সমব্যথী
সমব্যথী
'ও স্বপন বাবু...কেমন আছ? এ'ভাবেই সম্বোধন করি পঞ্চাশোর্ধ আদিবাসী পুরুষ স্বপন সর্দারকে। ওঁর আপত্তি 'বাবু' সম্বোধনে। আমি বোঝাই, "যে কাজ করে সে-ই বাবু! লোকের ফাই-ফরমাস খেঁটে রোজগার করো; মাটি কাটার কাজ, ক্ষেতমজুরের কাজ, বিয়ে কিম্বা শ্রাদ্ধ বাড়ি সাফ-সাফাইয়ের কাজ, বাজনার তালে শাড়ি পড়ে মনোরঞ্জন কিছুতেই না নেই তোমার! তাই তুমি 'বাবু'।"
পথে যেতে যেতে কিম্বা কাজের প্রয়োজনে মাঝেমাঝে খোঁজ রাখি। এখন আর আপত্তি করেনা। বরং, আমার আগেই সে বলে, 'স্বপন বাবু'।
ভাবলাম আজ প্রাতঃভ্রমনে বেড়িয়ে ওঁর বাড়ি যাব কিছু কাজ রয়েছে। 'স্বপন বাবু, ঘরে আছ নাকি?' ডাকলাম উঠানে দাঁড়িয়ে। 'ও তো হাসপাতালে ভর্তি আছে, কাল মাথা ঘুরে পড়ে গেছে; এখনও বেহুঁশ, চোখ মেলেনি' -উত্তর দিল স্ত্রী 'সুন্দরী'। দেখলাম তাঁরও পা ভেঙেছে। বললাম, 'কোন হাসপাতালে?' -'বারাসাত'। ছেলে বিবাহিত, সে-ই সঙ্গে আছে।
সেদিন আর খবর নিইনি। পরদিন সকালে খবর পেলাম, স্বপন বাবু আর নেই, গত রাতেই জীবনের সব হিসাব-নিকাষ শেষ করে পাড়ি দিয়েছে অনন্তলোকে। মনটা ব্যাথিত হ'ল; এইতো সেদিন! ক্লান্তিহীন, কর্ম উৎসুক তাজা প্রাণ...।
শরতের থমথমে আকাশ। পৌঁছালাম জীর্ণ মাটির কুঁড়েঘরে। দাওয়ায় ছেঁড়া মাদুরে চিরনিদ্রায় শায়িত সদা ব্যস্ত 'স্বপন বাবু'; দুচোখে তুলসীপাতা; একটা মলিন সাদা থানে ঢাকা নিথর দেহ। মাথার পাশে বসে অসুস্থ স্ত্রী সুন্দরী। শুষ্ক দুই চোখে চেয়ে জানিনা কোন অজানা জিজ্ঞাসায়! আদিবাসী পাড়ারই কিছু লোকজন ঘোরাঘুরি করছে। 'ব্রেন স্ট্রোক' হয়েছিল। শবদাহের জন্য কাগজ পত্রের ব্যবস্থা করেছে এলাকার পঞ্চায়েত মেম্বার। সমবেদনা জানাতে আসছে কেউ; কেউবা সমব্যথী হ'তে।
নির্দিষ্ট সময়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন হ'ল। একমাত্র ছেলে পাড়া ঘুরে ভিক্ষা ক'রে শ্রাদ্ধ কাজ সম্পন্ন ক'রল। মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন উঁকি দেয় আজও, "আমি কি হ'তে পেরেছি 'সমব্যথী' সামান্য অর্থদানের বিনিময়ে?"