য খুঁজে পেলো। শিষ্য এবার গোপনে গুরুকে বধ করবার পরিকল্পনায় লিপ্ত হলো। ভীতু শিষ্য কিছুতেই গুরুকে বধ করতে পারলে না। যতবার বধ করতে উদ্যত হয়, ততবার ভয়ে পিছিয়ে আসে! গুরু ভক্তির জোরে মৃত্যুকে জয় করেছেন, তাই মৃত্যু ভয় গুরুর কোনদিন ছিলো না! শিষ্যের হাতে মৃত্যুতে গুরু সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকতেন! এমনি করে দিন যত অতিবাহিত হতে লাগলো, গুরুর পুঁথিতে 'কবিতার' সংখ্যাও ততই বেড়েই চলতে লাগলো, যে কবিতা বহর দেখে এক সময় শিষ্যের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেলো। এমতাবস্থায় শিষ্য গুরুকে ঘায়েল করার সেরা অস্ত্র খুঁজে পেলো। কুটিল শিষ্য কুটিল চালে গুরুকে বন্দি করতে পুঁথিসহ মহামান্য বিচারকের নিকট উপস্থিত হয়ে বললে-----'পুঁথির বেশীরভাগ 'কবিতা' গুরু প্রস্তুত করেছে মহামান্য 'বিচারপতিকে' লক্ষ্য রেখেই! যে কোনো সময়ে গুরুদেব এ মারণ পুঁথি প্রকাশ করতে পারেন এবং তাতে বহুলোকের মানহানি সহ প্রাণহানির সম্ভাবনা অধিক।' মহামান্য বিচারপতি সেই পুঁথির সমস্ত 'কবিতা' পর্যবেক্ষণ করলেন এবং আতঙ্কে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন! বিচারপতির অনুমতি ছাড়া কেনো তিনি এই মারণ পুঁথি প্রস্তুত করেছেন! এই অপরাধে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে আসামিকে এই অভূতপূর্ব সাজা ঘোষণা করলেন―


     আজীবন নির্বাসন কারাদণ্ড

      সেলুলার জেলের অন্ধকূপ!

       সমস্ত যোগাযোগ বিছিন্ন

          সমস্ত বন্ধন ছিন্ন!


    কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীষ্ম যেমন নারী অম্বার বিরুদ্ধে কোনরূপ অস্ত্র ধারণ করেননি, অম্বার বাণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আটান্নদিন শরশয্যায় শয্যাগত থাকার পর মৃত্যু বরণ করেছিলেন! আসামিও ঠিক তেমনি ভীষ্মের মতো "নারী" মহামান্য বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনোরূপ অস্ত্র ধারণ করেননি ! নীরবে নিঃশব্দে নত মস্তকে বিচারপতির রায় শিরোধার্য করলেন। কারণ, বিচারকের প্রতি ছিল আসামির অসীম বিশ্বাস, ভক্তি আর 'অন্তরের একান্ত নিবিড় সম্পর্ক', যে সম্পর্কের জোরে আসামি এ চরম দন্ডেও ধন্য! যতই হোক না কেনো সেলুলার জেলের অন্ধকূপ!


    সেলুলার জেলকে আসামি স্বর্গের সমতুল্য দ্বার মনে করে জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন! পৃথিবীর সর্বশক্তি সেই যে সেরা অস্ত্র 'কলম' যা তিনি নিয়েছিলেন মহামান্য বিচারপতির কাছ থেকে, তা তিনি নিক্ষেপ করেন ভূমি অর্থাৎ বিচারকের দেওয়া সেই 'খাতার' উপর! সারাদিন কি যেন তার উপর হিজিবিজি লেখেন আর রাত্রি হলেই সেই লেখার টুকরো ছিড়ে খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন! প্রতিনিয়ত তিনি এই একই কর্মে লিপ্ত থাকেন। কারারক্ষীরা ভাবলেন, তিনি উন্মাদ হয়ে গেছেন! আগের মতো তিনি আর সেই ভুল করলেন না। কোন প্রমাণ আর রাখলেন না, যে প্রমাণে জন্য আজ তাঁর এই কারারুদ্ধ অবস্থা! এমনি ভাবে একদিন সেই কলমের কালি ও খাতা শেষ হয়ে গেলো। সেইদিন গভীর রাতে কারারক্ষীরা শুনতে পেলেন জিশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধের মতো প্রার্থনা―


           হে প্রভু,

     যাঁরা আমায় ক্রুশবিদ্ধ করছে

        তাঁরা অন্ধ, অজ্ঞ

     প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয়।

     এঁরা অবুঝ, শিশু, অবলা

     এঁদের কোন দোষ নিওনা

     এঁদের তুমি ক্ষমা কর প্রভু।


    এই প্রার্থনার পরদিন উদিত প্রভাতের আলোর ন্যায় আসামির দেহ হতে এক অপূর্ব আলোর আভায় কারারক্ষীদের ঘুম ভেঙে গেলো! তারা দেখতে পেলো হাস্য-স্নিগ্ধ, উজ্জ্বল মুখে হাতের কলমে সেই খাতাটিকে বুকে চেপে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে কাকে যেন দু'নয়ন মেলে খুঁজছেন! নিথর দেহ নিয়ে কারারক্ষীরা শ্মশানঘাটে উপস্থিত হলেন। সেই প্রেয়সী "নারী" মহামান্য বিচারপতি আর প্রাণের চেয়ে অধিক প্রিয় সেই "শিষ্য" লাশের বুকে চেপে ধরা সেই 'কলম' আর 'খাতা' তুলে অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে... খাতায় ভিতরে কোনো পৃষ্ঠা নেই! মলাট পাতার শেষে একটি লেখা স্বর্ণ আভায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল―

 

     যত কবিতা করেছি সৃষ্টি

       রেখেছি তা বক্ষমূলে,

     অগ্নি পেলে উঠবে জ্বলে

        হৃদয় পুড়ে যাবে! 

  হৃদয় ফুড়ে উঠবে যখন শীর্ষদেশে

       দু'চোখেরই অশ্রুকণা

           বক্ষ ভিজে

         চরণ কমল হবে !


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract